বিদেশি পর্যটকের খরা কাটাতে নতুনভাবে প্রস্তুত হচ্ছে কক্সবাজার
নিজ দেশ থেকে সরাসরি ফ্লাইটে এসে সমুদ্র ছুঁয়ে কক্সবাজারে নামবে একজন বিদেশি পর্যটক। সমুদ্র দেখবে, আমোদ-ফুর্তি করবে। দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে কক্সবাজার থেকেই আবার ফিরে যাবে নিজ দেশে— এমনভাবেই কক্সবাজারকে সিঙ্গেল টুরিস্ট স্পট করতে চাইছে সরকার। এক কথায় বলা যায়, বালি দ্বীপকে দিয়ে যেভাবে ইন্দোনেশিয়াকে চিনেছে পৃথিবী, একইভাবে কক্সবাজারকে দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে পরিচিত হতে চায় বাংলাদেশ।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপের পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য ছিল কক্সবাজার। তবে দীর্ঘ দুই দশক ধরে নানা কারণে বাংলাদেশে আসছেন না তারা। সেসব বিদেশি পর্যটক ফেরাতে চেষ্টা করছে সরকার।
বিজ্ঞাপন
ট্যুরিজম বোর্ড বলছে, পরিকল্পনা মাফিক চললে আবারও আগের মতো দেখা যাবে বিদেশি পর্যটক। তবে দেশি পর্যটক ও ট্যুর অপারেটররা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকার পর্যটকরা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা সমুদ্র চায় না। এগুলোর পাশাপাশি তারা সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাবার, প্রাইভেসি ও নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনা করে। এক কথায় তাদের দরকার একটি কম্বো সার্ভিস (একের মধ্যে সব)। সেই মানদণ্ডে বিবেচনা করলে বিদেশি পর্যটকদের জন্য এখনও প্রস্তুত হয়নি কক্সবাজার। পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ।
বিদেশি ট্যুরিস্ট : আগে কেমন আসত, এখন কেমন
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৩৯ হাজার বিদেশি পর্যটক আসে। সে সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতি বছর পাঁচ থেকে সাত লাখ বিদেশি পর্যটক আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও বাস্তবে এটি সম্ভব হয়নি।
ট্যুরিজম বোর্ড বলছে, সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক এসেছিল তিন লাখ ২৩ হাজার। বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটররা বলছেন, কাগজে-কলমে তিন লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক এলেও তাদের সিংহভাগই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে বিভিন্ন এনজিওর পক্ষ হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড বলছে, বাংলাদেশে যেসব বিদেশি পর্যটক আসছেন তাদের মধ্যে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসছেন মাত্র পাঁচ শতাংশ। বাকিরা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, উন্নয়ন প্রকল্প ও এনজিওর কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
দ্য গ্লোবাল ইকোনমির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যখন বিদেশি পর্যটকের খরা সে সময় (২০১৯ সাল) প্রতিবেশী দেশ ভারত ঘুরে গেছেন এক কোটি ৮০ লাখ, মিয়ানমার ভ্রমণ করেছেন ৪৩ লাখ পর্যটক। বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে থাকা নেপালের মতো উন্নয়নশীল দেশে একই বছর ভ্রমণ করেছেন ১২ লাখ, মালদ্বীপে ১৭ লাখ, পাকিস্তানে নয় লাখ ৬৬ হাজার বিদেশি পর্যটক।
বাংলাদেশ কেন ব্যর্থ, কক্সবাজার কেন ব্যর্থ
বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটর ও দেশি পর্যটকরা বলছেন, দেশে হাতেগোনা যেসব বিদেশি পর্যটক আসেন তাদের প্রধান গন্তব্য থাকে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। দক্ষিণ এশিয়ার যতগুলো দেশে সি-বিচ রয়েছে সেগুলোর চেয়ে আয়তন ও ঢেউয়ের উচ্চতার মাপ হিসেব করলে কক্সবাজার সবচেয়ে এগিয়ে। তবে এখানকার পরিবেশ এখনও বিদেশি পর্যটকদের অনুকূলে নয়। তাদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি (নির্জন বসবাসের পরিবেশ)। শীতপ্রধান দেশের পর্যটকরা এশিয়ার দেশগুলোতে গিয়ে খোলামেলা পোশাকে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে কক্সবাজারের প্রধান যে তিনটি বিচ রয়েছে সেখানে তারা কখনওই খোলামেলা পোশাকে সৈকতের বালিতে শুয়ে থাকতে নিরাপদ বোধ করেন না।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পর্যটন করপোরেশন বলছে, থাইল্যান্ডের পাতায়া ও ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের আদলে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে কক্সবাজার। এ দুই দেশে বিদেশি পর্যটকদের জন্য আলাদা বিচ, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো, বিচসাইড বার, ম্যাসাজ ও স্পা সেন্টার, বিচে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার ও গানবাজনার আয়োজনসহ সেখানে রাত কাটানোর নানা ব্যবস্থা রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের বিচগুলোতে রাতে বেঞ্চে শুয়ে সমুদ্রের ঢেউ আর চাঁদ দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না পর্যটকদের। তাদের যে চাওয়া তার অনেক কিছুই বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে না গেলেও অন্তত বিদেশিদের জন্য পৃথকভাবে আয়োজনগুলো করা যেতে পারে।
অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের দুরবস্থা
দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন স্পটগুলোর অধিকাংশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত। এমনকি যেই বালির আদলে চিন্তা করা হচ্ছে কক্সবাজারকে সেই ক্ষুদ্র দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারে কাছেও নেই কক্সবাজার।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে কোনো পর্যটক যদি বালি যেতে চান তাহলে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রেন, ফেরি কিংবা উড়োজাহাজে করে সেখানে যেতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, থাই ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মতো বড় বড় এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান নিজ দেশ থেকে সরাসরি বালিতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। পর্যটকরা নির্বিঘ্নে যে কোনো গন্তব্য থেকে যেতে পারেন সেখানে।
বিপরীতে কক্সবাজার এখনও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ার অপেক্ষায়। ঢাকা থেকেও নির্বিঘ্ন নয় কক্সবাজারের যোগাযোগ। ঢাকা থেকে বর্তমানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ ও নভোএয়ারের মোট ১৫টি ফ্লাইট দৈনিক কক্সবাজারে আসা-যাওয়া করে। এ রুটে চলাচলের আরেক মাধ্যম হচ্ছে বাস। বেশ কয়েকটি নামিদামি পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বাস এ রুটে চললেও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের বেহাল সড়কের কারণে সমুদ্রের শহরে পৌঁছাতে নয় থেকে ১২ ঘণ্টা লেগে যায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ঢাকা থেকে ট্রেনের সংযোগ পায়নি ‘অভাগা’ কক্সবাজার। একান্নতম বছরে এসে অর্থাৎ ২০২২ সালের শেষের দিকে ঢাকার সঙ্গে রেলে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে জেলাটি।
এছাড়া এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মতো শহর ঘুরে দেখার জন্য কক্সবাজারে নেই দিনব্যাপী মোটরসাইকেল বা গাড়িভাড়া দেওয়ার মতো কোনো পেশাদার সার্ভিস। বরং আশপাশে ঘোরাফেরা করতে হলে জিম্মি থাকতে হয় সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশাচালকদের কাছে।
হোটেলগুলো কতটা বিদেশি পর্যটকবান্ধব
কক্সবাজারের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিসের হিসাবে জেলায় তারকাসহ ও তারকা ছাড়া মোট ৩৯২টি হোটেল আছে। সেগুলোতে কক্ষের সংখ্যা ১৬ হাজারের মতো। এছাড়া বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত শৈবাল, উপল, প্রবাল ও লাবণী হোটেলে রয়েছে প্রায় তিনশ কক্ষ।
বেসরকারি হোটেলগুলোর মধ্যে পাঁচ তারকা সমমানের রয়েল টিউলিপ সি পার্ল হোটেল, সায়মন বিচ রিসোর্ট, সিগাল হোটেল লিমিটেড ও ওশান প্যারাডাইস লিমিটেড রয়েছে। তিন ও চার তারকার মধ্যে রয়েছে গ্রেস কক্স স্মার্ট হোটেল, লং বিচ হোটেল, হোটেল কক্স টুডে, জল তরঙ্গ, নিসর্গ হোটেল, সি ক্রাউন, বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলসহ তারকা মানের মোট ৬২টি হোটেল।
ট্যুর অপারেটররা বলছেন, কক্সবাজারে রয়েল টিউলিপ, সিগাল-সায়মনের মতো প্রায় ৮-১০টা হোটেলেই বিদেশিরা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই উদ্যোগ নিয়ে এ ধরনের চার ও পাঁচ তারকা হোটেলের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। সঙ্গে রাখতে হবে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। উন্নতমানের কিছু হোটেলকে বাছাই করে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে এগুলোতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে।
বিদেশিদের টানতে যেসব উদ্যোগ
দেশি-বিদেশি সবার জন্য স্বপ্নের কক্সবাজার গড়তে ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (কউক) গঠন করেছে সরকার। কক্সবাজারকে ঢেলে সাজাতে কউক হাতে নিয়েছে মাস্টার প্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) প্রণয়নের কাজ। মাস্টার প্ল্যানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য থাকবে পৃথক ‘ফরেন ট্যুরিস্ট জোন’। তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের মেরিন বিচ। বিচের পাশেই থাকবে অ্যাকুরিয়াম। বিচ অ্যাক্টিভিটি, সার্ফিং, প্যারাসিলিংয়ের জন্য থাকবে পৃথক ব্যবস্থা। থাকবে সার্ফিং ট্রেনিং সেন্টার। পাশাপাশি তাদের পছন্দের খেলা টেনিস ও গলফের জন্য কলাতলী, হিমছড়ি ও নিকটবর্তী পাহাড়ি এলাকায় গলফ-টেনিস কোর্ট নির্মাণ করা হবে। বিদেশি পর্যটকদের বিনোদনের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হবে রিক্রিয়েশন ক্লাব। ক্লাবে রাতভর বিনোদনের সব ব্যবস্থাই থাকবে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশল বিভাগের সদস্য লে. কর্নেল মোহাম্মদ আনোয়ার-উল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ফরেন টুরিস্ট জোন আলাদা হবে। এছাড়া আলাদা জোন করে নতুন হোটেল, রিসোর্ট, রেস্ট হাউজ, হাসপাতাল ও হাউজিং গড়ে তোলা হবে। তারা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে পারবেন। আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা বিদেশিদের জন্য কাঙ্ক্ষিত সেই কক্সবাজার গড়ে তুলতে পারব।’
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা দেখেছি থাইল্যান্ডের ফুকেট দ্বীপে অনেক বিদেশি ট্যুরিস্ট যান। আমরাও বিদেশিদের জন্য আমাদের সোনাদিয়া ও সাবরাংকে প্রস্তুত করছি। আমরা যদি কক্সবাজারের এ দুই জায়গায় ফুকেটের মতো সুবিধা দিতে পারি, তাহলে আমাদের দেশে বিদেশি ট্যুরিস্টদের আগমন বাড়বে। এছাড়া দেশের মধ্যে অন্য যেসব পর্যটনবান্ধব স্থান রয়েছে সেগুলোও প্রস্তুত করতে হবে।’
কী থাকছে সাবরাং ও সোনাদিয়ায়
কক্সবাজারের টেকনাফে সমুদ্র সৈকতের সাবরাং এলাকায় পর্যটকদের জন্য তৈরি হচ্ছে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক। পার্কের ভেতর একটি পাঁচ তারকা ও একটি তিন তারকা হোটেল তৈরির কাজ শিগগিরই শুরু হবে। পার্কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি প্রায় ৩৯ হাজার পর্যটক এখানে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। বর্তমানে এ পর্যটন অঞ্চলের প্রশাসনিক ভবন ও ভূমি উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা বাঁধ, সেতু-কালভার্ট তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) জানায়, সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে পর্যটন শিল্প গড়তে মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ চলছে। যা কক্সবাজার বা দেশের অন্য পর্যটন এলাকার চেয়ে আলাদা হবে। এখানে ঘিঞ্জি পরিবেশ ও ভিড় থাকবে না। পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখে পাঁচ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত পর্যটকদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সমুদ্রঘেঁষা এ পার্কে স্নোরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং, প্যারাসেইলিং, জেট স্কিইং, প্যাডেল বোর্ডিং, বিচ ভলিবল ও বিচ বোলিং সুবিধা থাকবে।
মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের মৌজা সোনাদিয়াতেও ‘সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বেজা জানায়, সোনাদিয়া ও তৎসংলগ্ন অন্যান্য দ্বীপের নয় হাজার ৪৬৭ একর জমিতে ‘সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দ্বীপে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের জন্য পরিবেশবান্ধব মাস্টার প্ল্যান তৈরির কাজও শেষ হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দ্বীপের ৩০ শতাংশ এলাকায় পরিবেশবান্ধব ইকোট্যুরিজম পার্ক হবে। বাকি জমি সবুজ ও সংরক্ষিত থাকবে। প্রকল্পের আওতায় ১০টি হোটেল-মোটেল, দুটি গলফ কোর্স ও দুটি টেনিস কোর্ট নির্মাণ হবে। থাকবে শিশুপার্ক, মসজিদ, জাদুঘর ও কমিউনিটি সেন্টার। এছাড়া সেখানে শৈবাল ও মুক্তাচাষসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ৩০ একর জমিতে হবে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিদেশি পর্যটক ফেরাতে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা ব্যবস্থা
কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ২৪ ঘণ্টা শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। বর্তমানে গভীর রাতেও পর্যটকদের সৈকতে অবাধ বিচরণ নিশ্চিত হয়েছে তাদের বদৌলতে। সেখানে বসবাসরত বিদেশিরাও বিচের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কক্সবাজারের নিশ্ছিদ্র এ নিরাপত্তা অনেক ট্যুরিস্ট টানবে বলে আশা প্রকাশ করেন ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জিল্লুর রহমান।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতকে শতভাগ নিরাপদ করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। ট্যুরিস্ট পুলিশের কারণে মানুষের মধ্যে সেন্স অব সিকিউরিটি বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকরা বিচে রাত কাটাতেও ভয় পাচ্ছেন না। তাদের মধ্যে একটা ফিলিংস এসেছে যে আমরা এখানে সেইফ (নিরাপদ), কোনো সমস্যা নেই। ট্যুরিস্ট পুলিশের এমন তৎপরতায় বিদেশিরা আরও বেশি সংখ্যায় এখানে আসবেন। দেশের ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট জোনের পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) সাকের আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাজের সুবাদে কক্সবাজারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি নাগরিক অবস্থান করেন। তারা মূলত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মী। বসবাসের পাশাপাশি বিনোদনের জন্যও তারা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে আসেন, বিচে নামেন। আগে সন্ধ্যার পর বিচে (সমুদ্র সৈকত) যাওয়া নিরাপদ মনে করতেন না পর্যটকরা। এখন সেই ভয় আর নেই। আমরা (ট্যুরিস্ট পুলিশ) তাদের নিরাপত্তায় অধিক যত্নশীল। কারণ, বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আশা করছি আমাদের এ প্রয়াস বিদেশি ট্যুরিস্ট আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কক্সবাজারকে নতুনভাবে সাজাবে পর্যটন করপোরেশন
কক্সবাজারকে বিদেশিদের জন্য প্রস্তুত করতে হোটেল-মোটেলের মান উন্নয়নে ইতোমধ্যে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা হোটেল-মোটেলগুলো আন্তর্জাতিক মানের করতে কাজও শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. জিয়াউল হক হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিদের জন্য সৈকতের লাবণী পয়েন্টকে তৈরি করা হচ্ছে। বিচটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও মানসম্মত। এখান থেকে খুব ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায়। এ পয়েন্টের আশপাশে বিদেশিদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, এক্সিবিশন সেন্টারসহ নানা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া লাবণী পয়েন্টে ঝিনুক মার্কেটের সামনে 'লাবণ্য' নামের একটি অত্যাধুনিক মোটেল তৈরি করা হবে। মূলত দেশি-বিদেশি তরুণ পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এ মোটেল। ইতোমধ্যে মোটেলটির ড্রয়িং ডিজাইন তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারের মোটেল উপল ও প্রবাল নিয়ে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পাশাপাশি হোটেল শৈবালে পর্যটন করপোরেশন নিজেই বিনিয়োগ করবে। সেখানেও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর হলিডে উইংকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। সেখানে বাংলাদেশের পর্যটনের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। তাদের সঙ্গে দেশি এয়ারলাইন্স হিসেবে আমরাও সাপোর্ট দিতে পারি। পাশাপাশি দেশের ট্যুর অপারেটরদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে আরও বেশি সংখ্যক বিদেশি পর্যটক পাবে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কক্সবাজারের উন্নয়নে আমরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করছি। যাতে একজন বিদেশি পর্যটক নিজ দেশ থেকে সরাসরি কক্সবাজারে এসে নামতে পারেন। এছাড়া সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে হচ্ছে বিমানবন্দরের দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে। বিদেশিদের জন্য আলাদা ট্যুরিস্ট জোন করা হবে, সেখানে তাদের বিনোদনের সব ব্যবস্থা থাকবে। উন্নত হোটেল-মোটেল নির্মাণ হবে, হবে রেস্টুরেন্ট। পাশাপাশি তাদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’
‘আমরা বিশ্ববাসীকে নতুন ও নিরাপদ একটি কক্সবাজার উপহার দেব’— যোগ করেন তিনি।
এআর/আইএসএইচ/এমএআর