চন্দ্রনাথ পাহাড়ে একদিন
করোনাকালীন বন্দিজীবন ক্রমশই অস্থির করে তুলছিল। ঘরে বসে রোজই ভাবতাম ‘আহারে, কবে যাবো পাহাড়ে’। পাহাড়ের সবুজ, এলোমেলো বাঁকা পথ, সকাল বেলার হালকা মিষ্টি রোদ; আমার কাছে স্বপ্ন পুরীর মতো। তাই লকডাউন ওঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর দেরি করিনি। সোজা ছুটে গেলাম সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। এবার সঙ্গী হলাম ‘পদচিহ্ন’ ভ্রমণ গ্রুপের সঙ্গে।
রাত ১২টায় ঢাকার সায়দাবাদ থেকে সীতাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ল। শহুরে যানজট এবং গাড়ির শব্দ যখন হাওয়ায় মিলে গেলো, তখনই গাড়ির পেছন থেকে একজন গান ধরলও- ‘বন্দে মায় লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে…’। আর কে থামে! সবাই তাল ধরলও সেই গানের। তারপর সারারাত চলল একের পর এক গান। মাঝে মাঝে কয়েকজন গাড়ির মাঝখানে উঠে এসে গানের সঙ্গে যোগ করল নাচ। আহা! ঘর পালানো মানুষগুলোর জন্য এ যেনও স্বপ্নের রাত।
বিজ্ঞাপন
ভোর ৬টায় সীতাকুণ্ডে এসে পৌঁছলাম। সীতাকুণ্ড বাজারে হোটেলে গিয়ে সবাই মিলে সকালের নাস্তা সেরে, সিএনজিযোগে সোজা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছলাম। টিমের সবাই খুবই এক্সাইটেড। দূরে দেখা যায় সবুজ পাহাড়, যেন আমাদের জন্যই রাজ্যের সকল সৌন্দর্য নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ে উঠার জন্য সবাই বাঁশের লাঠি কিনে নিলো। কেননা বন্ধুর পাহাড়ি পথে এই লাঠিই সবচেয়ে সহায়ক বন্ধু। এবার শুরু হলও চন্দ্রনাথ বিজয়ের ট্র্যাকিং
শুরুর দিকের রাস্তা অনেকটা সমতল। নয়নাভিরাম এই পাহাড়ি সবুজে আমরা হেঁটে চলছি। সমতল পথ ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে, কাদামাখা এবড়ো থেবড়ো ঢালু পথ ক্রমশই উঁকি দিচ্ছে। বর্ষায় এই পথ যেন আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। খুবই সতর্কতার সঙ্গে উঠছি সবাই। কিছু দূরে সরু পথ ভাগ হয়ে গেছে দু’দিকে, আমরা বাঁ-দিকের পথে রওনা হলাম। কেননা এই পথে উঠতে তুলনামূলক কষ্ট কম।
অনেকক্ষণ ট্র্যাকিং শেষে এবার একটু বিশ্রামের পালা। সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে। সবকিছু এড়িয়ে তবুও সবার চোখে এক অন্যরকম অনুভূতি, চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকিয়ে সবাই যেন বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর।
বিশ্রাম শেষে আবার পথচলা শুরু। খুবই সরু পথ, পাশাপাশি কোনভাবেই একজনের বেশি চলতে পারবে না। এই পথে ভালোভাবে চলতে হলে গ্রিপওয়ালা জুতার বিকল্প নেই। হালকা স্লিপার পড়ে ট্র্যাকিং করলেই বিপদ। আর অসতর্ক হলেই থাকছে বিপদে পড়ার শঙ্কা।
অনেকক্ষণ ট্র্যাকিং এর পরে উপরে একটা ছোট্ট ঢিবির মতো পেলাম, তার পাশেই একটা পাহাড়ি দোকান। কয়েকজন গিয়ে দোকানের লেবু পানির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো, কয়েকজন শুয়ে পড়লো ঢিবিতে আর কয়েকজন বসে বসে হাঁপাচ্ছে। আমরা কয়েকজন স্যালাইন পানি এবং কয়েকটা খেজুর খেলাম, এটা ট্র্যাকিং এর জন্য খুবই উপকারী। ইতিমধ্যে টিমের কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আর উপরে উঠবে না। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে আবার রওয়ানা হলাম আমরা।
এবার পথ যেন আরও বন্ধুর, উপরে উঠতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যে রোদের তাপ আরও বাড়ছে। সবাই ঘেমে একাকার। এরপর আরও উপরে উঠে দেখা পেলাম কাঙ্ক্ষিত বিরূপাক্ষ মন্দিরের। অনেকে এটাকে ছোট মন্দিরও বলে থাকে। এখানে সবাই বিশ্রাম নেয়, ছবি তোলে, বিমুগ্ধ হয়ে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে; আমরাও অংশ নিলাম সবার সঙ্গে। যেকেউ এখান থেকে পাহাড়ের চারপাশে তাকালে ওপরে উঠা কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে যাবে। আহা! কি অপরূপ দৃশ্য, মনে প্রশান্তি এসে গেলো। কিছুক্ষণ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এখান থেকে অল্প দূরেই পাহাড় চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির। চূড়ায় বিজয়ের উল্লাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমরাও আর দেরি করলাম না, যাত্রা শুরু করলাম বিজয়ের নেশায়।
বিরূপাক্ষ মন্দিরের পরের পথ অনেকটা সমতল, তাই এখান থেকে চূড়ায় উঠতে বেশি কষ্ট হয় না। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের এই চূড়াতেই চন্দ্রনাথ মন্দির অবস্থিত। আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে অবশেষ এসে পৌঁছলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায়। সমতল থেকে প্রায় ১১৫২ ফুট উঁচু পাহাড় চূড়ায়। সবাই উল্লাসে ফেটে পড়লো। বিজয়ের হাসি দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা উঁচিয়ে ধরল। চূড়া থেকে পূর্ব পাশের মনভোলানো দৃশ্য কোনভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়! দক্ষিণ দিকে সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক আর পশ্চিমের দিকে সাগর; এ যেন এক অনন্য সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। পাহাড়ে উঠার ক্লান্তি ভুলে উপভোগ করতে থাকলাম অপরূপ সৌন্দর্য।