আমেরিকার ক্যাপিটাল হিলে একদিন
পুরো আমেরিকায় ঝাঁকুনি দিয়ে ভ্রমণ পিপাসুদের ট্রাভেল চলছে। সেই দলে আমিও আছি। ১৩ দিনের ট্যুরে ৫টি ষ্টেট ঘুরে আসলাম। এরমধ্যে একদিন ছিলাম ওয়াশিংটনে। দারুণ অভিজ্ঞতা। সেটাই শোনাবো আপনাদের।
সামার ভেকেশনে নিউইয়র্ক নিউজার্সি হয়ে ফিলাডেলফিয়া যাই। ৩ হাজার মাইলের ট্রিপে ফিলাডেলফিয়া গিয়ে প্রথমেই আমেরিকার ঐতিহাসিক নান্দনিকতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমেরিকার বেশিরভাগ প্রেসিডেন্ট ফিলাডেলফিয়ার। সেখানে আমেরিকার রাজধানী ছিল বছর দশেক। সেখানেই লিবার্টি বেল, ইনস্টিটিউশন সেন্টার, প্রথম হোয়াইট হাউস, ৩০ বছরে তৈরি সিটি হল। মানে ইতিহাস আর ইতিহাস।
বিজ্ঞাপন
বাচ্চাদের ইচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসি দেখবে। ফিলাডেলফিয়া থেকে ১৩৯ মাইল দূরত্বে ডিসি। পিটার প্যান নামের একটা বাসে করে রাত ৮টায় রওনা হলাম। বাসে লোকজন কম, তবে সময় মতই বাস ছাড়ল। তারপর বাল্টিমোরে ছোট একটা বিরতি দিয়ে রাত ১১ টায় ডিসিতে পৌঁছলাম। বাসে বসেই হোটেল রিজার্ভেশনর করলাম। হোটেলের নাম হেরিংটন। এখান থেকে হোয়াইট হাউস পয়েন্ট ওয়ান মাইলের দূরত্ব। আমার ধারণা ছিল যেখানে বাসটা থামবে সেখান থেকে হোটেল অনেক দুরে হবে। কিন্তু ইউনিয়ন বাস বা স্টেশনটাই অন্যরকম। নানা কোম্পানির বাস, ট্রেন, এমট্রাক, ফুড কোর্ট, শপিংমল সবই এক জায়গায়।
রাত সাড়ে ১১টায় ইউনিয়ন স্টেশনের বাইরে বের হয়ে ট্যাক্সি নেব ভাবছিলাম, দেখি হোটেল মাত্র ওয়ান পয়েন্ট সিক্স মাইল। আরও অবাক করার বিষয় হল, স্টেশনের বাইরে বের হয়ে দেখি ক্যাপিটাল হিল দেখা যায়। আমি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে পায়ে হাঁটা শুরু করি। রাত তখন ১২টা। ক্যাপিটাল হিলে চলে যাই। যখন হাঁটছিলাম ইউনিয়ন ষ্টেশনের আশে পাশে হোমলেসরা সবাই ঘুমে। অনেক হোমলেস। ক্যাপিটালের সামনে কড়া সিকিউরিটি সামনে যেতে পারব কিনা জানতে চাইলে সম্মতি পাই। ক্যাপিটাল হিল রায়টের পর অনেকদিন ব্যারিকেড দিয়ে আটকানো ছিল, সম্প্রতি খুলে দিয়েছে। সেখানে আমরা অনেক সময় ছিলাম। ঘণ্টা খানেক বলা যায়। চারপাশের সব দেখার সুযোগ হয়েছিল।
গভীর রাতের আলোর ঝলকানিতে ক্যাপিটাল হিল আলোয় উচ্ছ্বসিত। সেখান থেকে প্যানসেলভেনিয়া এভিনিউ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে হোটেলের দিকে যাত্রা করি। এফ বি আই ভবন, আফ্রিকান আমেরিকার ওমেন কাউন্সিলসহ অনেক কিছু পেরিয়ে হোটেল হেরিংটন।
হোটেল হেরিংটন নিজেও একটা দর্শনীয় স্থান। ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হোটেলটি ওয়াশিংটনের ইতিহাসে জড়িত। পুরো হোটেলই একটা মিউজিয়াম বলা চলে। এত পুরনো কোন হোটেল আশে পাশে নাই। পুরো করিডোর জুড়ে আমেরিকার ইতিহাস, সঙ্গে ১৯ শতকের হোটেলের নানান জিনিসপত্র। এক কথায় চমৎকার। হোটেলের রুম, লবি, রেস্টুরেন্ট সব কিছুতেই ১৯ শতকের ছাপ রয়েছে।
ঘুরাঘুরি তো হলও। কিন্তু খাওয়া দাওয়া? রাতে কিছুটা অভুক্ত বটেই। কোথাও খাবার পাচ্ছি না, অনলাইনেও না। অনেক কষ্টে একটা পিৎজার ব্যবস্থা হল। তখন সবাই ঘুমে। আমি ও মেয়ে ওয়াদিয়াও পিৎজা খেয়ে ঘুমালাম। পিৎজা পিক আপ করতে রাস্তায় ছিলাম ৪৫ মিনিট। শনিবার রাতে আশপাশের বারগুলোর উন্মাদনা চোখে লাগলো।
পরদিন ১৮ জুলাই একটু দেরিতে ঘুম ভাঙ্গে সবার। হ্যারিংটন হোটেলের শতবর্ষী বুফে ব্রেকফাস্ট সবাই এনজয় করে। তারপর আমাদের দিন শুরু। পায়ে হাঁটা পথে হোয়াইট হাউসের দিকে যাত্রা। হোয়াইট হাউজে পৌঁছে যাই ২০ মিনিট পরেই। সেখানে কিউবানরা ডেমনস্ট্রেশন করছিল। মেয়ে ওয়াদিয়া আগে বলেছিল কিউবাররা হোয়াইট হাউসের সামনে। আমি কিউবানদের সঙ্গে ডেমনস্ট্রেশনে নামলাম। "ফ্রি কিউবা" বলে স্লোগান দিলাম। তারা আমাকে মাইক দিল বক্তব্য রাখলাম। আমাকে কিউবানরা জড়িয়ে ধরল, ছবি তুলল। থ্যাংকস থ্যাংকস বলল সবাই। কিউবান নাগরিকদের অবস্থা দাসের চেয়ে খারাপ। কিউবানদের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় ছিলাম।
হোয়াইট হাউসটা দেখার মত। ১৬০০ পেনসেলভেনিয়া এভিনিউ ‘নেশন মোষ্ট ফেমাস এড্রেস’ ( হোয়াইট হাউস), যেখানে জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া সব প্রেসিডেন্টই বসবাস করেছেন। তারপর ট্রেজারি বিল্ডিং, আফ্রিকান আমেরিকান মিউজিয়াম,পুরো স্ট্রীট জুড়ে সুভেনিরের পসরা, কোভিড পরবর্তী টুরিস্টদের ভিড় আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্টের ওয়াশিংটনের সম্মানে ৫৫৫ ফুট দীর্ঘ মনুমেন্টটা মার্বেল পাথরের তৈরি। যা ১৫০ বছরের পুরনো। আমেরিকার ক্যাপিটাল প্রথমে ছিল নিউইয়র্ক, তারপর দশ বছর ফিলাডেলফিয়া ও পরবর্তীতে ওয়াশিংটন ক্যাপিটাল হিসাবে ২০৩ বছর।
ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল গ্যালারী অব আর্ট দেখার সুযোগও হল। ১৫'শ শতকের কাঠের আসবাবপত্র আছে, সেখানে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্জির অসমান্য চিত্রকল্প ছিল, মিউজিয়ামটা আধুনিকতার সঙ্গে অতীতের মিশেল। ঘুরে ফিরে দেখতে পুরো দেড় ঘণ্টা চলে যায়।
তবে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাশনাল দেখা হল না, কারণ বিকেল চারটায় বন্ধ হয়ে যায়। এই একটি মিউজিয়ামই দেখতে টিকেট কেটে লাইন ধরতে হয়
পরে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে সাড়ে ৭টায় ইউনিয়ন স্টেশন মেট্রোতে পৌঁছি ট্যাক্সিতে করে। ভেবেছিলাম ফুড কোর্টে ডিনার করা যাবে দুর্ভাগ্য রোববার সব কিছুই বন্ধ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। একমাত্র সহায় ম্যাগডোনাল্ড, সেখান থেকে খাবার কিনে পিটারপ্যান বাসে ওঠি। ঠিক সময় মতই রাত ৮ টায় বাস ছাড়ে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে।