খুব ভোরে ঘুম ভেঙে হোম স্টে’র বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি শহর এখনো পুরোপুরি জাগেনি। গতকাল রাতেও বেশ বৃষ্টি হয়েছে। গত সন্ধ্যায় মল রোড থেকে ঠিক করা পাহাড়ি ড্রাইভার তামাং এর সাথে আজকের প্রথম গন্তব্য ইদগাহ মসজিদ। আজ ঈদের দিন। মল রোড থেকে মাত্র মিনিট চারেক দূরত্বের চকবাজারস্থ ঢালুতে জুম্মাহ মসজিদের অবস্থান। নামাজের সময় ৯.৩০ এর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই আমি পৌঁছাই। ধীরে ধীরে মুসল্লীদের ভিড় বাড়তে থাকে।

বেশ সুন্দর-গোছানো-পরিপাটি মসজিদটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় ৯টা বাজতেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদে নামাজ পরে বেশ তৃপ্তি পেলাম। নামাজের পর খেয়াল হলো চকবাজারের এই এলাকা মুসলিম এরিয়া। হালাল খাবারের হোটেলে মাত্র ৫০ রুপি প্লেটে লাল ভুনা কিংবা কালাভুলা স্বাদ পেলাম এখানে। কাশ্মীরি ফ্লেভারে রান্না করা মাংস, ডাল-ভাজি পারসেল করে হোম স্টে তে নিয়ে সবার সাথে বরণ হলো সেমাইয়ের বদলে এই ঈদ খাবারের। আল্লাহ পাক কে শুকরিয়া জানিয়ে আমাদের আজকের প্রথম গন্তব্য শুরু হলো লামাহাট্টা ইকো পার্ক এর দিকে। 

লামাহাট্টা বা লামাহাটা পার্ক

হোম স্টে থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই লামাহাট্টা বা লামাহাটা। মূলত শেরপা, ভুটিয়া, তামাং ও বিভিন্ন পাহাড়ি জাতির লোকেদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গ্রামটি। লামা কথার অর্থ হল বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং হাট্টা কথার অর্থ হল বাসস্থান অর্থাৎ এই লামাহাটা শব্দটির অর্থ হলো যেখানে বৌদ্ধরা বাস করে। ভারতীয় সরকার তিব্বতীয় লামাদের বসবাস করার জন্য এই জায়গাটি নির্বাচন করেছিলেন। ২০১২ সালে এখানে গড়ে ওঠে ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প। লোক মুখে শোনা- মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রামের পথ দিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ছবি তোলার জন্য থেমে বুঝতে পারেন জমজমাট পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে লামাহাট্টায়। সেই মতে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক এখন ছোট্ট গ্রামটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

লামাহাট্টার প্রধান আকর্ষণ বিশাল বিশাল পাইন গাছ। পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়ে কাঠের ওয়াচ টাওয়ার যার চারপাশটা জুড়ে আছে নানা ধরনের অর্কিড সহ বাহারী সব ফুল গাছ। নিষিদ্ধ পপি ফুলও চোখে পড়লো এখানে। মূল ফটক ছাড়িয়ে পাইন বাগানের উপর দিকে উঠতে লাগলাম। একজন বললেন এই পার্কের উপরটায় বেশ সুন্দর একটা লেক আছে। চমৎকার করে গড়া পাথরের রাস্তা দিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু রাস্তা বেয়ে যখন একদম লেকের কিনারায় উঠলাম তখন বেশ ক্লান্ত। ছোট্ট করে সাজানো ধাবা থেকে কেনা পানির বোতলে গলা ভিজিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম অনিন্দ্য সুন্দর লেক।

সবুজ পাইন বাগানের ছায়া পড়া লেক আর ঘন পাইন জঙ্গলের মায়াবী রূপ মাড়িয়ে আকাশ জুড়ে তখন মেঘের ঘনঘটা। যে পথে প্রায় ১ কিলোমিটার উপরে উঠা সেই পথ বেয়ে আবারো নিচে নেমে পার্কের মূল প্রবেশদ্বার আসতেই পুরো পাইনবাগান ছেয়ে গেলো মেঘে। সে এক অপূব দৃশ্য!! তার মিনিট দশেক পরেই ঝুম বৃষ্টি। গতদিনের চেয়েও আজকের বৃষ্টির সাথে পড়া শিলা যেন তিনগুণ বেশি। ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে পুরো দার্জিলিং যেন চুপসে গেছে। সাদা শিলায় আচ্ছন্ন শহর জুড়ে ট্যাক্সির বিশাল জ্যাম আর প্রায় প্রতিটা গাড়ির উইল্ডশিল্ড ব্লক হয়ে যাওয়া জানান দিল আজকেও রক গার্ডেন আমাদের ভাগ্যে নেই। ভাগ্যের কাছে হার মেনে পরবর্তী গন্তব্য সেন্ট পলস্ স্কুলের দিকে যাত্রা বদল।

সেন্ট পলস স্কুল

‘প্রাচ্যের ইটন’ নামে খ্যাত সেন্ট পলস স্কুল মূলত ছেলেদের জন্য একটি বেসরকারি বোর্ডিং স্কুল। প্রায় দুইশত বছর পুরোনো এই স্কুল স্বচক্ষে দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড় সবসময় লেগেই থাকে। জনসাধারণের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ (স্কুল কর্তৃপক্ষ, ছাত্র-শিক্ষক ব্যতীত) এই স্কুলটিতেই ‘ম্যায় হু না’ মুভির প্রায় সিংহভাগ শুটিং হয়েছিল। বলিউড বাদশা শাহরুখ খান, সুস্মিতা সেনসহ অনেকের পদচারণায় মুখরিত এই অনিন্দ্য সুন্দর স্কুলটির আদল যেন মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। সেন্ট পলস্ দেখা শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট।

হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট

সেন্ট পলস্ স্কুল থেকে মাত্র মিনিট ১৫ দূরত্বে হ্যাপি ভ্যালি চা বাগানের অবস্থান। ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দার্জিলিংয়ের দ্বিতীয়  প্রাচীনতম চা বাগান এটি। বৃষ্টি শেষের টি এস্টেট যেন সাদা মেঘের চাদরে মোড়ানো ভ্যালি। নয়নাভিরাম এমন দৃশ্য কেবল চোখের দেখাতেই অননুভবনীয়, বর্ণনায় শব্দেরও কমতি হয়ে যায়। টি এস্টেট এর এমন অপরূপ রূপে কাছে চাইলেও আমরা বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না। হুট করে নামা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আর কারণ-অকারণ মেঘের ডাকাডাকিতে ড্রাইভার তামাংকে সঙ্গী করে আমাদের গন্তব্য শেষ হয় ম্যালের কাছে রিলায়েন্স (বিগ বাজার) মল এ মুভি, বৃষ্টিভেজা ঠান্ডামাখা সন্ধ্যায় স্ট্রিট ফুড আর ধোঁয়া উঠা কফি উপভোগে। আগামীকাল সকালে আমরা বিদায় নিব মায়াময় মেঘের স্বর্গরাজ্য দার্জিলিং থেকে।  দার্জিলিং শহর থেকে নিউ জলপাইগুড়ি’র উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হবে মিরিক রোড ধরে যে যাত্রাপথে আমরা উপভোগ করবো লেপচাজগৎ, সীমানা ভিউ পয়েন্ট, ইন্দো-নেপাল বর্ডার, গোপালধারা টি এস্টেট, মিরিক লেক।

(চলবে)