পৃথিবীর ‘জলস্বর্গে’র গল্প (২য় পর্ব)
‘সৌদি-কুয়েতের চেয়ে মালদ্বীপে শান্তি, বেতনও ভালো’
প্রথম পর্বে মালদ্বীপের পর্যটন নিয়ে কথা বলেছি। দেখানোর চেষ্টা করেছি কীভাবে ১০০ শতাংশ মুসলমানের দেশ হয়েও বিশেষ কৌশলে পশ্চিমা পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে দ্বীপ দেশটি। এবার ফিরে আসা যাক পৃথিবীর এই ‘জলস্বর্গে’ বাংলাদেশি প্রবাসীদের অবস্থান বিষয়ে।
মালদ্বীপে কাজ করছেন দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী। অবৈধ অভিবাসীর হিসাব করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে বাংলাদেশির সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। ১ম পর্বে যেমনটা বলছিলাম- এখানকার রাস্তায় হাঁটতে গেলে কোনো না কোনো বাংলাদেশির সঙ্গে আপনার ধাক্কা লাগবেই!
বিজ্ঞাপন
মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় মালদ্বীপ প্রবাসীদের কাছে কিছুটা ঝামেলামুক্ত বলে মনে হয়। কর্মীদের বেতন তুলনামূলক ভালো। মালদ্বীপে বাংলাদেশি চিকিৎসক-নার্সেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি অনেক চিকিৎসক দেশটির বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবা দিচ্ছেন। এছাড়া অনেক বাংলাদেশির বিনিয়োগও রয়েছে দেশটিতে। ব্যবসার সুন্দর পরিবেশ থাকায় এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি নিজে ইউএস বাংলা এারলাইন্সের যে ফ্লাইটে মালদ্বীপ গিয়েছি, সেখানেও পুরোনো অনেক প্রবাসীর পাশাপাশি নতুন করে যাচ্ছেন এমন অনেক কর্মীকে দেখা গেছে।
প্রবাসীরা দেশটির বিভিন্ন দ্বীপে কাজ করছেন। হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একেকজন একেক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। কেউ কার্পেন্টার, কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউ সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। বেতন গড়ে ৪০০-৫০০ ডলার। বেশিরভাগ শ্রমিকের ক্ষেত্রে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কোম্পানি।
একাধিক নতুন প্রবাসীকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে মালদ্বীপ যাচ্ছেন। কয়েকজন ওয়ার্ক পারমিটের ছবি দেখিয়েছেন আমাকে। তাদের বলা হয়েছে— বেতন হবে ৪০-৬০ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া মালিক বহন করবেন। কেউ কেউ বলেছেন— ওখানে গিয়ে এই জব পরিবর্তন করে হোটেলে কাজ করবেন।
মালে শহরে কথা হয় আরও অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে। তাদের সবার কথায় ফুটে উঠেছে মালদ্বীপের পরিবেশ, প্রবাসীদের জীবনযাত্রা ও বর্তমান অবস্থা। এর মধ্যে অনেক প্রবাসী আগে মধ্যপ্রাচ্য়ের বিভিন্ন দেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছিলেন। পরবর্তীতে মালদ্বীপে এসে কাজেকর্মে স্থায়ী হয়েছেন।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সূত্রমতে, ২০২৪ সালের মার্চে মালদ্বীপের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজারে। সরকারি হিসাবে সেখানে কাজ করছেন প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি। আছেন অর্ধলাখের বেশি ভারতীয়, নেপালি ও শ্রীলংকান। সবমিলিয়ে দেশটিতে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা ৮ লাখের মতো।
প্রবাসীরা দেশটির বিভিন্ন দ্বীপে কাজ করছেন। হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একেকজন একেক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। কেউ কার্পেন্টার, কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউ সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। বেতন গড়ে ৪০০-৫০০ ডলার। বেশিরভাগ শ্রমিকের ক্ষেত্রে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কোম্পানি। প্রতি এক-দুই বছর পর এক মাসের বেতন এবং আপ-ডাউন টিকিটসহ দেশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন কেউ কেউ। এটা কোম্পানি ও চাকরির ধরনের উপর নির্ভর করে।
বৈধ প্রবাসীরা সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারলেও অবৈধদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ নেই। তাই অবৈধ প্রবাসীদের অনেকে বেশ সমস্যায় আছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা ফুরকান। তিনি মালে শহরে ব্যবসা করেন। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে কাজ করেছেন। ৫ বছর আগে এসে স্থায়ী হয়েছেন মালদ্বীপে। তার অধীনে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে কাজ করেন ১০ থেকে ১৫ জন বাংলাদেশি।
তার ভাষায়, মালদ্বীপ অন্য দেশের তুলনায় প্রবাসীদের জন্য অনেক ঝামেলামুক্ত। এখানে প্রবাসীদের খুব একটা বিরক্ত করে না পুলিশ। মধ্যপ্রাচ্যসহ একাধিক দেশে কাগজপত্র সংক্রান্ত ঝামেলা থাকলেও মালদ্বীপ এক্ষেত্রে অনেক সহনশীল।
ফুরকান জানান, একদিন দূরের এক আইল্যান্ড থেকে কিছু কাঁচামাল কিনে মালেতে এনে বিক্রি করি। সেই থেকে আমার ব্যবসা শুরু। প্রথম চালানের সময় আমার কাছে এক টাকাও ছিল না। শুধু একটা ফোনকলের মাধ্যমে অর্ডার করেছিলাম। পরদিন ঘাটে মাল হাজির। আমাকে কোনো অ্যাডভান্সও করতে হয়নি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন কাঁচাবাজারে আমার নিজের একটি দোকান রয়েছে। মাসিক আয়ও আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতারের চেয়ে মালদ্বীপে অনেক ভালো আছি। কাজ করে শান্তি পাচ্ছি। এদেশের পুলিশ ও নাগরিকরাও অনেক ভালো।
মালদ্বীপের ক্রসরোড আইল্যান্ডে একটি বারে কর্মরত আছেন জসিম উদ্দিন নামে এক বাংলাদেশি। তিনি বার টেন্ডারের কাজ করেন। এ আইল্যান্ডে তিনিসহ মাত্র দুজন বাংলাদেশি এমন কাজ করেন। যা সাধারণ কর্মীদের কাজের চেয়ে ভিন্ন এবং বেশ সম্মানের কাজ।
জসিমের কথায়, তিনি দেশটিতে কাজ করছেন তিন বছর ধরে। শুরুর দিকে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেও এখন তিনি বারের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। বেতনও অন্যান্য প্রবাসীর তুলনায় বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই লাখ টাকার মতো আয় তার। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি এই আইল্যান্ডে এমন সম্মানের কাজ করছেন।
তিনি বলেন, বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ডিউটি থাকে। এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো। অতিথিরা সবাই অনেক সম্মান দিয়ে কথা বলেন।
মালদ্বীপে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখেছি পাঁচ জেলার মানুষ। শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা। এরপর রয়েছে ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী। এদের মধ্যে বহু বাংলাদেশি হোটেল-মোটেল সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত। এ সফরে চারটি হোটেলে থেকেছি। এর মধ্যে তিনটিতেই বাংলাদেশি কর্মী পেয়েছি। বাকি একটিতে ছিলেন ভারতীয় কর্মী। তিনি ছিলেন দেশটির তামিলনাড়ুর বাসিন্দা।
একাধিক হোটেলকর্মী বলেন, এখানে কাজ করে ভালো আছি। থাকা-খাওয়া মালিক দেন। বেতন যা পাই, তাতে খুব একটা হাত দিতে হয় না। পুরো টাকাই বাড়িতে পাঠাতে পারি। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থেকেছি। সেখানে পুলিশ অনেক ঝামেলা করত। যা আয় হতো তার বেশিরভাগ আকামার (বৈধ হওয়ার কাগজ) টাকা দিতেই চলে যেত।
মালদ্বীপ বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিটির সভাপতি প্রবাসী ইমরান হোসাইন তালুকদার বলেন, এদেশে কর্মরত রয়েছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। এদের বেশিরভাগই ভালো আছেন। অল্পকিছু লোক অবশ্য অপরাধে যুক্ত হয়েছেন, তাদের জন্য সব প্রবাসীর সম্মানহানি হচ্ছে। তবে একটি কথা না বললেই নয়— আগের চেয়ে মালদ্বীপে বাংলাদেশি দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক নিয়োগ দিচ্ছে দ্বীপ দেশটি।
যাতায়াত প্রসঙ্গে এ প্রবাসী সাংবাদিক বলেন, আগে ঢাকা-মালে রুটে মালদ্বীপ এয়ারলাইন্সসহ গুটিকয়েক বিদেশি এয়ারলাইন্স ছিল। কিন্তু ইউএস বাংলা সরাসরি ফ্লাইট চালুর পর মালদ্বীপে বাংলাদেশি পর্যটক বেড়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সুনামও বেড়েছে। আবার কিছু পর্যটক এসে কাজের জন্য থেকে যাচ্ছেন, এতে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
এমজে/পিএইচ