কাশ্মীর ভ্রমণ : সোনমার্গ ও পেহেলগাম মুগ্ধ করবেই (তৃতীয় পর্ব)
কাশ্মীর ভ্রমণের ৮ রাত ৯ দিনের পরিকল্পনা দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় দিনে আমরা গিয়েছিলাম গুলমার্গে। শ্রীনগর থেকে মাত্র ৫২ কিলো দূরে সবুজ ঘাসে বিস্তৃত গুলমার্গ, যা সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে। সে গল্প জেনেছেন আগেই।
কাশ্মীর ভ্রমণের চতুর্থ দিন (সোনমার্গ)
মাইনাস ২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সকাল হলো আমাদের। নাস্তার সাথে গরম গরম চা শেষ করে শ্রীনগর থেকে রওনা দিলাম সোনমার্গের উদ্দেশ্যে।
বিজ্ঞাপন
শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলো দূরে সুন্দর উপত্যকা ও ঝর্ণার দেখা মিলবে সোনমার্গে। এখানে আছে থাজিয়ান হিমবাহ। এছাড়াও সিন্ধু নদী আছে স্লেজিং, স্নো বাইক ও ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ। তবে কাশ্মীরে কিছু জায়গা রয়েছে যা শহর থেকে একটু দূরে, হয়তোবা অনেকেরই অজানা, তবে ভালো লাগার মতো। সোনমার্গ তেমনই একটি জায়গা।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ যেতে পথে পড়বে গান্দেরবল, কঙ্গন, গুন্দ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ি জনপদ। আর পুরো পথটাই সাথে থাকবে দামাল সিন্ধু নদ। পাইন, ফার, বার্চ আর দূরদূরান্তের পাহাড়ের শোভা দেখতে দেখতে আপনি মোহিত হয়ে পড়বেন। চারপাশে পাহাড় আর সোনালি ঘাসে ঢাকা সোনমার্গ নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে যে এই উপত্যকার কোথাও এক কূপ আছে যার জলে সোনালি রং ধরে উপত্যকায়। এই জন্য নাম সোনমার্গ অর্থাৎ সোনালি উপত্যকা ।
সোনমার্গ থেকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় খাজিয়ার হিমবাহের কোলে। এখানে ঘোড়ায় চড়তে অবশ্যই দর দাম করে নিতে হবে। ইউনিয়ন এবং সরকারি প্যাকেজ দামের দোহায় দিয়ে ঘোড়া প্রতি ১৬০০ থেকে ২৫০০ রুপি পর্যন্ত করে দাম চাইবে সবগুলো পয়েন্ট ঘুরে দেখার জন্য। তবে দরদাম করে সবগুলো পয়েন্ট ১২/১৩শ' রূপিতে ঘুরে দেখা সম্ভব। যাওয়া আসা মিলিয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার এই পনি রাইড আমাদের কাছে অসাধারণ লেগেছিল। দারুণ উপভোগ করেছি আমরা। শীতের সময় এখানে বরফ নিয়ে মেতে ওঠে সবাই। জুন থেকে অক্টোবর মাসে চা খাবারের দোকান বসে হিমবাহের কাছে। এখানে মিলবে নানা পদের ম্যাগিও। হিমালয়ের হাঁড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাসে যখন আগুণ গরম ম্যাগির ধোঁয়া মিলে মিশে একাকার তখন অদ্ভুত এক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন আপনি। মন ভরে ছবি তুলুন আর ইচ্ছে হলে চায়ে চুমুক দিন যতবার ইচ্ছা ।
কাশ্মীর ভ্রমণের পঞ্চম দিন (সিন্থান টপ)
কাশ্মীরে এসে শুরু থেকেই কিছু অফ-বিট জায়গা খুঁজছিলাম। তখন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ চলছে। এসময় নাকি সাধারণত অনন্তনাগ এবং কিশতওয়ারের দিকের রাস্তাটা বন্ধ থাকে অতিরিক্ত বরফের কারণে। তবে আমাদের ভাগ্য সহায় হল। এবছর এখনো তুষারপাত শুরু না হওয়ায় সে রাস্তা তখনো খোলা। খবর পেয়েই চমকে উঠলাম। ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, কাশ্মীর উপত্যক্যার সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা জায়গা সিন্থান টপ আমাদের আজকের গন্তব্য।
সিন্থান টপ জিরো পয়েন্টের উচ্চতা ১২ হাজার ফুটেরও বেশি, তাই এদিন আমাদের বাড়তি চার হাজার রুপি গাড়ি ভাড়া লাগলো। অর্থাৎ সিন্থান টপ যাওয়ার জন্য আমাদের মোট গাড়ি ভাড়া লেগেছে ৬ হাজার রুপি। গভীর পাহাড়ি খাদ ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে যখন প্রায় সিন্থান টপের কাছাকাছি পৌঁছেছি তখনও বুঝিনি কি অদ্ভুত সৌন্দর্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। চলতে চলতে কখনো মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি বিশাল পাহাড়ের খাদে! আবার কখনো মনে হচ্ছে চোখের পলক ফেললেই এই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যগুলো চোখের সামনে থেকে সরে যাবে। এখানে আসলে আপনাদের আফসোস হবে যে, সময়টাকে যদি থামিয়ে দিতে পারতাম!
সিন্থান টপ পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে বরফে পা রাখতেই হাঁটু পর্যন্ত পা দেবে গেল। শুরুতেই বুঝে গেলাম বাকি সময়টা আমাদের কতটা পাগলামিতে কাটবে। এমন তুষারের অপেক্ষাতেই তো ছিলাম আমরা এই কটা দিন। এবার বেজ থেকে টপে ওঠার পালা। জনপ্রতি ১০০০ রূপিতে স্নোবাইকে করে টপে উঠতে হবে। এখানে স্নোবাইকে চড়ার অভিজ্ঞতা লিখে বোঝানো সম্ভব না। দুর থেকে টপ দেখে মনে হতে পারে হেঁটেই ওঠা যাবে তবে স্নোবাইকে উপরে ওঠার পর বুঝলাম সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। টপে উঠে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছবি তুলে ফেরার পথ ধরলাম। তবে আজ আমরা শ্রীনগর ফিরবো না। আজ রাত থাকবো প্যাহেলগামে।
কাশ্মীর ভ্রমণের ষষ্ঠ দিন (পেহেলগাম)
সিন্থান টপ থেকে পেহেলগামে পৌঁছাতে রাত প্রায় ৯টা বেজে গেল। পথেই একটা লোকাল হোটেলে থেমে কাবাব, রুটি, মম আর চা খেয়ে নিলাম। গেহেলগামের হোটেলে পৌঁছেছি তখন সেখানে মাইনাস ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা চলছে। তবে অধিকাংশ হোটেলে হিটিং সিস্টেম ভালো তবু হোটেল বুক করার আগে তাদের হিটিং সিস্টেম চেক করে নিতে পারেন।
ভোরের সূর্যটা যখন জানালায় এসে পড়লো তখন উঠে গিয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখলাম ছবির মতো সুন্দর একটি জায়গায়, পাহাড়, গাছ, নদী আর বরফের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। একেকটি পাহাড়ের যেন একেক রকম মায়া। পাহাড়ঘেরা রাস্তায় প্রতিটি বাঁকে চোখে পড়ে সারিবদ্ধ পাহাড় আর তার চূড়ায় বরফের আবরণ। মনে হবে যেন সৃষ্টিকর্তা আইসক্রিমের ফেরিওয়ালাকে সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর দুনিয়াতে।
পেহেলগামে ঘুরতে হলে এখানকার ইউনিয়ন থেকে আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। হোটেলের রিসিপশন থেকে বিভিন্ন প্যাকেজ দেখে আমরা তিনটি লোকেশনের জন্য গাড়ির প্যাকেজ নিলাম ১২০০ রূপিতে। পেহেলগামের নয়নাভিরাম তিনটি ভ্যালি ঘুরে দেখবো আমরা। আমাদের আজকের গন্তব্য আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি ও চন্দনওয়ারি। এই তিন জায়গাকে পেহেলগামের এবিসি বলা হয়। তাই আমরা এই তিন জায়গা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে এর বাইরে আরো কয়েকটি ভ্যালি আছে। আপনারা যদি বসন্তে কাশ্মীর ঘুরতে আসেন তাহলে পেহেলগেম অন্তত দুইদিন সময় নিয়ে আসা উচিত।
পেহেলগাম থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে আমাদের প্রথম গন্তব্য চন্দনওয়ারি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৮৯৫ মিটার উঁচু, এককথায় ‘বিপজ্জনক সৌন্দর্য’। এ বিশেষণ ব্যবহারের কারণ, শুভ্র বরফ আপনাকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু বরফপৃষ্ঠ এতই পিচ্ছিল যে আপনি হোঁচট খেতে বাধ্য। চন্দনওয়ারিতে দেখা মিলবে আধো বরফ আচ্ছাদিত পাহাড় আর পাইন গাছের সমান্তরাল সমবায়, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ‘শেষনাগ’ লেক। এখানে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়া পানির শব্দে এত মোহ, মনে হবে যেন এক অদৃশ্য সংগীত সুরকার প্রতিনিয়ত সুর তুলছেন তাঁর অদৃশ্য তানপুরায়।
চন্দনওয়ারি থেকে পরের গন্তব্য আরু ভ্যালি। এটি পেহেলগাম থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেও আরু ভ্যালি সবুজ, সুন্দরী। চারপাশ পাহাড়ঘেরা, মাঝখানে সমতল উপত্যকা। ঘোড়ায় চড়ে পুরো ভ্যালি ভ্রমণ করা যায়। স্থানীয় পোশাকে ছবি তোলার ব্যবস্থাও আছে এখানে।
পেহেলগামে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল বেতাব ভ্যালি। ১৯৮৩ সালে বলিউডে মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় মুভি ‘বেতাব’-এর নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ‘বেতাব ভ্যালি’। আয়তনে আরু ভ্যালির চেয়ে বড়, মনে হবে এক বিশাল সবুজ গালিচা। বিশাল পাহাড়ের মধ্যে সমতল জায়গায় ঠাঁই করে নিয়েছে পাইন বন। চন্দনওয়ারি থেকে এই পথে তীর্থযাত্রীরা অমরনাথ মন্দিরে যাত্রা করেন। ওপরের যেই চূড়াগুলোতে এখনো কিছুটা বরফ রয়ে গেছে, সেখান থেকেই এখনো বরফ গলে বেতাব ভ্যালির ভেতর দিয়ে এ স্রোতোধারা ছুটে চলছে লিডার নদীর দিকে। পাহাড়, নদী, উপত্যকা আর অপার নিস্তব্ধতা - প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এ যেন স্বর্গের পরশ।
চলবে...