মেহেরপুরে যা দেখবেন
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুর। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি অখণ্ড ভারতবর্ষের নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিলও। পাকিস্তানি শাসনামলে মেহেরপুর সদর ও গাংনী নিয়ে গঠিত হয় মেহেরপুর মহকুমা। তখন এটি বৃহত্তর কুষ্টিয়ার অংশ ছিলও। ১৯৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুরকে জেলার মর্যাদা দেয়া হয় এবং ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুরে মুজিবনগর নামে আরেকটি উপজেলা গঠন করা হয়। ঐতিহাসিক এই জেলার কয়েকটি দর্শনীয় স্থান নিয়ে এ আয়োজন-
আমঝুপি নীলকুঠি
বিজ্ঞাপন
নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে নীল চাষ করা হতো। ইউরোপে নীলের ব্যাপক চাহিদার কারণে ব্রিটিশরা এদেশের কৃষকদের জোরপূর্বক নীল চাষ করাতো। কুঠিটিতে নীল চাষ ও মজুদ করে রাখা হতো। জনশ্রুতি রয়েছে, এই কুঠিতে বসেই মীর জাফর, লর্ড ক্লাইভসহ অন্য বেনিয়ারা নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আমঝুপি নীলকুঠি অনেক পছন্দের স্থান।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মেহেরপুরের ভবের পাড়া গ্রামের আম্রকাননে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে জাতীয় চার নেতা শপথ গ্রহণ করেন। তখন থেকে এই স্থানের নাম রাখা হয় মুজিবনগর। ২৩ বছরের পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের নিপীড়নের প্রতীক স্বরূপ এখানকার স্মৃতিসৌধে ২৩টি মিনার তৈরি করা হয়েছে। সব বয়সের মানুষ এখানে ভ্রমণ করেন।
ভবানন্দপুর মন্দির
মেহেরপুর জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলও সদর উপজেলার ভবানন্দপুর গ্রামে অবস্থিত এক প্রাচীন মন্দির। স্থাপত্যশৈলী দেখে অনেকে একে বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে অনুমান করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি হিন্দু মন্দির হিসেবে স্বীকৃত।
বলরাম হাড়ির মন্দির
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলরাম হাড়ি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে ‘আধ্যাত্মিক সাধক’ হিসেবে অভিহিত করেন। উপাস নামে তিনি একটি ধর্মমত তৈরি করেন। এর অনুসারীরা বলরামী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। ১৮৫০ সালে ৬৫ বছর বয়সে বলরাম হাড়ি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধি মন্দিরের পাশেই রয়েছে। মেহেরপুরের জমিদার জীবন মুখার্জি তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ৩৫ শতাংশ জমি দান করেন। এ জমিতে বলরাম হাড়ির সমাধি মন্দির রয়েছে।
স্বামী নিগামানন্দ আশ্রম
মেহেরপুর জেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান স্বামী নিগামানন্দ আশ্রম। সনাতন ধর্মের সংস্কারক নিগামানন্দ সরস্বতীর জন্য ১২২৭ বঙ্গাব্দে রাধা গোবিন্দপুর গ্রামে। পৈতৃক নিবাস মেহেরপুরের কুতুবপুর গ্রামে। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব দর্শন ও শঙ্করের মায়াবাদী দর্শনের সমন্বয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নতুন ধর্মমত। তিনি গৃহী হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন সন্ন্যাসী এবং মানুষের ভালোবাসার সাত্ত্বিক পুরুষ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেহেরপুর শহরে রাজা গোয়ালা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত করেন আটচালা শিবমন্দির। এই মন্দিরই এখন নিগামানন্দের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত আশ্রম হিসেবে কাজ করছে।
বল্লভপুর গির্জা
ভবের পাড়া গ্রামের বল্লভ পুর গির্জা ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান ক্যাথলিক ভাবাদর্শকে সমর্থন করে এ গির্জা প্রতিষ্ঠা করা হয়। গির্জার নির্মাণশৈলীতে রয়েছে দেশীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির
মেহেরপুরের বড়বাজারে অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরটিকে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জেলার কেন্দ্রীয় মন্দির হিসেবে গণ্য করে। মন্দিরটি মেহেরপুর জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির হিসেবে সমাদৃত। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, রাজা গোয়ালা চৌধুরী বা তাঁর পরবর্তী বংশধররা যশস্বী ও প্রতিপত্তির আশায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু মন্দিরটির দেয়ালে লেখা রয়েছে ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রয়াত গোপাল সাহার স্ত্রী পাচু বালা দাসী এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে বালা দেবীর বিগ্রহ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানিরা মন্দিরে হামলা চালায় এবং ভেতরে থাকা বালা দেবীর মূর্তিটি ভেঙে দেয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পুনরায় মূর্তি স্থাপন ও নিয়মিত পূজা-অর্চনা শুরু করেন। কালীপূজা, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজাসহ আরও অনেক পূজা অনুষ্ঠিত হয় এখানে। এই মন্দিরে পাঠা বলি দেয়ার রেওয়াজও রয়েছে।
এইচএকে/ আরআর/ এএ