এই শীতেই ঘুরে আসুন নীলফামারীর ১৩ দর্শনীয় স্থান
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শীতকাল অন্যতম আকর্ষণীয় ও মোহনীয়। অনেকেই শীতকালকে ভ্রমণের মৌসুম বলে থাকেন। এ সময়টাকে উপভোগ করতে সবাই যে যার মতো বন্ধু-স্বজন নিয়ে ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আবার কেউ কেউ যান বিদেশ ভ্রমণেও। কর্মব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে শীতের এই সময়ে কিছুটা প্রশান্তির জন্য আপনি যখন মুখিয়ে আছেন তখন উত্তরের জেলা নীলফামারী হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জায়গা।
নীলফামারী ভ্রমণে আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি যেমন সমৃদ্ধ হবে তেমনি পরিচিত হতে পারবেন নতুন কোনো আবহের সঙ্গে।নীলফামারীতে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। এর মধ্যে পাঁচটি স্থাপনা সারাদেশে জনপ্রিয়। এগুলো হলো নীল সাগর, তিস্তা ব্যারাজ, নীলকুঠির, চিনি মসজিদ ও কুন্দুপুকুর মাজার। এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। জেলায় ছোটবড় সব বয়সীদের ঘুরে দেখার মতো আরও আছে ভিমের মায়ের চুলা, পাল রাজার বাড়ি, হরিশ্চন্দ্রের পাঠ, দেশের সর্ববৃহৎ সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা।
বিজ্ঞাপন
নীলসাগর
সমুদ্র নয়, তবে সমুদ্রের নামের সঙ্গে মিল রেখে ১৯৮০ সালে নামকরণ হয়েছে ‘নীলসাগর’। এর আয়তন ৯৩.৯০ একর। তবে গভীরতা আজও নির্ধারণ করা যায়নি। ধারণা করা হয়, বছর জুড়ে ৮০ থেকে ৮৫ ফুট পানি থাকে এখানে। সাগরপাড়ে আছে বৃক্ষরাজি তরুলতা, সুউচ্চ পাড় বেষ্টিত বেত বন ও গুল্মলতা। শীতের দিনে অতিথি পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে এ এলাকা।
জনশ্রুতি আছে, ২০০ বছর আগে বিরাট রাজার গরুকে পানি দিতে দীঘিটি খনন করা হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত হলে তাকে এর পাড়ে সমাহিত করা হয়। আবার অনেকের ধারণা, ওই রাজার একমাত্র মেয়ে বিন্নাবতীর স্নানের জন্য দীঘিটি খনন করা হয়। তার নামানুসারে এর নামকরণ হয় ‘বিন্নাদীঘি’।
নীলসাগর রেস্ট হাউস
১৯৮০ সালে এই দীঘি আধুনিকায়ন করেন নীলফামারীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল জব্বার। সংস্কার কাজের উদ্বোধনকালে তিনি এর নাম দেন ‘নীলসাগর’। এই স্থানের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা, যানবাহন, এমনকি নীলফামারী-ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনের নামকরণ হয়েছে।
বিনোদন কেন্দ্রটি জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী-দেবীগঞ্জ-পঞ্চগড় সড়কের পাশে অবস্থিত। জেলা শহর থেকে ভ্যান, অটোরিকশা, বাস, মাইক্রোবাস, ট্রেনে যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া আকাশপথে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে বাস বা ট্রেনে আসা যায়।
বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এখানে মাছ ও অতিথি পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে বিনোদনের ব্যবস্থা। পর্যটকদের জন্য আবাসিক সুবিধাসহ বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নীলফামারী মিউজিয়ামের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে।
তিস্তা ব্যারেজ
প্রতিদিন দর্শনার্থীদের সমাগমে মুখর হয়ে ওঠে এই এলাকা। ব্যারাজটি এক নজর দেখার জন্য কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বগুড়া জেলার ভ্রমণপিপাসুরা প্রতিদিন ভিড় করেন। বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তা। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে এসে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে লালমনিরহাট জেলায় অবস্থিত। আর দর্শনীয় ব্যারাজটি তিস্তা সেচ প্রকল্পের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকা হওয়ায় ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তবে এর মূল পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫৩ সালে।
বুড়ি তিস্তা নদীটি আগে তিস্তা নদীর মূলধারা ছিল। কিন্ত কালক্রমে তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হলে এটি শাখা নদীতে পরিণত হয় ও নাম ধারণ করে বুড়ি তিস্তা নদী। এটি ডিমলা উপজেলা বালাপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি গঙ্গাচড়া উপজেলায় গিয়ে পুনরায় তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে।
নীলকুঠি
কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেঁভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নীলফামারীর ইতিহাসে গৌরবময় কিছু অধ্যায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মৌজা নটখানায় নীলচাষের একটি বৃহৎ খামার ছিল। ১৮৪৭-৪৮ খ্রিস্টাব্দে নীলচাষে লোকসান হওয়ায় কৃষকরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে নেমে আসে নিরহ কৃষকদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার। ১৮৫৯-৬০ সালে কৃষকদের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন এলাকা ছেড়ে নীলকরেরা পালিয়ে যায়। সেই নীল খামার থেকে নীল খামারি আর বর্তমানে নীলফামারী নামের সার্থকতা লাভ করে। তাই জেলাবাসীর মুখে মুখে বহমান- ‘নীলখামারের নীল খামারি-নীল বিদ্রোহে আজ নীলফামারী।’
এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, বুড়িখোড়া নদী, বুড়ি তিস্তা, ইছামতি, চাঁড়ালকাটা, সর্বমঙ্গলা, যমুনাশ্বরী, সালকী, কুমলাইসহ অনেক নদ-নদী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জেলা শহরের উপকেন্দ্রে সর্বমঙ্গলা নদীর তীরে শাখা ও মাছা নামক দুটি বন্দর ছিল। সেগুলো থেকে নীলকরদের মালামাল আমদানি ও রফতানি হতো। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে জেলার ডিমলার বাগডোগরায় মহকুমার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে স্থানান্তর করে বর্তমান জেলা প্রশাসকের বাসভবন সংলগ্ন সুউচ্চ টিনের ভবনটিকে মহকুমা দফতর স্থাপন করা হয়। সেই সময় ২১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে নীলফামারী সদর থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কালের বিবর্তনে মহকুমা শহরে ১৯৬৮ সালে স্থাপিত করা হয় টাউন কমিটি। ১৯৮৩ সালে মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হয় নীলফামারী।
জানা যায়, দুই শতাধিক বছর পূর্বে এই অঞ্চলে নীল চাষের খামার স্থাপন করেন ইংরেজরা। এখানকার উর্বর মাটি নীল চাষের উপযোগী হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এ জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, টেঙ্গনমারী, রামনগর, বাঙালি পাড়া বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। সেই সময় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মধ্যে নীলফামারীতেই বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদিত হতো। উর্বর মাটির গুণে নীলকরদের ব্যাপক আগমন ঘটে এ অঞ্চলে।
প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে নীলকরদের নীলকুঠি দেখার জন্য দর্শনার্থীরা ভিড় করে। এখনও নীলগাছের ছবি তোলার জন্য নীলফামারী সার্কিট হাউস চত্বরে আসে অনেকে।
চিনি মসজিদ
চিনি মসজিদ। নাম শুনে মনে হতে পারে মসজিদটি চীনাদের তৈরি কিংবা এর নির্মাণের পেছনে চীনাদের কোনো অবদান আছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। মূলত পুরো মসজিদে রঙিন উজ্জ্বল চীনা মাটির পাথরের টুকরো দ্বারা চিনির দানার মতো নিখুঁত কাজ করা হয়েছে। এ কারণে মুসলিম স্থাপত্যের এই মসজিদটি ‘চিনি মসজিদ’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে যে কয়টি মসজিদ রয়েছে চিনি মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য হিসেবে চিনি মসজিদের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর শহরের পাশে এটি অবস্থিত। প্রতি শুক্রবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে আসেন জুমার নামাজ আদায় করতে।
ঐতিহাসিক এই মসজিদ নির্মাণের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। ১৮৮৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামে দুই ব্যক্তি সৈয়দপুরের ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। স্থানীয়দের সহযোগিতায় এটি টিনে রূপান্তরিত হয়। এরপর তারা একটি তহবিল গঠন করেন। এরপর শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।
কুন্দুপুকুর মাজার
নীলফামারী শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কুন্দুপকুর ইউনিয়নে অবস্থিত কুন্দুপুকুর মাজার। এ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা সুফি হযরত মীর মহিউদ্দিন চিশতির (র.) মাজার এটি। ৩০ একর জমি জুড়ে রয়েছে মাজার ও মাজার সংলগ্ন পুকুর। প্রতি বছরের ৫ মাঘ থেকে তিন দিন ওরশ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। জনশ্রুতি আছে, ওই পুকুরের পানি পান করলে মানুষ বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পায়। এজন্য সারাবছর বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ফিরনি এনে তবারক হিসেবে দেওয়া হয়।
ভীমের মায়ের চুলা
ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ভীমের মার আখাঁ (ভীমের মায়ের চুলা)। তিনদিক উঁচু মৃৎ-প্রাচীর বেষ্টিত স্থাপনার যার প্রাচীরের উপরের তিনটি স্থান অপেক্ষাকৃত উঁচু। ভিতরের অংশ গভীর এবং বাইরের তিনদিকে প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত পরিখা বেষ্টিত। প্রায় কয়েক’শ বছর আগে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে দ্বিতীয় ভীম এ জায়গাটিতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ভীমের মা কুন্তিদেবী যুদ্ধে অংশ নেয়া যোদ্ধাদের রান্নার জন্য তৈরি করেন একটি চুলা। এই চুলায় একসঙ্গে ১০ হাজার যোদ্ধাদের জন্য করা হতো রান্নাবান্না।
এর পূর্ব-দক্ষিণে একটি বাঁশবাড়ি রয়েছে। চুলার ব্যবহার্য জ্বালানি/খড়ির উদ্ধৃতাংশ এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্ধৃত বাঁশের মুড়া থেকে এ বাঁশ গজিঁয়ে উঠেছে। এর দক্ষিণ পাশে ‘মারগলা’ নদী হিসেবে প্রবাহিত। লোককাহিনী রয়েছে ভীমের এক সন্ধ্যার খাবারেই পরিবেশিত হয়েছিল ৭টি মহিষের ভর্তা। পরবর্তীতে ইতিহাসের স্বাক্ষী স্বরুপ বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এ চুলাটি দেখতে আসে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় দু’শ মিটার দূরে পুটিমারী ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামে অবস্থিত ভীমের মার আখাঁ। এটি তিনদিক থেকে উঁচু মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা। যার উপরের তিনটি তুলনামূলকভাবে উঁচু। এর ভেতরের অংশ গভীর এবং বাইরের তিনদিক প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত পরিখা বেষ্টিত। ফলে আবিস্কৃত স্থাপনাটি চুলার আকারে পরিদৃষ্ট হয়।
ধর্মপালের রাজবাড়ী
ধর্মপালের গড়ের কাছাকাছি একটি মজা জলাশয় রয়েছে, জলাশয়ের পাড় বাধানো ঘাট এবং কয়েক ফুট উচু ঢিবি রয়েছে, এই ঢিবির ভিতরের প্রাচীরে ইট দেখেই ধারণা করা হয় এটি ধর্মপালের রাজবাড়ি। গড় ধর্মপালের কাছাকাছি নদীর তীরে ধর্মপালের রাজ প্রাসাদ ছিল।
হরিশচন্দ্রের পাঠ
হরিশচন্দ্র পাঠ বাংলাদেশের নীলফামারীর জলঢাকার খুটামারা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। একে সেখানকার রাজা হরিশচন্দ্রের নাম অনুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয়। রাজা হরিশচন্দ্র দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ অঞ্চলে তাকে নিয়ে অনেক পালাগান, যাত্রাপালা রচিত হয়েছে। কথিত আছে রাজা হরিশ্চন্দ্রের কন্যা অধুনা’র সঙ্গে রাজা গোপী চন্দ্রের বিয়ে হয়। তৎকালীন প্রথা অনুসারে গোপী চন্দ্র দান হিসেবে তার ছোট শ্যালিকা পদুনাকেও পান। এ নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। হরিশচন্দ্র পাঠ গ্রামে অনেক প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আজও তার স্মৃতি বহন করছে। হরিশচন্দ্রের শিবমন্দিরে বছরে ৩টি উৎসব এই মন্দিরকে ঘিরে বেশ ধুমধাম করে পালিত হয়।
হরিশচন্দ্র পাঠ গ্রামে একটি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন স্থান রয়েছে। জায়গাটি দেখলে একটি মাটির স্তর বলে মনে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এ মাটির স্তরটি ৫০-৬০ ফুট উপরে ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে এর উচ্চতা কমে বর্তমানে ১০ ফুট এসেছে। এই স্থানটিতে রাজা হরিশচন্দ্র, একটি শিব মন্দির নির্মাণ করছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুতে মন্দিরের কাজ তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। তার এই অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার লক্ষ্যে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কথিত আছে, মন্দির কিংবা তার আশপাশে এক টুকরো মাটি, ইট বা পাথর স্পর্শ করতে পারে না। এ জায়গাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ইট বা পাথর। কিন্ত এক টুকরো ইট নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও শক্তি নেই। কারণ কোন ব্যক্তি ইট বা পাথর নিয়ে গেলে, তার নাক মুখ দিয়ে রক্তপাত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় বেশ বিষ্ণুমূর্তি সহ অসংখ্য মূতি ছিল বলে জানা যায়।
ব্রিটিশ সরকারের আমলে এখানে খননের জন্য ১২৫ জনকে নিয়োগও দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ছিলেন দেশি- বিদেশি বৈজ্ঞানিক, সেনাবাহিনী ও পুলিশ। দীর্ঘ সময় খনন কাজের পরে তৃতীয় দিন তারা একটি দরজার মুখ দেখতে পান। খুঁজে পাওয়া মন্দিরের দরজা দিয়ে কর্মরত ৮ ব্যক্তি ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু তারা ভিতরে ঢুকতেই মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এতে খননকারী দল ঘাবড়ে যায় এবং পরের দিন খননে কাজ বন্ধ করে চলে যায়। সেই ৮ জন ব্যক্তির ভাগ্যে কি ঘটে ছিল, তা আজও জানা যায়নি। তারপর থেকে এ মন্দিরের আর কোন সংস্কার কাজ করা হয়নি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা
নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর দেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহর অনেক আগে থেকে প্রসিদ্ধ হলেও অনেকের কাছে রেলের শহর হিসেবে বেশি পরিচিত। ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমির ওপর সৈয়দপুরে নির্মিত হয় দেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ রেল কারখানার ২৬টি উপ-কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। রেলের ছোট বড় যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনের বগি মেরামতসহ সব কাজ করা হয় এই কারখানায়। রেলওয়ে সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জনে দেশের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কারখানা পরিদর্শন করেন।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা জাদুঘর
২০২০ সালের ২৯ আগস্ট সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। এই জাদুঘরে ইংরেজ আমলে ব্যবহৃত প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ সহ বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি সংরক্ষিত রয়েছে।
ব্রিটিশ রানির শত বছরের বিলাসবহুল সেলুন কোচ
ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের ভারতবর্ষ ভ্রমণের জন্য ১৯২৭ সালে তৈরি হওয়া বিলাসবহুল ট্রেনের কোচ প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ শপে। সেখানে কিছু জিনিস মেরামত করে কোচটি সাধারণ মানুষ ও দর্শনার্থীদের জন্য নেওয়া হবে কারখানার নবনির্মিত জাদুঘরে। দেশভাগের পর বৃটিশ সরকার তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান রেলওয়েকে এই সেলুন কোচটি উপহার হিসেবে দিয়ে যায়। এরপর থেকে এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির জন্য সংরক্ষিত থাকায় এর নাম হয় রেলওয়ে প্রেসিডেন্ট সেলুন। দেশের প্রেসিডেন্টদের ট্রেন ভ্রমণের জন্য কোচটি বরাদ্দ রাখা হয়। তখন এটিকে রাষ্ট্রপতি সেলুন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনিই একমাত্র এই সেলুন ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৮১ সালে এটি চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়লে মেরামতের জন্য আনা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়।
কয়লাচালিত লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন
সৈয়দপুর রেল কারখানার প্রবেশ মুখে চোখে পড়বে বাংলাদেশে আসা প্রথম কয়লাচালিত লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনের। ইংল্যান্ডের ভলকান কোম্পানির তৈরি এই ইঞ্জিনসহ একই ধরনের তিনটি ইঞ্জিনের ঠাঁই হয়েছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার প্রদর্শনী ইয়ার্ডে। কারখানার দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়কের অফিসের সামনে সবুজ ঘাসের ওপর রাখা আছে ব্রিটিশ আমলের কয়লাচালিত এসব ইঞ্জিন। রেলের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই ইঞ্জিনগুলো।
যেভাবে যাবেন নীলফামারী
একটু আরামদায়ক ও ক্লান্তিহীন ভ্রমণ চাইলে ট্রেনই জুতসই। ঢাকা থেকে রেলপথে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে করে সৈয়দপুর বা নীলফামারী আসতে পারবেন। এরপর সড়ক পথে এসব দর্শনীয় স্থানে যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকার গাবতলী, উত্তরা, মহাখালী, কল্যাণপুর থেকে নীলফামারী বা সৈয়দপুর আসার জন্য এসি/ননএসি বাস সার্ভিস রয়েছে। এছাড়া আরামদায়ক এবং অল্প সময়ে উড়ালপথেও সৈয়দপুর আসতে পারেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেসরকারি সংস্থা ইউএস বাংলা এই রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে।
আরআর