সিকিম ভ্রমণ : রূপ-লাবণ্যে ভরপুর গ্যাংটক
সিকিম ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য। আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ। তিব্বত, ভুটান আর নেপাল বেষ্টিত এই প্রদেশের রাজধানী গ্যাংটক। পূর্ব হিমালয়ান রেঞ্জের শিবালিক পাহাড়ের ১৪৩৭ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই শহর।
সিকিম দর্শনের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি পৌছাতে আমাদের প্রায় দুদিন সময় লেগেছে। পোর্ট জটিলতার কারণে আমাদের একদিনের পরিবর্তে দুদিন লেগেছে বাই-রোডে।
বিজ্ঞাপন
দুপুরের তাপ মাড়িয়ে আমরা চেপে বসলাম রংপোগামী জিপে। রংপোকে বলা যায়, সিকিম প্রবেশের ইমিগ্রেশন। অর্থাৎ, ভারতীয় ছাড়া অন্য পর্যটকদের সিকিমে প্রবেশ করতে প্রয়োজন আলাদা অনুমোদন।
আমরা যখন রংপো বর্ডার পার হয়ে সিকিমে প্রবেশ করলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দু,দিনব্যাপী সিকিম জার্নির সব ক্লান্তি মুছে গেলো যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় আর হিমেল হাওয়া আমাদের স্বাগতম জানালো।
পাহাড়ের গায়ে উঁচু নিচু রাস্তা আপনাকে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি দেবে। পথে চলতে চলতে হঠাৎ করেই দেখা মিলবে স্বচ্ছ পানির
ঝর্ণাধারা। বিরতিহীন এই ঝর্ণাধারা সৃষ্টিকর্তার কী এক অপরূপ সৃষ্টি!
রংপো থেকে আড়াই ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা যখন সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে পৌঁছলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ১৪৩৭ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এ শহর আমাদের স্বাগতম জানালো বৃষ্টির মাধ্যমে। গ্যাংটকের বৃষ্টি অন্যরকম অনুভূতি দিলেও শরীরে জড়ানো ঘামে ভেজা টি শার্টটা আরও দুর্গন্ধ হয়ে যায়।
কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত মোটামুটি বাংলা চললেও সিকিমে বাংলা ভাষা বুঝার মানুষ একদমই কম। মুখ থেকে কোনোদিন বাংলা ছাড়া কোনো ভাষা বের হয়নি আমার, তবে এখানে এসে দু চারটা হিন্দি মিশ্রিত ইংরেজি ভাষা আওড়ালাম। না বলে উপায়ই বা কি? হিন্দি সিনেমা দেখে যা একটু শেখা!
গ্যাংটক শহরে এসে পড়লাম এক বিড়ম্বনায়। শহরে নেমে হোটেলে যাওয়ার ট্যাক্সি পেতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। শেষমেশ হোটেল অব্দি পৌঁছলাম রাত ৮ টায়। ততক্ষণ বাইরে পুরোদেমে বৃষ্টি।
হোটেল রুমে প্রবেশ করতে না করতেই হোটেল বয়ের বয়ান, (হিন্দিতে) স্যার, রাত ৮টা বাজে। মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত গিয়ে রাতের খাবার সেরে আসেন। আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেখানে, আগে থেকেই খাবার অর্ডার দিতে হয়। তবে আমরা সেটা করতে ভুলে গিয়েছি। সবকিছু যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
নিয়ম মেনে রাত আটটায় থেমে যায় গ্যাংটক শহরের কোলাহল। বন্ধ হয়ে যায় সব দোকানপাট। আর তখনই প্রকাশ পায় কোলাহল-মুক্ত সৌন্দর্যে ভরপুর এক নগরী। পাহাড়ের ঢালে ঢালে ছোট বড় বিল্ডিং আর মিট মিট করে জ্বলতে থাকা লাল হলুদ কিংবা নীল আলো মনে হবে আকাশ ভরা তারা। সুন্দর, পরিচ্ছন্ন আর শৃঙ্খল শহরের এমন উদাহরণ অন্তত আমার দেখা আর নেই।
গ্যাংটকের প্রথম সকাল ছিল কাব্য-গাঁথা এক সকাল। হোটেলের জানালা দিয়েই ধরা দিল এক রূপকথার আবেশ। ভোরে বারান্দায় এসে চোখ আটকে গেলো পাহাড় আর মেঘের মিতালি দেখে। সাদা মেঘ আপনাকেও ছুঁয়ে দিবে কখনো কখনো। মনে হতে পারে আপনি মেঘের রাজ্যেই বসবাস করছেন।
রাতের বৃষ্টিতে সব ধুয়ে মুছে এক শুভ্র সকাল হাজির হলো আমাদের সামনে। আর এভাবেই কোলাহলপূর্ণ হয়ে ওঠে গ্যাংটক। নিজেকে মেলে ধরে দেশ-বিদেশি পর্যটকদের কাছে।
সকাল সাড়ে আটটা বাজে আমরা নেমে পড়লাম সকালের নাস্তা সারতে। হোটেল বয়ের কাছ থেকেই জেনে নিলাম, গ্যাংটকের বিখ্যাত রোড এমজি মার্গ। আর সেখানেই মিলবে নানা খাবারের পসরা। আমাদের হোটেল থেকে এমজি মার্গ রোডে যেতে উঠতে হয় উঁচু এক পাহাড়।
রাতের এমজি মার্গ রোড আর সকালের এমজি মার্গ রোড যেনো ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্যের ডালপালা মেলে বসে থাকে। প্রথম সকালের গ্যাংটক সকালটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে স্মৃতির পাতায়।
সিকিমের অনেক টুরিস্ট স্পটে ঘুরেছি। আর ঘুরে ফিরে এই গ্যাংটককেই মনে হয়েছে সিকিমের আসল সৌন্দর্য। রূপে আর লাবণ্যে অটুট থাকুক গ্যাংটক নগরী।