বলা হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রতিবাদী চরিত্র হচ্ছে চাঁদ সওদাগর। চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিবের ভক্ত। এদিকে মনসা দেবী চেয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর তাকে পূজা করুক। কিন্তু চাঁদ সওদাগর মনসাকে পূজা করতে অস্বীকার করেন। ফলে মনসার রোষানলে একে একে হারায় তার সপ্ত-ডিঙ্গা এবং পুত্রদের। 

এরপরেও চাঁদ সওদাগর নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। শেষে পুত্র লখিন্দরের লোহার বাসরেও ছিদ্র খুঁজে পায় মনসার পাঠানো সাপ। এই কাহিনী তো প্রায় সকলেরই জানা। কীভাবে লখিন্দরের নবপরিণীতা বধূ বেহুলা ইন্দ্রের আসরে নেচে গেয়ে দেবতাদের তুষ্ট করে লখিন্দরের জীবন পুনরায় ফিরিয়ে আনে। সে কথা বলে আর কলেবর বাড়াবো না। এবার আসল কথায় আসা যাক। কেন ধান ভানতে  শিবের গীত তা পাঠক একটু সামনে আগালেই বুঝতে পারবেন। চলুন তাহলে যাওয়া যাক একসঙ্গে...

বন্ধুবর রাজনের গ্রামের বাড়ি হাওর খ্যাত নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার পনারপারুয়া গ্রামে। বন্ধুর বাড়িতে বেড়ানোও হবে, আবার এই সুযোগে সীমান্তবর্তী অঞ্চল পাঁচগাও দর্শনটাও হয়ে যাবে— এই লোভেই ব্যস্ততাকে পাশ কাঁটিয়ে শুক্র-শনিবারকে পুঁজি করে ময়মনসিংহ থেকে রওনা হয়ে গেলাম। 

পনারপারুয়ায় রাত্রিযাপন করে পরদিন সকালের নাস্তা সেরেই পনারপারুয়া থেকে মোটরসাইকেলে আমরা, অর্থাৎ আমাদের মেজবান রাজন, আমার আরেক ভ্রমণসঙ্গী সাজেদ এবং আমি যাত্রা শুরু করলাম। সুন্দর আঁকাবাঁকা পিচের কালো রাস্তা। দু’পাশে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। 

ধানক্ষেত, মাছের খামার; এসব পেরিয়ে দৃষ্টি চলে যায় দূরের আকাশে। দেখতে অনেকটা ছবির আঁকা গ্রামের ল্যান্ডস্কেপের মতো দৃশ্য। চলতে চলতে আমরা পাই পাবই বাজার। পাবই বাজারে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি। খাঁটি গরুর দুধের দুধ চা খেয়ে ফের যাত্রা শুরু।

এরপর সামনে পাই গুতুরা বাজার। গুতুরা বাজার থেকে কলমাকান্দা যাওয়ার পথে বাঁপাশে বিশাল মহিষাউড়া হাওর আর ডানপাশে স্বল্প প্রস্থ উব্দাখালি নদী। মহিষাউড়া হাওরের দিকে তাকিয়ে কোন কূল-কিনারা দেখতে পেলাম না। এটা সম্ভবত সুনামগঞ্জের হাওর বেল্টের অংশ। কলমাকান্দা থেকে ডাইয়ার বাজার যাওয়ার পথে বাঁপাশে পেলাম সোনা ডুবি হাওর। ডাইয়ার বাজারকে পিছনে ফেলে আমরা চলে আসলাম পাঁচগাও— আমাদের অভীষ্ট গন্তব্য।

পাঁচগাও বাজারের যেখানে এসে পিচের রাস্তা শেষ হয়ে গেছে, সেখান থেকে বামে মোড় নিলাম কাঁচা রাস্তা ধরে। বিজিবি ক্যাম্পকে ডানে রেখে একটু এগিয়েই ব্রিজের আগের রাস্তা দিয়ে আমরা বাইক নিয়ে নেমে গেলাম। গন্তব্য চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে ম্রো নৃগোষ্ঠীদের বসবাস। 

এখানে সুবিমল ম্রো নামে একজন ম্রো ভাই মোটরবাইক পার্কিং এর ব্যবস্থা করে রেখেছে। প্রতি বাইক বিশ টাকা। ওখানে গিয়ে জানলাম সামনেই বাংলাদেশ বর্ডারের ভিতর কয়েকজন বিএসএফ জওয়ান টহল দিতে দিতে ঢুকেছে। পার্কিং এর পাশে ছোট্ট একটা টং দোকানের সামনে পরিচয় হলো আব্দুল বারেক পাগলের সঙ্গে। আব্দুল বারেক পাগল একতারা বাজিয়ে গান করেন। তার পোষা একটি ঘোড়া আছে। ঘোড়াটির নাম পরী। আমরা বারেক পাগলের সঙ্গে তার ঘোড়া সহ চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়ের দিকে রওনা হলাম।

কিছু দূর এগুতেই বিএসএফ এর ঐ জওয়ানদের সঙ্গে দেখা হলো। ওরা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে আছে। বারেক পাগলকে অনুরোধ করলো একটা গান শোনাতে। আব্দুল বারেক একতারায় টুং টাং করে 'খাজা বাবা খাজা বাবা' গান ধরল। গান শেষে বিএসএফ তাদের পথে চলে গেলো, আমরা চন্দ্রডিঙ্গার নীচে প্রাচীন বটগাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের পথ প্রদর্শক আব্দুল বারেক পাগল ও তার ঘোড়া পরী।

চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়ের আকৃতি অনেকটা নৌকার মতো। বৈঠা সদৃশ বিরাট একটা পাথরের চাঁই ও আছে। তো এই পাহাড়ের নাম চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড় কেন? এইবার ফিরে যেতে হয় এই ভ্রমণকাহিনীর শুরুর দিকে।
 
সেই বিখ্যাত প্রতিবাদী চরিত্র চাঁদ সদাগরের ডিঙ্গার নামে এই পাহাড়ের নাম চন্দ্রডিঙ্গা। পাহাড়ের সামনেই একটা প্রাচীন বটবৃক্ষ তার। আমরা বট গাছের ছায়ায় বসে আব্দুল বারেক পাগলার গান উপভোগ করলাম। বারেক পাগল আমাকে ডেকে বললেন, তিনি আমাকে কিছু দিতে চান। আমি কাছে গেলে কোমরের থলে থেকে একটা সুরমাদানি বের করে আমার দু'চোখে সুরমা লাগিয়ে দিলেন। এই সুরমা নাকি তিনি আজমির থেকে এনেছেন। 'ভাবের লোক' পান না। আমাকে নাকি তার কাছে 'ভাবের লোক' মনে হয়েছে। তাই এই সুরমা-ভালোবাসা। 

বারেক পাগলকে রেখে আমরা আরও ভেতরে রওনা হলাম। চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়ের যে অংশটুকু ভারতের মধ্যে, সেখানে একটা ঝর্ণা আছে। আমরা ট্র্যাকিং করে করে সেই ঝর্ণা পর্যন্ত গেলাম। সুশীতল পানি! কলমাকান্দার জুলহাস ভাইয়ের ভাষায়, 'ফানি বরাকের (বরফের) মতো টান্ডা'। 

আমরা 'বরাকের মতো টান্ডা' ঝর্ণা জলে গা ভেজালাম। ভেজা গায়েই তীব্র রোদে পুড়তে পুড়তে ফিরে এলাম পনারপারুয়া গ্রামে। আর স্মৃতির উজানে রেখে দিলাম চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়ে ভ্রমণের কথকতা।

লেখক- সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ।