কাশ্মির ভ্রমণ : কী দেখবেন, যা খাবেন
কাশ্মির বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে উঁচু নিচু পাহাড়, ছুটে চলা স্রোতস্বিনী ঝিলাম আর লিডারের কলকল আওয়াজ। সবুজে ঘিরে থাকা চিনার, পাইনসহ অসংখ্য নাম না জানা গাছপালা। হঠাৎ রাস্তায় ছুটে চলা ঘোড়ার পাল কিংবা ভেড়ার দলগত মডেলিং, আপেল গাছে ঝুলতে থাকা লাল সবুজের মিশ্রিত ছোট বড় অনেক আপেল।
কাশ্মির মানেই জাফরানে আচ্ছাদিত মন মাতানো বেগুনী মাঠ, যেখানে দাঁড়ালে জ্ঞান হারাবেন জেগে থেকেও। কাশ্মির যেনো তার উষ্ণতার চাদরে আপনাকে জড়িয়ে সিক্ত করবে। আটকে যাবেন মায়ার এক অদ্ভুত বন্ধনেও। সঙ্গে বাহারী রংয়ের পাশমিনা শাল যেনো আপনার উষ্ণতাকে বহু গুণে বাড়িয়ে দেবে।
কাশ্মিরের আনাচে কানাচে রয়েছে নানা ধরনের স্ট্রীট ফুড। যেমন, কয়েক রকম স্বাদের কাবাব, তেমন রয়েছে ফলের সু-স্বাদু সতেজ জুস।
বিজ্ঞাপন
‘গোলাপজামুন’ কি জিনিস তা অজানাই রয়ে যাবে যদি এখানে এসে তার স্বাদ না গ্রহণ করেন। গরম সিরাতে ডুবানো গোলাপজাম আপনাকে নিয়ে যাবে কল্পনার রাজ্যে, মোঘল রাজার দরবারে।
কিছুক্ষণ পর পরই দেখা যাবে চেরির বাগান তেমনি পাবেন নানা ধরনের আখরোট, বাদামসহ ড্রাই ফ্রুটস। ভোজন রসিক না হলেও, কাশ্মিরের বিখ্যাত ওয়াজওয়ানসহ হালুয়া পরোটা এড়ানো সম্ভব নয়।
মজার বিষয় হলো, কাশ্মির শীতপ্রধান অঞ্চল হওয়ার পরেও নানা স্বাদের আইসক্রিমের উপস্থিতি মিলবে। আইসক্রিমগুলো খেতে যেমন মজা ঠিক তেমন হাতের নাগালে দাম। আপনি বুড়ো হোন কিংবা বাচ্চা- একটা আইসক্রিম দিন শেষে আপনার মুখে হাসি এনেই দেবেই।
আপনি কাশ্মিরে কাউকে চিনেন না? কোন সমস্যা নাই, কাশ্মিরের অতিথি পরায়ণ মানুষগুলা আপনাকে নিজ দায়িত্বে চিনিয়ে দেবে। তাদের সুমিষ্ট কথা এবং অমায়িক ব্যবহার দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার মনে একটা চির-চেনা জায়গা বানিয়ে ফেলবে। কাশ্মিরে সহসা সূর্য ডুবতে চায় না। এখানে সন্ধ্যা নামে আটটার পরে।
ঝিলাম নদী আর ডাল লেক যেমন শান্ত আর ভদ্র ভাবে বয়ে চলা এক পথের পথিক ঠিক তেমনি সিন্দ নদী এবং লিডার নদী যেনো তার বিপরীত। দূর্বার গতিতে, স্রোতের উচ্চতায় সাদা সাদা ফেনা তুলে চলে নদী দুটো। যেদিকেই তাকবেন, মুগ্ধতা চাদর আপনার গায়ে লাগবেই। মুগ্ধ নয়নে তৃপ্তির ঠেকুর নেওয়ার আগেই ফুরিয়ে যাবে ভ্রমণের সময়। কিন্তু চোখে মুখে থেকে যাবে এক ভয়ঙ্কর লোভ। কাশ্মির থেকে যাওয়ার লোভ।
কাশ্মির এলে এক শ্রেণির মানুষের দেখা মিলবে, যাদের আয় ট্যুরিজম ঘিরেই। বছরের প্রায় ছয় মাসই বরফের কারণ আটকা থাকে ঘরের ভিতর।
ভবিষ্যতে কাশ্মির ভ্রমণে যারা যাবেন তাদের জন্যে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু বিষয় শেয়ার করা যাক-
১। আমি এয়ারে গিয়েছিলাম। আপনিও যদি এয়ারে যান, তবে চেষ্টা করবেন টিকিট অন্তত ২ থেকে ৩ মাস আগে বুকিং করতে। জানি এটা রিস্কি, কিন্তু কম মূল্যে টিকিট পেতে চাইলে আর কোনো অপশন নেই। আমরা ঢাকা থেকে কলকাতা। তারপর কলকাতা থেকে শ্রীনগর এয়ারে গিয়েছে। আমরা তিন জন গিয়েছিলাম। থাকা খাওয়ার প্যাকেজ পড়েছিল ৬৫ হাজার টাকা।
২। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট ৫-১০ কপি করে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করবেন। কাশ্মিরের বিভিন্ন জায়গায় এগুলো দেখতে চায়।
৩। ভ্রমণে যদি বাচ্চা থাকে তার জন্যে প্রয়োজনীয় সব কিছু সঙ্গে রাখবেন। বিশেষ গরম কাপড়। তাছাড়া বাচ্চার জন্যে দুধটা অবশ্যই সঙ্গে নেবেন। আমরা পুরো এক টিন নিয়েছিলাম, তারপরেও যখন মেয়ের দুধ শেষ হয়ে গিয়েছিলো, প্রায় ১০ টার মতো দোকান ঘুরেও দুধ পাইনি।
৪। অবশ্যই প্রয়োজনীয় মেডিসিন সঙ্গে নেবেন। কাশ্মিরে মোড়ে মোড়ে ফার্মাসি নেই। থাকলেও প্রেসক্রিপশন ছাড়া মেডিসিন পাওয়া খুব কষ্ট।
৫। আমার দেখা ‘ওয়ান অফ দ্যা টাফেস্ট চেকিং পয়েন্ট’ হচ্ছে কাশ্মির এয়ারপোর্ট। তাই কী নেওয়া যাবে আর কী নেওয়া যাবেনা সেসব বিষয়ে পরিস্কার ধারণা রাখুন। যেদিন চেক আউট করবেন হাতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা সময় রাখবেন। কারণ এয়ারপোর্টের চেকিংয়ে অনেক সময় লাগায়।
সাইড ব্যাগে কোনো ভাবেই খাদ্র দ্রব্য জাতীয় কোনো কিছু বহন করবেন না। ছাতা সাইড ব্যাগে রাখবেন না কিংবা কৌটা বা টিন জাতীয় কিছু রাখবেন না।
৬। পাওয়ার ব্যাংক থাকলে অবশ্যই লাগেজ থেকে বের করে সাইড ব্যাগে রাখবেন। ওজনটা অবশ্যই আন্দাজে মেপে নিবেন, তারা অতিরিক্ত ওজনের ব্যাপারে বেশ সতর্ক। অতিরিক্ত ওজনের ক্ষেত্রে চার্জ তো ধরেই, আবার ঝামেলাও পোহাতে হয়।
৭। কাশ্মির যাওয়ার আগে হিন্দী ভাষাটা টুকটাক জেনে বা শিখে যাবেন, আপনারই সুবিধা হবে। কাশ্মিরে আমাদের বেশি সমস্যা হয়েছে ভাষা নিয়ে। তারা ইংরেজি ভাষা বুঝেই না। নিজস্ব ভাষা কিংবা হিন্দী ভাষায় কথা বলে। আপনার কাছ থেকেও সেই ভাষাতেই শুনতে চাইবে।
৮। কাশ্মিরের আবহাওয়ার মতো অস্থির আবহাওয়া আপনি আর কোথাও পাবেন না। সকাল বেলার খটমটে রোদ দেখে যেমন আফসোস করবেন, ইস অযথাই কেনো ঠান্ডার কাপড় আনলাম? ঠিক তেমনি হুট করে নামা বৃষ্টির কারণে কনকনে ঠান্ডা বাতাসে মনে হবে- ব্র্যাভো, ভাগ্যিস ঠান্ডার কাপড় এনেছিলাম।
৯। সোনমার্গ এবং গুলমার্গে যাওয়ার আগে অবশ্যই কেডস পরে যাবেন। সঙ্গে জ্যাকেট তো নেবেনই।
১০। ড্রাইভাররা হচ্ছে কাশ্মিরের সবচেয়ে বড় দালাল। সরি, এইভাবে লেখার জন্য। কিন্তু এইটাই সত্যি। তারাই আপনাকে কিছুক্ষণ পর পর তাদের পরিচিত দোকানে নিয়ে যেতে চাইবে ড্রাই ফ্রুটস, স্যাফরন আর শাল কেনার জন্যে। সেটা আপনি যেতেই পারেন, কিন্তু তাদের কথার ফাঁদে পরবেন না। দেখে শুনে বুঝে কিনবেন।
১১। গুলমার্গে যদি গান্ডুলাতে উঠার প্ল্যান থাকে অবশ্যই দুই তিন দিন আগে অনলাইনে টিকিট কেটে নিবেন। নাহলে লাইন ধরে কাটতে গেলে তিন ঘণ্টা লেগে যাবে। সামারে আসলে গান্ডুলা ওয়ানে তেমন কিছু দেখার নাই, সো গান্ডুলা টু তে অবশ্যই যাবেন। সেখানেই বরফের দেখা মিলবে এবং রাইডও পাবেন।
১২। পানিরাইড থেকে শুরু করে স্কেজিং সব কিছুতেই আপনাকে বার্গেনিংয়ে পটু থাকতে হবে। তারা যা বলবে আপনি তার অর্ধেক থেকে বলা শুরু করবেন। অনেকটা আমাদের নিউমার্কেটের মতো, এছাড়া উপায় নাই। তারা ওখানে একটা সিন্ডিকেট করে রাখে।
১৩। যারা ছবি তোলে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকুন, আমাদের কক্সবাজারের মতো ৫ টা ছবি তোলার কথা বলে অনেক গুলো তুলে দেয় এবং চার্জ করে। নিজের মোবাইলে বা ক্যামেরাতেই তুলবেন। আর যদি তাদের ভাড়াও নেন, শর্তগুলো আগেই জেনে নিন, তারা কথাতে বেশ ফাঁক রাখেন।
১৪। দয়া করে না বুঝেই সব খাবার অর্ডার করে বসবেন না, সব খাবারের টেস্ট কিন্তু ভালো না। আমরা সেখানে খাবার নিয়ে বেশ চুজি ছিলাম। তারা খাবারে ভীষণ মশলা আর তেল ব্যবহার করে। যেটা পেটে বেশ ঝামেলা পাকায়। তবে স্ট্রীট ফুড অবশ্যই খাবেন, বিশেষ করে একদম ফ্রেশ জুশ আর কাবাব।
১৫। কিছু খান বা না খান গুলাবজামুন অবশ্যই খাবেন। এইটা আমার পার্সোনাল অবজারভেশন থেকে সাজেশন। একদম মুখে লেগে থাকবে। আর হ্যাঁ, দরগার সামনে থেকে হালুয়া আর পরোটা- এইটা না খেলে কাশ্মির যাওয়া বৃথা! আমি ওয়াজওয়ানের কথা বলবোনা, কারণ এটা হাইপড খাবার। আমার কাছে ভালো লাগেনি।
১৪। সঙ্গে যথেষ্ট রুপি রাখুন। রুপি নিয়ে আমদের সমস্যা হয়েছে। কলকাতা থেকে রুপি নেইনি। ডলার রেখেছিলাম সঙ্গে। ভেবেছিলাম শ্রীনগরে মানি এক্সচেঞ্জ পাবো। কিন্তু একদম হতাশ হয়েছি। ওদের মানি এক্সচেঞ্জ শপ নেই বললেই চলে।
আরো ও ভয়াভহ দিক হচ্ছে, ওদের ওখানে প্রায় সব শপেই ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড অকেজো, যার কারণে পেমেন্ট করতে যেয়ে খুব ঝামেলা হয়েছে।
১৭। দিনের বেলায় অবশ্যই সানস্ক্রিন মেখে বের হবেন, সানগ্লাস আর ক্যাপ থাকলে আরো ও ভালো। স্কিন পুরো বার্ণ হয়। মাঝে মাঝেই নাকের রক্ত জমাট বেধে যায়। আমরা সামারে গিয়েছি তাতেই এই অবস্থা, যারা উইন্টারে যাবেন এই বার বুঝে নেন অবস্থা।
১৮। যারা ঘুরতে যাবেন, অবশ্যই চেষ্টা করবেন জায়গাটার সম্পর্কে মিনিমাম একটা ধারণা রাখতে। যেহেতু ভীনদেশ তাই আপনার আচরণ যেনো আপনার পরিচয় বহন করে সেদিক টাও খেয়াল রাখবেন। যেখানে সেখানে প্লিজ ময়লা ফেলবেন না, লাগলে নিজের পকেট বা ব্যাগে করে সেই ওয়েস্টেজ নিয়ে আসুন।
১৯। যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলবেন না। কাশ্মির একটা সেনাবাহিনী অধ্যুষিত রাজ্য, তাই ছবি তোলার আগে জেনে নিন সেই সব জায়গাতে ছবি তোলার পারমিশন আছে কিনা। নাহলে অযথা তাদের রোষানলে পরতে হবে।
২০। ঘুরতে যেয়ে যখন তখন সেনাবাহিনীর তল্লাশীর সামনে পরতে পারেন তাই পাসপোর্ট সহ অন্যান্য সব ডকুমেন্টস সাথে রাখুন, এবং যেটা জিজ্ঞাসা করবে অন পয়েন্ট উত্তর দিন।
২১। আপনি যেখানেই যাবেন সেখানেই দেখবেন সব বিক্রেতা এসেই বলবে - এইটা অরিজিনাল পাশ্মিনা। মোটেও তা নয়, অরিজিনাল পাশ্মিনা যদি কিনতেই চান তবে সেইটা গুল্মার্গ যাওয়ার পথে অথেনটিক শপ থেকে কিনুন। এগুলার ১০ হাজার রুপি থেকে, সর্বোচ্চ ৮০-৯০ হাজার রুপির মধ্যে পাওয়া যা।
২২। জাফরান কিনতে চাইলে পেহেলগাম যাওয়ার পথের শপ গুলা ভালো। জায়গাটার নাম প্যাম্পোর, সেখানে জাফরানের বিশাল বিশাল ক্ষেত রয়েছে আর রাস্তার দুই ধার জুড়ে অনেক দোকান। সেখান থেকেই বুঝে শুনে দেখে কিনবেন।
২৩। ডাললেক থেকে চেষ্টা করবেন কোনো কিছু না কিনতে। অনেক বেশি দাম হাঁকায় তারা।আপনি সুলভ মূল্যে পেয়ে যাবেন লালচকে, যেটা শ্রীনগরের প্রায় মূল কেন্দ্রে অবস্থিত।
২৪। কাশ্মির ছোট ছিমছাম একটা রাজ্য, যেখানের মানুষগুলো শান্তি প্রিয়। বেশ অতিথিপরায়নও। চেষ্টা করবেন তাদের সঙ্গে মিশে যেতে, তাদের মতো করেই। দেখবেন কাশ্মিরকে নিজের দেশের মতোই ভালো লাগা শুরু করবেন।
আরেকটা কথা, আমরা কাশ্মিরে গিয়ে কোনো সিম কিনি নাই। আর কাশ্মিরে অন্য রাজ্য মানে কলকাতা বা দিল্লীর সিম ও চলবেনা। তারা ওদের নিজস্ব সিম ব্যবহার করে। হোটেলে উঠলে ওয়াইফাই তো পাবেনই। তাই অযথা সিম না কিনলেও চলবে, আবার কেউ যদি কিনতে চান সমস্যা নেই, কিনে নিতে পারেন, ইটস আপ টু ইউ। হ্যাপি ট্রাভেলিং।