শিগগিরই বিদেশে যাবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা নোকিয়া ফোন
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩৫৫ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলা বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এখানে ৭০টি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ১২০.৭৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। হাইটেক সিটির বিষয়ে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এমন আগ্রহ স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। স্বপ্নের ডানায় নতুন পালক যুক্ত করেছে বিশ্বের নামকরা সেলফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানি নোকিয়া। তারা সেখানে তৈরি করছে মোবাইল ফোন আর সেগুলোর গায়ে লেখা থাকছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’!
কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির নোকিয়া ভবনে চলছে তাদের ফোন সেট অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজ। হাইটেক সিটিতে নোকিয়ার মতো ফোন কোম্পানির ভবন দেখলে যে কারও মনে হতে পারে এটি বাংলাদেশ নয়, উন্নত কোনো দেশ। এই ভবনটি হাইটেক সিটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়েছে। নোকিয়া মোবাইল ফোনগুলো এই কারখানা থেকে এতদিন অ্যাসেম্বলিং করা হচ্ছিল। শিগগিরই ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা ফোন সেট রফতানির চিন্তা করছে কোম্পানিটি। ফলে কিছুদিন পর থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যদেশেও নোকিয়া ফোনের গায়ে লেখা থাকবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ।’
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির বিভিন্ন ব্লকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেকেই অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। নোকিয়া ইতোমধ্যে কারখানা নির্মাণের পর তাদের অ্যাসেম্বলিং কার্যক্রম চলমান রেখেছে। বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির ৫ নম্বর ব্লকে পাঁচ একর জমি বরাদ্দ নিয়ে তারা কারখানা গড়ে তুলেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার ও বাংলাদেশের ইউনিয়ন গ্রুপের জয়েন্ট ভেঞ্চার ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার বিডি লিমিটেড নোকিয়া মোবাইল ফোন উৎপাদন করছে এখানে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে নোকিয়া কারখানার দায়িত্বে থাকা কোম্পানিটির জেনারেল ম্যানেজার নওয়াব হাসান বলেন, বর্তমানে এখানে প্রতিমাসে তিন লাখ ফোন উৎপাদন করা সম্ভব। আমরা এ উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছি। আশা রাখছি, আগামী বছরের শুরু থেকে আমরা প্রতি মাসে ৬ লাখ ফোন উৎপাদন করতে পারব। বর্তমানে এখানে নোকিয়া স্মার্টফোন এবং ফিচার ফোন উৎপাদন শুরু করেছি। নোকিয়া টেলিভিশন ও ট্যাবসহ যেসব আইটি প্রোডাক্ট আছে সেগুলো আগামী বছরের শুরু থেকে উৎপাদন করব। এখানে আপাতত মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য পণ্য অ্যাসেম্বলিং করছি। এখান থেকে দ্রুতই পণ্য তৈরি করা হবে। আগামী বছরের এপ্রিল-মের মধ্যে এখান থেকে পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে নোকিয়া ফোনের যে চাহিদা তা এখানেই উৎপাদন করছি। ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারের জন্য ফোন তৈরি করা হবে। আমরা আশা করছি, সরকারের যে নীতিমালা আছে সেগুলো আমাদের পক্ষে থাকলে আগামী বছর থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করতে পারব।
নওয়াব হাসান বলেন, বর্তমানে আমাদের এখানে ৩ শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। তবে চাহিদার কারণে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এ সংখ্যা ৬ শতাধিক হবে। মেইড ইন বাংলাদেশের ফোনগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুবিধা আছে, সে কারণে ইমপোর্টের খরচ অনেকটা কমে যাবে। আর এ সুবিধা আমাদের ক্রেতারা পাবেন।
জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানিটির ম্যানেজার (অপারেশন) জুয়েল রানা বলেন, হাইটেক পার্কে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশি বিনিয়োগ সমৃদ্ধ করা। তাই আমরা এখানে এসেছি। এখানে শুধুমাত্র ইন্ডাস্ট্রি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউশন করা একটা বড় ইস্যু। আমাদের এটা জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি। এখানে ফরেন ইনভেস্ট আছে দেশি ইনভেস্টমেন্টও আছে। বাংলাদেশ সরকার যেসব সুবিধা দিচ্ছে তাতে আরও অনেক কোম্পানিই এ হাইটেক পার্কে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আগে আমরা ফোন কেনার পর দেখতাম, ফোনটি কোথাকার তৈরি। এখন ফোনগুলোতে গর্বের সঙ্গে লিখতে পারি মেইড ইন বাংলাদেশ। আমাদের এই নোকিয়া ফোনগুলো বাংলাদেশে অ্যাসেম্বেল করতে পেরে প্রাউডলি লিখতে পারি মেইড ইন বাংলাদেশ। আমরা আপাতত বাংলাদেশের মার্কেটটা কভার করছি। এক্সপোর্ট করার জন্য যা প্রসিডিউর তা নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে, কয়েটি দেশে আমরা আমাদের ফোন রফতানি করব। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। এখানে যে ফোনগুলো আমরা উৎপাদন করছি, সবফোনের বাক্সে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা থাকছে।
এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমাদের এখানে অ্যাসেম্বলিং দিয়ে শুরু হয়েছে। স্যামস্যাং, নোকিয়া, শাওমির মতো কোম্পানিগুলো এসেছে। আমরা চাই বিশ্বের আরও বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আসুক। হাইটেক পার্কে তারা তাদের ফ্যাক্টরি সেটআপ করুক। একইভাবে চাই বাংলাদেশের ওয়ালটন, সিম্ফনিসহ অন্যরাও সারা বিশ্বের বাজার দখল করুক।
তিনি আরও বলেন, হাইটেক সিটিতে নোকিয়া ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে, প্রোডাকশনে গেছে, তারা এখানে ফোন তৈরি করছে। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই গর্বের। তাই লন্ডনের মাটিতে আমি মেইড ইন বাংলাদেশ ফোনের ব্র্যান্ডিং করে আসতে পেরেছি। কিন্তু এ গল্পটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। ২০১৫ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী বললেন আমরা ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনকারী দেশ থেকে রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিণত হতে চাই। তখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এনআরবি, প্রাইভেট সেক্টর লিডার, ভিয়েতনাম, চায়না, জাপান, সাউথ কোরিয়াসহ যে দেশগুলো ২০ থেকে ৫০ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিণত হয়েছে, তাদের পলিসিগুলো আমরা স্টাডি করতে থাকলাম। উদ্যোগ নিলো বর্তমান সরকার। এরপর থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সূত্রপাত হলো।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে আরও কার্যক্রম শুরু করেছে যারা
৩৫৫ একরের বিশাল এ পার্কে ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের মধ্যে বাংলাট্রনিক্স টেকনোলজি লিমিটেড, কেমান ইন্দো বাংলা ক্যাবল প্রাইভেট লিমিটেড, সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, লেভেল ৩ ক্যারিয়ার লিমিটেড, ডাটা সফট সিস্টেম লিমিটেড, বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড, ডেল্টা ইনস্টিটিউট লিমিটেড, রেডডট ডিজিটাল লিমিটেড, ভাইব্রেন্ট সফটওয়্যার লিমিটেড, কোয়ার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড, সার্ব রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি লিমিটেড, বন্ডেস্টাইন টেকনোলজি লিমিটেড, ফেলিসিটি আইডিসি লিমিটেড ও লিও আইসিটি কেবলস লিমিটেড উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ হাইটেক পার্কে দেশি-বিদেশি ৪০টি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্রুতই অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ হাইটেক পার্কে দেশি-বিদেশি ৪০টি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্রুতই অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে।
বাংলাদেশ হাইটেক পার্কের প্রকল্প পরিচালক ও অথরিটি এমডির রুটিন দায়িত্ব পালন করা সৈয়দ জহুরুল ইসলাম (যুগ্ম সচিব) বলেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য হাইটেক পার্কগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। একটা জমিতে ইন্ডাস্ট্রি করতে রেজিস্ট্রেশন, বিদ্যুৎ, গ্যাস পানিসহ যা যা সুবিধা লাগে সবই আমরা দিচ্ছি।
হাইটেক পার্ক অথরিটির আরেক প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এ এন এম শফিকুল ইসলাম বলেন, হাইটেক তথা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি অর্জন ত্বরান্বিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক এ শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
উল্লেখ্য, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা ছিল। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ক্ষমতায় এসে সরকার দেশে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও আইটি সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এমন অনেক উদ্যোগ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান, বাকিগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে।
এএসএস/এসকেডি/জেএস