ফেসবুকে বিক্রি হচ্ছে অ্যামাজন বন!
ফেসবুকের মাধ্যমে একাধিক মহল অবৈধভাবে ব্রাজিলের অ্যামাজনের কিছু অঞ্চল বিক্রি করেছে। শুক্রবার বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। সেখানে স্থানীয় আদিবাসীরা বসবাস করায় অঞ্চলটি জাতীয়ভাবে সংরক্ষিত ছিল।
সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক বলছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারা কাজ করতে প্রস্তুত। তবে বিক্রি বন্ধ করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রযুক্তি সংস্থাটি বলছে, ‘আমাদের ব্যবসায়িক নীতিমালা হচ্ছে ক্রেতা ও বিক্রেতারা আইন ও রেগুলেশন মেনে চলবে।’
বিজ্ঞাপন
অঞ্চলটির আদিবাসী গ্রুপের নেতা ফেসবুককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আর্জি জানিয়েছেন। তবে ফেসবুক দাবি করছে, দেশটির সরকার অঞ্চলটি বিক্রি ঠেকাতে অনিচ্ছুক। কানিন্ডের পরিবেশ বিষয়ক প্রধান ইভানিডে বান্ডেইরা বলেন, ‘ভূমিদস্যুরা এতই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে তারা ফেসবুকের সঙ্গে অবৈধ ভূমি বিক্রি করতে লজ্জা পাচ্ছে না।’
সনদ নেই
অবৈধভাবে বনভূমি দখলের বিষয়টি ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস টুলে ফরেস্ট, নেটিভ জঙ্গল, টিম্বার সার্চ করে দেখা যাচ্ছে ও লোকেশন হিসেবে অ্যামাজন অঞ্চলের কোনো স্থানের নাম লিখলে সহজেই এই বিষয়ে জানা যায়। এছাড়া ফিচার স্যাটেলাইট ছবি ও জিপিএসে অঞ্চলটির কিছু ছবি দেখা যায়।
‘ঝুঁকি নেই’
ব্রাজিলের অ্যামাজনে বনভূমি উজাড়করণ প্রক্রিয়া ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ও হিডেন ক্যামেরার মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালনাকারী ফেব্রিসিও গুইমারাইসের মতো অন্যান্য বিক্রেতা ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করে বনভূমি বিক্রি করে দিচ্ছে। ফেব্রিসিও গুইমারাইস বলেন, ‘সরকারি এজেন্টের পরিদর্শনে কোনো ঝুঁকি নেই।’
গোপন অনুসন্ধান
বেশিরভাগ অ্যাড এসেছে রন্ডোনিয়া থেকে। ব্রাজিলের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে সবচেয়ে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। অঞ্চলটির ৪ জন বিক্রেতার সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম আলভিম সওজা আলভস উরু ইউ ওয়াউ ওয়াউ আদিবাসীদের অঞ্চল স্থানীয় ১৬ হাজার ৪০০ পাউন্ডে বিক্রির চেষ্টা করছেন। অঞ্চলটিতে অন্তত ২ শতাধিক উরু ইউ ওয়াউ ওয়াউ আদিবাসীরা বসবাস করে এবং ব্রাজিলের সরকারি তথ্য অনুযায়ী তাদের মধ্যে এমন ৫টি দল রয়েছে যাদের সঙ্গে বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু বিবিসির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আলভস বলেন, ‘আমার ভূমি ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং এখানে কোনো ভারতীয় নেই। আর আমি আপনাকে এ কথা বলতে চাই না যে তারা একসময় সেখানে বসবাস করতো।’
তবে উরু ইউ ওয়াউ ওয়াউ আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতার সঙ্গে ফেসবুক অ্যাড সম্পর্কে বিবিসি কথা বলেছে। তিনি বলেন, পশু শিকার, মাছ শিকার ও ফল চাষ করে বেঁচে থাকে তার অঞ্চলের মানুষ। বনভূমি বিক্রির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবের কারণে এটি করা হচ্ছে। যারা বনভূমি বিক্রি করতে চাইছে তাদেরকে আমি চিনি না। আমি মনে করি তাদের উদ্দেশ্য বনভূমি উজাড় করিা এবং বলতে পারেন আমাদের জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলা।’
তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের অবশ্যই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত এবং ‘বহুল ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম’ ফেসবুককেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
পরিবর্তিত অবস্থা
আলভস বলেন, অবৈধ ভূমিকে বৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে ব্রাজিলের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের সঙ্গে লবিং করার চেষ্টা করছেন তিনি। ব্রাজিলের ক্ষমতাসীন সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাকে একটি সত্য কথা বলতে চাই যদি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সমস্যাটির সমাধান না হয় তাহলে কোথাও এর সমাধান হবে না।’ বনভূমি উজাড়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে বৈধ করে নেয়া হয়। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে বনভূমি কেনা হয়।
বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদককে আলভস কুরুপিরা অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতার কথা বলেন। ব্রাজিলের ফেডারেল পুলিশ এই দলকে অবৈধ ভূমিদস্যুদের দল হিসেবে অভিহিত করেছে। অ্যামাজন জঙ্গলের আদিবাসীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য তারা ব্যাপকভাবে পরিচিত।
ওই দলের দুজন নেতা বিবিসিকে বলেন, উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদরা তাদেরকে রাজধানী ব্রাসিলা শহরে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করতে সহায়তা করে। তাদের প্রধান মিত্র কংগ্রেসম্যান ও সোশ্যাল লিবারেল পার্টির সদস্য কর্নেল ক্রিসোস্টমো। ২০১৯ সালে সোশ্যাল লিবারেল পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো। বিবিসির খবরে বলা হয়, কর্নেল ক্রিসোস্টমো তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বলে স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি জানেন না যে তারা ভূমিদস্যু। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে এ বিষয়ে বলেনি। যদি তারা কোনো ভূমিতে আগ্রাসন চালায় তাহলে কখনোই আমার কাছ থেকে সমর্থন পাবে না।’ বিবিসি জানায়, আলভস এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী রিচার্ডো স্যালস বলেন, প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারোর সরকার পরিবেশসহ অন্যান্য অপরাধীকে কখনোই সহ্য করবে না। ‘চলতি বছর সরকার অপারেশন ভার্ডে ব্রাজিল-২ শুরু করে। এ অপারেশনের মাধ্যমে ফেডারেল সরকার ও প্রদেশের মধ্যে অবৈধভাবে বনভূমি উজাড়, আগুন দেয়া ও এ কাজে সহায়তার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়।
রন্ডোনিয়াভিত্তিক ফেডারেল প্রসিকিউটর রাফায়েল বেভিলাকুইয়া বলেন, ব্রাজিলের ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।‘পরিস্থিতি হতাশাব্যাঞ্জক হয়ে উঠেছে। সরকার আমাদের বিরুদ্ধে নেমেছে। এটি বেদনাদায়ক।’
রন্ডোরিয়াতে ৩০ বছর ধরে বনভূমি উজাড়ের চেষ্টা চালানো ইভানিডে বান্ডেইরা বলেন, তিনি আশা হারিয়ে ফেলেছেন। ‘আমি মনে করছি এটি আমাদের জন্য বড় একটি যুদ্ধক্ষেত্র। বনভূমিটি ক্ষতির সম্মুখীন হতে দেখা সত্যিই কষ্টকর।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমন সময় ইতিহাসে আর কখনো আসেনি।’
এইচএকে/আরআর/এএ