নবম ও দশম শ্রেণির ভাবসম্প্রসারণ (তৃতীয় পর্ব)
সুপ্রিয় নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বন্ধুরা, শুভেচ্ছা নিয়ো। আজ তোমাদের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের নির্মিত অংশ থেকে আরো দু’টি ভাব-সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা করব। পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ভাব-সম্প্রসারণে ভালো নম্বর পেতে কবি ও সাহিত্যিকদের উক্তি বা কবিতাংশ সঠিকভাবে লিখবে।
নানান দেশের নানান ভাষা
বিজ্ঞাপন
বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা?
ভাব-সম্প্রসারণ : মাতৃভাষার সুধা মাতৃতুল্য। মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত রসাস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষায়ই তাদের প্রাণের আকুতি প্রকাশ পায়।
পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। আমরা ভাষার মাধ্যমে শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষায় কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় আরও প্রখরভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষি মানুষের জন্য ভেতরে ভেতরে মরুভূমির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ালেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি, খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা সম্ভব নয়। এজন্যই হয়তো মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় লিখেছেন –‘মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি / দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরুতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে আক্ষেপ করেছেন এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আমাদের দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য নিজের জীবনকেও বিসর্জন দিয়েছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরু করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলো রূপ দেবার চেষ্টা করে, এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরু করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।’মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে যেমন পুষ্টিকর, বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তেমন সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। মাতৃভাষা পুরোপুরি শেখার পর ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্য ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত না হলে অন্য ভাষা শেখাও আমাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। এজন্যই হয়তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।’
স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। তাহলেই আমরা বিশ্বের অন্যান্য জাতি থেকে ঐতিহ্যের ধারক বাহক হিসেবে আরো পরিচিত লাভ করতে পারবো।
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি
সত্য বলে, ‘আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’
ভাব-সম্প্রসারণ : পৃথিবীতে সত্য-মিথ্যা পাশাপাশি অবস্থান করে। জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই মানুষ সত্য ও মিথ্যাকে চিনতে শেখে। ভুল-ভ্রান্তির ভয়ে মানুষ কর্মবিমুখ হলে জীবনে কখনও সাফল্য আসবে না।
ঘরের দ্বার পথে আমরা ঘর থেকে বের হই কিংবা প্রবেশ করি। দ্বার বন্ধ করে রাখলে সেখানে প্রবেশ করা কিংবা বের হয়ে আসা কোনোটাই সম্ভব হয় না। তেমনি আমাদের মনেরও দরজা আছে। মন ভালো-মন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিচারের জন্য একটি নিভৃত ঘর বিশেষ। মানুষের জ্ঞান এখানে পরিশুদ্ধি লাভ করে। মনের মধ্যে যাতে কোনো ভুল-ভ্রান্তিপূর্ণ জ্ঞান প্রবেশ করতে না পারে, এ উদ্দেশ্যে যদি আমরা মনের দুয়ার বন্ধ করে রাখি, তাহলে বাস্তব বা সত্য জ্ঞানও সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। আমাদের পক্ষে তখন সত্য উপলব্ধি করা বা সত্য জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই জ্ঞান আহরণের সঠিক পন্থা হলো, জ্ঞান প্রবেশের জন্য মনের দ্বার খোলা রাখা অর্থাৎ মনকে উদার করা। এর ফলে ভালো-মন্দ, সত্য-অসত্য সব রকমের জ্ঞানই হয়তো মনে আশ্রয় পেতে চাইবে, কিন্তু তখন বিবেচনা শক্তির দ্বারা মিথ্যাকে বর্জন ও সত্যকে ধারণ করতে হবে। আল্লাহপাক মানুষকে ভালো-মন্দ বিচারের জন্য বিবেচনা শক্তি দান করে তাকে শ্রেষ্ঠতর আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। মানুষের এখন উচিত সেই বিবেচনা শক্তির সঠিক প্রয়োগ করা। আর এ উদ্দেশ্যে আমাদের মুক্ত মনের অধিকারী হতে হবে। বিজ্ঞ হেকিম লোকমানকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি এত জ্ঞান কোথায় পেলেন? জবাবে তিনি বলেছেন, “অজ্ঞানের কাছে।” বস্তুত অজ্ঞানের কাছে যেমন জ্ঞান লুকিয়ে থাকে, তেমনি মিথ্যার সাথে মিশে থাকে সত্য। দিনকে যেমন রাতের সাথে তুলনা করেই চেনা যায়, তাপকে যেমন শৈত্যের সাথে তুলনা করে অনুভব করা যায়, সত্যকেও তেমনি মিথ্যার পাশাপাশি রেখেই নির্ণয় করতে হয়। সাঁতার শিখতে হলে যেমন পানিতে নামতে হয়, তেমনি সত্যকে পেতে হলে জীবনের পথে নামতে হয়। আর এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে জীবনের চলার পথে মানুষ ভুল করতেই পারে। আর এই ভুল করতে করতে এক সময় মানুষ সত্যের অন্দরমহলে প্রবেশ করার সিংহদ্বারটির সন্ধান পায়। সব ঝিনুকেই মুক্তা থাকে না, কিন্তু মুক্তা সন্ধানীকে সব ঝিনুকের মধ্যেই মুক্তার সন্ধান করতে হয়। আমাদেরও মিথ্যার ফুলঝরির মধ্য থেকেই বিবেচনা শক্তির কষ্টির পাথরে প্রকৃত সত্যকে খুঁজে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে খনিতে কখনোই নিখাঁদ সোনা পাওয়া যায় না নানান খনিজ দ্রব্যকে পরিশ্রুত করেই সোনা লাভ করতে হয়। সত্যকে তেমনি মিথ্যা থেকে পরিশ্রুত করে নির্নয় করতে হবে। একেকটি ভুল মানুষকে একেকটি সত্যের সন্ধান দেয়। শিশু যেমন আছাড় খেতে খেতে হাঁটতে শেখে, মানুষও তেমনি ভুল-ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে সত্যকে চিনে নেয়। জগতে বরেণ্য যাঁরা, তাঁরা জীবন চলার পথে ভুল-ভ্রান্তিকে অতিক্রম করেই সত্য লাভ করেছেন। হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর নামে ‘ফারুক’শব্দটি সংযুক্ত হওয়ার কারণ তিনি তাঁর জীবনে সত্য-মিথ্যের প্রভেদকারী হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
মানুষের ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি সত্যকে পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় নয়; বরং ভুল-ভ্রান্তি থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে সার্থক জীবন লাভ করা যায়। তাই আমাদের উচিত ভুলের জন্য অনুতাপ করে বসে না থেকে ভুল সুধরে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সাধন করা।
শিক্ষক (বাংলা),আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ,মতিঝিল,ঢাকা।
এমকে