রোলা গ্যাঁরোর সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের অপেক্ষা। নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রেস কনফারেন্স কক্ষে অলিম্পিকে টেনিস একক স্বর্ণ জয়ী সার্বিয়ান নোভাক জোকোভিচ আসলেন ঘন্টা দেড়েক পর। পিঠে জড়ানো সার্বিয়ান পতাকা আর গলায় অলিম্পিক স্বর্ণ পদক। বিশ্ব টেনিসের ২৪ গ্র্যান্ডস্ল্যাম তার ভান্ডারে। কিছুক্ষণ আগে জিতলেন অধরা অলিম্পিকের স্বর্ণ। 

সেই কিংবদন্তী খেলোয়াড় সম্মেলন কক্ষের চেয়ার বসলেন মাথা নিচু করে সবাইকে কুর্নিশ করে। সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকরা ,‘ চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন, কংগ্রচেুলশন্স’ বলে অভিবাদন জ্ঞাপন করেন। কয়েক জন আবার কিংবদন্তির সম্মানের বিপরীতে দাড়ালেন।

মিনিট বিশেকের সংবাদ সম্মেলন। প্রতিটি সেকেন্ড ছিল উপভোগ্য ও শিক্ষণীয়। কোনো প্রশ্নের উত্তর মজার ছলে শুরু করে শেষ করেছেন গভীর জীবনবোধ দিয়ে। আবার কোনো প্রশ্নে পুরোটাই ব্যাখ্যা করেছেন টেনিসের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিশ্লেষণে। প্রতিপক্ষ নিয়ে যথেষ্ট সম্মান যেমন দেখিয়েছেন আবার নিজের ব্যক্তিত্ব ও পরিমিতিবোধেরও প্রদর্শনও করেছেন। প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হলেও বিরক্তি প্রকাশ না করে হাসি মুখেই সেই উত্তর পুনরায় দিয়েছেন। সম্মেলন কক্ষের প্রথম সারিতে বসায় জোকোভিচ ছিলেন মাত্র কয়েক মিটার দূরত্বে। জোকোভিচের সংবাদ সম্মেলন এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যেন চোখের পলকেই সময় কেটে গেল।

ক্যারিয়ারে এত অর্জন, সাফল্য টেনিস ছাপিয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম কিংবদন্তী সার্বিয়ান জোকোভিচ। কালকের দিনটিই তার কাছে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা, ‘২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে আমি দেশের পতাকা বহন করেছিলাম। এত দিন পর্যন্ত সেটা ছিল আমার ক্যারিয়ারের স্মরণীয় মুহূর্ত। আজ স্বর্ণ জয়ের পর এখন এই দিনটি আমার সবচেয়ে বেশি সেরা। ’

টেনিসের চার গ্র্যান্ডস্ল্যাম ও আরো অনেক টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে জোকোভিচের। এত সব কিছু ছাপিয়ে অলিম্পিকের স্বর্ণই তার কাছে কেন সেরা সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন,‘ অলিম্পিকে অনেক সময় অনেকে খেলেন না এটাও ঠিক। প্রতি বছরই চারটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম হয় আর চার বছর পর অলিম্পিক। গ্র্যান্ডস্ল্যামগুলো ব্যক্তিগত আর অলিম্পিক-ডেভিস কাপ দেশের হয়ে খেলা। আমি সব সময় দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পছন্দ করি।’

সপ্তাহ তিনেক আগেই উইম্বলডনে স্পেনিশ আলকারেজের কাছে সরাসরি তিন সেটে হেরেছিলেন জোকোভিচ। গতকাল সেই আলকারেজকে দুই সেটে হারিয়ে অধরা অলিম্পিক স্বর্ণ পূরণ করেছেন। এই প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নের উত্তরে বাস্তবতা ও নিজের আত্মবিশ্বাস দু’টি বিষয়ই দৃঢ়ভাবে বলেছেন জোকোভিচ, ‘আমার বয়স এখন ৩৭। আমি নিজেই এখন নিজের প্রেরণা। ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইমল্ডন আমাকে অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করেছে। আমি জানতাম আজ (গতকাল) না হলে আর হয়তো আমার স্বর্ণ জেতা হবে না। এজন্য সব কিছুই করেছি সর্বোচ্চভাবে। আমার সকল সফলতার পেছনে রয়েছ অনেক পরিশ্রম ও সাধনা। সে (আলকারেজ) এখন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে। আজও দারুণ খেলেছে। দু’টি সেটই দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ হয়েছে। দ্বিতীয় সেটে আমি যদি হেরে জেতাম, জানি না তৃতীয় সেটে কি হতো।’ 

টেনিস পুরুষ একক সাধারণত পাঁচ সেটের খেলা। অলিম্পিকে তিন সেটের হচ্ছে। প্রথম দুই সেট জেতায় জোকোভিচ-আলকারেজ ম্যাচ তৃতীয় সেটে গড়ায়নি। এক সেট না হলেও দুই সেটের দৈর্ঘ্য দুই ঘন্টার বেশি। দুই সেটেই দুই জনের সমান ৬ গেম ছিল। টাইব্রেকে দুই বারই জোকোভিচ জিতেছেন। ২০ বছরের তরুণের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ৩৭ বছর বয়সীর জয়। 

নোভাকের এক সময়ের কোচ কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নোভাক এই অলিম্পিকে স্বর্ণ জিততে না পারলে ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকেও খেলবে’ সেই মন্তব্য উদ্ধৃত করে প্রশ্ন হলে অলিম্পিক স্বর্ণজয়ীর উত্তর, ‘আমি খেলতে চাই, দেশের হয়ে খেলতে ভালোবাসি। ২০২৮ লস অ্যাঞ্জলস অলিম্পিকও আমি খেলতে চাই।’

জোকোভিচ লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক উচ্চারণ করতেই সম্মেলন দরজার পাশে দাড়ানো তার এক সতীর্থ হাসছিলেন। তখন জোকোভিচও মজা করে বলেন, ‘সে হয়তো আমার ক্যালেন্ডার গোল নিয়ে মজা করছে, ভাবছে ৪১ বছর বয়সে অলিম্পিক খেলা অবাস্তব আবার হয়তো এটাও ভাবছে এই মানুষের সঙ্গে আরো চার বছর সঙ্গী।’

অলিম্পিক ফাইনাল, ক্যারিয়ার পরিকল্পনার মাঝে হঠাৎ একজন প্রশ্ন করে বসলেন ক্যারিয়ারের প্রথম পুরস্কার নিয়ে। এক যুগের বেশি সময় আগে নেদারল্যান্ডসে এক টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন জোকোভিচ। সেই টুর্নামেন্ট আর পুরস্কার কি মনে আছে ? এই প্রশ্ন করতে যতক্ষণ দেরি হয়েছে জোকোভিচের বিশ বছর পেছন ফিরতে ততক্ষণ সময়ও লাগেনি, ‘অবশ্যই মনে আছে। আমার জীবনের প্রথম পুরস্কার নেদারল্যান্ডের টুর্নামেন্ট থেকে পেয়েছি। সেই পুরস্কার ছিল আইপট। স্বর্ণপদক ও আইপট দু’টো একেবারে ভিন্ন অনুভূতি। তবে সেটা প্রথম পুরস্কার অবশ্যই স্মরণীয়।’ 

অনেক ক্রীড়াবিদ খেলা শেষে রাজনীতি ও দেশের বড় পদে আসীন হন। সার্বিয়ায় বেশ গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব নোভাক। তাই এক সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা- আপনি কি সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে চান ? পুরো সংবাদ সম্মেলন কক্ষ হাসির রোল পড়ে গেল। জোকোভিচও কিছুক্ষণ হাসলেন। এরপর বললেন, ‘আমি এখন যেভাবে আছি, এতেই খুশি ও ভালো আছি। সার্বিয়ার পতাকা আমার গায়ে, অলিম্পিকের মঞ্চে সার্বিয়ার জাতীয় সঙ্গীত বেজেছে। এটাই আমার বড় তৃপ্তি। ’

কিংবদন্তী খেলোয়াড় ও অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত অনেক সাংবাদিকই নানান বিষয় প্রশ্ন করার অভিপ্রায়। সংবাদ সম্মেলন পরিচালনাকারী ঘোষণা দিলেন, ‘এটাই শেষ প্রশ্ন’। প্রশ্নকর্তা স্মরণ করতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যারিয়ারে আপনার অনেক অর্জন, এত সাফল্যের মধ্যে অলিম্পিক পদক কোন জায়গায় রাখবেন ?’ এই প্রশ্নের উত্তর প্রথম মন্তব্যের মধ্যেই ছিল। সেটা স্মরণ করে দিয়ে বেশ বিনয়ীভাবে জোকোভিচ বলেন, ‘এটার উত্তর শুরুতেই দিয়েছি, এরপরও আবার বেশ গর্বভরেই দিচ্ছি। অলিম্পিকের স্বর্ণপদক সব কিছুর উপরে আমার কাছে।’

সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জোকোভিচের কোট তুলতে। আবার কেউ অন্য খেলা কাভার করতে মিডিয়া শাটল ধরার লক্ষ্যে। জোকোভিচের সম্মেলনের মুগ্ধতার রেশ অবশ্য কাটেনি তখনো। অলিম্পিক টেনিসের ফাইনাল জোকোভিচ-আলকারেজ লড়াই যেমন স্মরণীয় দীর্ঘদিন, জোকোভিচের প্রেস কনফারেন্সও তদ্রূপ ঐতিহাসিক ।

জোকোভিচের কিছুক্ষণ আগে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন স্পেনিশ আলকারেজ। ২০ বছর বয়সেই ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। অভিজ্ঞ জোকোভিচের কাছে হেরে স্বর্ণপদক হারালেও রৌপ্য জিতেছেন। দ্বৈত লড়াইয়ে তার সঙ্গী ছিলেন কিংবদন্তী রাফায়েল নাদাল। এককে স্বর্ণ না জিতলেও ২০ বছর বয়সে অলিম্পিকে রৌপ্য জয়ের কৃত্তিত্বও নেই অন্য কারো। আলকারেজের এই পদক নাদালকে উৎসর্গ করবেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এই পদক স্পেনিশ জনগণের জন্য। যারা আমাকে সমর্থন ও ভালোবাসা দেয় প্রতিমুহূর্তে। ’

বাংলাদেশে টেনিস কখনোই তেমন আলোচনায় থাকে না। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা টেনিস। অলিম্পিক গেমসেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। তাই আলকারেজ-জোকিভিচ ফাইনাল কাভার করতে চান অ্যাক্রিডিটিয়েড মিডিয়ার অনেকেই। সীমিত আসন থাকায় অনেকে মিডিয়া ট্রিবিউনে বসে খেলা কাভার করতে পারেনি। রোলা গ্যাঁরো স্টেডিয়ামের নিচতলায় টিভিতে চোখ রাখতে হয়েছে। খেলা চলাকালে আলকারেজ-নোভাক কাছে থেকেও দূরে থাকলেও সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন কয়েক মিটার দূরত্বে। 

এজেড/জেএ