বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত যারা ব্রিজ খেলছেন/ঢাকা পোস্ট

মাঘের বৃষ্টিস্নাত ছুটির দিন। এমন দিনেও নানা বয়সের নানা পেশাজীবিরা সপ্তাহে একটা দিন বাসায় না কাটিয়ে ব্রিজের টানে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাবের প্রাঙ্গণে। এশিয়ান গেমসের ট্রায়াল চলায় বাংলাদেশ ব্রিজের এই চারণভূমির আঙিনা ছিল বেশ জমজমাট। বয়স-পেশা-পদবীর ভেদাভেদ ভুলে প্রতি রাউন্ডের ব্রেকে সবাই মেতে উঠেন কার্ড চালাচালির তুমুল বিশ্লেষণে। যেখানে নবীন খেলোয়াড় বুয়েট থেকে পাশ করা বিশ্বজিতের কথার শ্রোতা সিনিয়র খেলোয়াড় বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার এসএম রেজাউল করিম আবার বিশ্বকাপে খেলা শাহ জিয়াউল হক রাউন্ডের ফাঁকে পরামর্শ নেন বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় সৈয়দ সুজাউদ্দিনের (বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও সাবেক ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব)।

বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাব ব্রিজকে লালন-পালন করে আসছে যুগের পর যুগ। এই ক্লাবকে ঘিরেই ব্রিজের চর্চা টিকে আছে এখনো। করোনার আগে প্রতি শুক্রবার এই ক্লাবে ব্রিজ খেলা হতো। জাতীয় ও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিযোগিতা ও ট্রায়াল এই ক্লাবেই হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাব কোনো ফি নেয় না। 

১৯৭৮ সালে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে জড়িত এমএ কুদ্দুস। যিনি নিজেও ব্রিজ খেলোয়াড় (ক্লাবের একাধিকবারের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি; এখন বাংলাদেশ ব্রিজ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক) বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক ক্লাবের সঙ্গে ব্রিজের যোগসূত্র সম্পর্কে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম দিকের ব্রিজ খেলোয়াড়দের মধ্যে আমি একজন। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাব প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে ব্রিজ খেলার চর্চা আরো বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা শুরু থেকে ব্রিজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন অনেকে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাবের সঙ্গে ব্রিজের অঙ্গাঅঙ্গি সম্পর্ক হয়। সেই ধারাবাহিকতা এখনো বজায় চলছে।’ 

কুদ্দুসদের সেই ধারা বয়ে যাচ্ছেন এসএম রেজাউল করিম। ব্রিজে সক্রিয় থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে সিনিয়র। বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা রেজা ব্যাংকিং ব্যস্ততার মাঝেও ব্রিজে তার নেশা ও আনন্দ খুজে বেড়ান। তিনি নিজেও এখন উর্ধতন কর্মকর্তা। ব্রিজের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নমনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক ব্যাংকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রিজ খেলে। এজন্য অনেক সময় ছুটি প্রয়োজন হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এটি সাদরে দেয়। আমিও আমার জুনিয়র সহকর্মীদের ব্রিজে উৎসাহ থাকলে খেলার সুযোগ দেই।’

অফিসে পদ-পদবীর ভেদাভেদ থাকলেও ব্যাংক ক্লাবে সবাই এক কাতারে। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কিরণ রেজার পথ অনুসরণ করছেন ,‘ বিশ্ববিদ্যালয় পড়াবস্থাতে ব্রিজে হাতেখড়ি হলেও জাতীয় পর্যায়ে খেলা এবং বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেই। রেজা স্যার ও সিনিয়র দেখেই এখন ব্রিজই ধ্যানজ্ঞান। স্যারেরা ব্যাংকিংয়ে যেমন মেধার স্বাক্ষর রাখছেন তেমনি ব্রিজেও।’ কিরণ-ইলিয়াসদের অনুসরণ করছেন  সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে জয়েন করা তরুণ ব্যাংকার ও ব্যাংক ক্লাবের ক্রীড়া সম্পাদক শিমুল কুমার ঘোষও, ‘ব্যাংকের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। একটানা কয়েকবার বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্রততম মানব হয়েছি।  করোনা সময় থেকে ব্রিজের ঝোক বেড়েছে। ছুটির দিনগুলোতে ক্লাবে স্যারদের সঙ্গে ব্রিজ খেলি।’ 

ব্রিজ খেলোয়াড়দের অনেকাংশ ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও আরো কয়েকটি সরকারি ও প্রাইভেট ব্যাংকার এই খেলা খেলেন। ব্যাংকারদের এই খেলায় বেশি অংশগ্রহণের কারণ সম্পর্কে সুমন বলেন, ‘এই খেলাটি মূলত ছুটির দিনে হয়। ছুটির দিনে ফুটবল,ক্রিকেটেও খেলা যায়। কিন্তু সেখানে ইনজুরি ও ক্লান্তির বিষয় থাকে। ব্রিজে সেটা নেই। ব্রিজ খেলাটি ব্যাংকারদের জন্য আদর্শ খেলা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।’

ব্রিজ মানেই তাস পেটানো, একটা প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা। এটা যে অত্যন্ত বুদ্ধিভিত্তিক এক খেলা সেটা অজানা অনেকেরই। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক মেধাবী ও পেশাজীবীরাই খেলার সঙ্গে যুক্ত। পেশা-নেশার দারুণ সম্মিলন ঘটিয়ে ব্রিজ দু'বার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছে। সেই বিশ্বকাপের দলে অনেকে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি কাকতালীয় বিষয় সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হলের শিক্ষার্থী। \

শহীদুল্লাহ হলের সাবেক শিক্ষার্থী যারা এখন প্রতিষ্ঠিত ব্রিজ খেলোয়াড়/ঢাকা পোস্ট

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্রিজের সঙ্গে শহীদুল্লাহ হলের একটা বিশেষ সম্পর্ক। বাংলাদেশে ব্রিজের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে জিয়া,জাহিদ অন্যতম। তারা উভয়ে শহীদুল্লাহ হলের। 

এই হলের ব্রিজের গোড়াপত্তন জাহিদের হাত ধরে। সেই ১৯৮৮-৮৯ সালের স্মৃতি হাতড়ালেন জাহিদ এক মুহূর্তে, ‘সবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছিলাম। ইনডোর গেমসে ব্রিজ-দাবা ইভেন্ট ছিল। আমরা ব্রিজে চ্যাম্পিয়ন হলাম। তখন থেকেই চিন্তা করলাম নিশ্চয়ই এর আন্তর্জাতিক একটা পদ্ধতি আছে। সেটি খুঁজতে খুঁজতে বছর খানেক লেগে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতেই হলে খেলা শুরু করলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাব তখন থেকেই আন্তর্জাতিক ব্রিজের চর্চা করছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখানে এসে খেলতাম। হলে এই ব্রিজের ধারা আমার পরবর্তীতে মুন্না সহ আরো অনেকেই বজায় রাখে। মুন্মাদের থেকেই জিয়ারা উত্তরসূরি।’

শহীদুল্লাহ হলে ছিলেন বলেই আজ হয়তো ব্রিজে আসা ও বিশ্বকাপ খেলা জিয়ার, ‘১৯৯৫ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থাকি। তখন থেকেই মূলত ব্রিজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। আমাদের আগে জাহিদ ভাইরা খেলতেন। তাদের দেখাদেখি হলে এই খেলার দারুণ চর্চা ছিল।’ জাহিদ-মুন্নারা ব্রিজে গোড়াপত্তন করলেও জিয়ারা শহীদুল্লাহ্ হলের ব্রিজকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াবস্থাতে ব্রিজ খেলেই হলের তারকা ছিলেন জিয়ারা, ‘৯৮-৯৯ সালের দিকে আমরা জুনিয়র ব্রিজ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ভারত যাই। ব্রিজ খেলে দেশের বাইরেও যাওয়া যায়। এটা ভেবে আমাদের হলের জুনিয়ররাও এতে আকৃষ্ট হয়।’ 

এই পরম্পরায় অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্রিজ খেলোয়াড় শহীদুল্লাহ হল থেকে এসেছেন। অন্য হলের ছাত্র হলেও শুধু ব্রিজের টানে এ হলে থেকেছেন এমন সংখ্যাও কম নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হলেই কার্ড খেলা হয়। শহীদুল্লাহ হল থেকে ব্রিজ খেলোয়াড় বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে জিয়ার ব্যাখ্যা, ‘শহীদুল্লাহ হলে বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরা বেশি থাকেন। এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা টিএসসি কেন্দ্রিক আড্ডা একটু কম তুলনামুলক, সেই সময়  হলে কাটান। সময় কাটানোর জন্য অকশন ব্রিজ অনেকেই খেলেন। সেখান থেকেই মূলত পেশাদার ব্রিজে আসেন অনেকে।’ 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে পেশাগত জীবনে জিয়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। শহীদুল্লাহ্ হলের পর বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে ব্রিজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আরো সুবিধা হয়েছে। তবে ব্রিজের জন্যই বাংলাদেশে ব্যাংকে আসেননি তিনি, ‘এটা অনেকটা কাকতালীয়। পড়াশোনা শেষের পর চাকুরির চেষ্টা করেছি। বিসিএস,ব্যাংক পরীক্ষা দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকে হয়েছে। জয়েন করেছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের মতো বুয়েটের একটি গ্রুপ ব্রিজে উঠে আসছে ম্যাক্সিমাস ও আরেকটি নামে দল গড়ে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ব্রিজে আসার গল্পটা বললেন বিশ্বজিত সাহা, ‘২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ব্রিজ ফেডারেশন একটি সেমিনার করে। সেই সেমিনার থেকে আমরা ব্রিজে আসি। এরপর আমরা বুয়েটে আগ্রহী হই। আমরা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পর বুয়েটের সিনিয়রদেরও অনুপ্রাণিত করি। ফলে এখন আমাদের সাবেক বুয়েটিয়ানদের দুটো দল রয়েছে। আমাদের অনুসরণ করে বর্তমানে বুয়েটে চর্চা বাড়ছে '। দেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জিয়া বিশ্বজিতদের উপর বড় পদক জয়ের সম্ভাবনা দেখেন, ‘ওরা অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল। ওদের মাধ্যমে বড় পর্যায়ে ভালো কিছু সম্ভব।’

বিশ্বদের মতো তরুণদের আগ্রহে ব্রিজ ফেডারেশনও খেলাকে বাচিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোকে টার্গেট করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের পর দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরকে ব্রিজে আকর্ষণের চেষ্টা করবে ফেডারেশন।

দেশের অন্য খেলাগুলোতে খেলোয়াড়দের কম-বেশি আয়ের সুযোগ রয়েছে। সেখানে ব্রিজে উল্টো। খেলোয়াড়রা নিজের গাটের পয়সা খরচ করে খেলেন। চলমান এশিয়ান গেমসের ট্রায়ালে এন্টি ফি ৩৫ হাজার। খেলোয়াড়রা মিলে এই অর্থ দিচ্ছেন। ফেডারেশনের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কিরণের দৃষ্টিতে, ‘ব্রিজ খেলাটি আসলে সবার জন্য নয়। এখানে বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে আর্থিক স্বচ্ছলতাও প্রয়োজন। বুদ্ধিদীপ্ততা ও আর্থিক স্বচ্ছলতা আবার ভালো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ 

এজেড/এটি