পঞ্চাশ ছুঁয়ে উড়ছে গর্বের লাল-সবুজের পতাকা। উড়ছে, এগিয়ে যাচ্ছে প্রাণের বাংলা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া প্রিয় বাংলাদেশ! স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার মাঠেও এসেছে সাফল্য, এগিয়েছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। সুবর্ণজয়ন্তীতে পেছন ফিরে তাকালেই অনেকে হতাশার মাঝেও চোখে পড়বে একাধিক উজ্জ্বল মুখ আর অসংখ্য অর্জন। 

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ আসর অলিম্পিক গেমসে পদক সোনার হরিণ। তবে এশিয়ান গেমসে কাবাডি আর ক্রিকেটের হাত ধরে এসেছে পদক। পদক এসেছে কমনওয়েলথ গেমসে শ্যুটিংয়েও। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হতাশাই সঙ্গী হয়েছে বারবার। আক্ষেপের অন্য নাম হয়ে থেকেছে দেশের ফুটবল। এক সময়ের এক নম্বর খেলাটি তার সোনালী অতীত ফেলে এসেছে পেছনে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা হয়নি। সামনে যে হবে তেমন ইঙ্গিতও নেই। বিচ্ছিন্নভাবে শ্যুটিং, দাবা, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, গলফ, আর্চারি থেকে এসেছে সাফল্য।

যা একটু স্বস্তির পরশ হয়ে এসেছে ক্রিকেট মাঠের সাফল্য। ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফি গোটা বাংলাদেশকে গেঁথেছিল বিনি সুঁতোর মালায়। লাল-সবুজের দেশ একজোট হয়ে সামিল হয়েছিল আনন্দ মিছিলে। ৭১'র মহান স্বাধীনতার পর সেবারই প্রথম পুরো জাতি কোন একটা সাফল্যের আনন্দে সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পালন করে। ক্রিকেটই দূর করেছিল সব ভেদাভেদ। রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে এক হয়ে গিয়েছিল দেশ।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

বাংলাদেশ নামের এই বদ্বীপের প্রথম অর্জন কিন্তু এসেছে ফুটবলেই। গৌরবের অংশ হয়ে আছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন যাত্রা শুরু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। ফুটবল পায়ে মুক্তিযুদ্ধে এক হয়েছিলেন ৩১ মুক্তিযোদ্ধা। ফুটবল দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহই ছিল উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই ও বিহারে ১৪টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। 

পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল এটিই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আকাশবাণীতে (কলকাতা রেডিও) বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের মুজিবনগরে রিপোর্ট করতে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরই ৪০ ফুটবলার মুজিবনগর ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকেই বাছাই করা হয় ৩০ ফুটবলার। গড়ে উঠে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

৭১-এর ২৫ জুলাই কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদিয়া একাদশের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচ শুরুর আগে বাজানো হয় জাতীয় সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা...। স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে প্রথম গোলটি করেন শাহজাহান। যদিও স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর জন্য পরদিন অবশ্য চাকুরিচ্যুত করা হয় নদিয়ার ডিসিকে!

ফুটবল দল গড়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিলেন এই দেশের ফুটবলাররা। সব মিলিয়ে ফুটবল পায়ে সাড়ে তিন লাখ রুপির তহবিল গঠন করে স্বাধীন বাংলা দল। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এখনও পায়নি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কার!

জলের বুকে বিশ্বরেকর্ডে মুক্তিযুদ্ধ

যিনি জলের বুকে দাগ কেটে গড়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে রেখেছিলেন অনন্য ভূমিকা। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে কলকাতার কলেজ স্কয়ারে সাঁতারে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন বাংলাদেশের সাঁতারু অরুণ নন্দী। ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে গড়েন বিশ্বরেকর্ড। ভাঙেন যুক্তরাষ্ট্রের বি সিমুনের ১৯৩২ সালে গড়া  ৮৯ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট সাঁতারের রেকর্ড। 

অরুণ নন্দীর সেই প্রদর্শনী সাঁতার থেকে ওঠা অর্থ জমা দেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। বিশ্বরেকর্ড গড়ার পর এক লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল তাকে। পুরোটাই তিনি তুলে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত বাংলাদেশের তহবিলে।

৭১-এর সেই উত্তাল দিনে কলকাতার শরণার্থীদের অরুন বন্দুক হাতে নয়, জলের বুকে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। পদ্মা-মেঘনায় সাঁতরে বেড়ে উঠা এই মানুষটির ছিল অবিরাম সাঁতরে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা দিয়েই যুদ্ধকালীন সময় গোটা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নেন তিনি। সুর্যোদয়-সুর্যাস্ত সব এক করে লড়ে যান জলের বুকে। রক্ত বমিও থামাতে পারেনি তাকে। ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর চাঁদপুরের বাগদী গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি মহান মুক্তিযুদ্ধে রাখেন বড় ভূমিকা।

২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানেই ১৬ নভেম্বর কলকাতায় বোনের বাসায় মারা যান অকৃতদার এই মানুষটি। সঙ্গে নিয়ে গেছেন অনেক অবহেলা আর অপ্রাপ্তি!

ফুটবলের পথচলা শুরু 

বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সদস্য পদ বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯৭৪ সালে, স্বাধীনতার তিন বছর পর। তবে এর আগেই দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই। প্রতিপক্ষ ছিল তখন থাইল্যান্ড। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত মারদেকা কাপ দিয়ে ফুটবলে ম্যাচটি খেলার দুই বছর আগেই গঠিত হয় বাংলাদেশ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাফুফে। 

বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অংশ নিয়েছে ১৯৮৫ সালে। সেরা প্রাপ্তি অবশ্য এসেছে আরও পরে। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপ জেতে বাংলাদেশের লাল দল। তারপর ১৯৯৫ সালের মিয়ানমারে চার জাতি চ্যালেঞ্জ কাপে ট্রফি জেতে বাংলাদেশ ফুটবল দল। কাঠমান্ডুতে ১৯৯৯ সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে ফুটবলে প্রথম সোনা পায় ফুটবল দল। 

২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ নারী সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল। কিশোরীদের হাত ধরে এসেছে স্বপ্নের সাফল্য। তারপরই মূলত জেগে উঠেছে বাংলাদের নারী ফুটবল। প্রান্তিক অঞ্চল থেকে এখন উঠে আসছে মেয়েরা। বছর দুই পর আরেক সুখবর আসে জয়া চাকমার হাত ধরে। ২০১৯ সালে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার স্বীকৃতি পান তিনি।

ক্রিকেটের এগিয়ে চলার গল্প

স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে ইউসুফ আলী ও মোজাফফর হোসেন খানকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের। দেশের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর ১৯৭৪-৭৫ থেকে জাতীয় পর্যায়ে ক্লাব ক্রিকেটের লিগ শুরু হয়।

১৯৭৫-৭৬ মৌসুম শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড সে সময়ের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) কাছে সহযোগী সদস্য পদের জন্য আবেদন করে। তখনই ক্রিকেট বোর্ড আমন্ত্রণ জানায় মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবকে (এমসিসি)। এমসিসির ট্যুর রিপোর্টের পরই আইসিসির সিদ্ধান্ত আসে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আইসিসির সহযোগী সদস্য পদ পায় ১৯৭৭ সালে। পূর্ণাঙ্গ সদস্য পেয়ে যায় ১৯৯৭ সালে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখে ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে। সেবার ৪ ম্যাচের দুটিতে জয়, দুটিতে হারে নিজেদের অস্তিত্বের জানান নেয় টাইগাররা। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপের ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডেতে শুরু হয় পথচলা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয় দলকে প্রথমবারের মতো নিয়ে যায় বিশ্বকাপে। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলে টাইগাররা। ২০১৫ আইসিসি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। যা কি না এখন অব্দি বিশ্বকাপে সেরা প্রাপ্তি। একইসঙ্গে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলাটিও সেরা অর্জনের অন্যতম।

দাবার রানী

অনেকেই আছেন যারা আলোর পথ দেখান। পথ তৈরি করে দেন আগামীর। তেমনই একজন রানী হামিদ। বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার। পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন, ডাক নাম রাণী। ১৯৮৩ সালে লন্ডনে ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন জেতেন তিনি। তার পথ ধরেই ১৯৮৫ সালে ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান রানী। ৩ বার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।

১৫ বার জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ আলোর পথের যাত্রী। তার দেখানো পথ ধরেই এগিয়েছে দেশের নারীরাও পা রেখেছেন ক্রীড়াঙ্গনে। আর রানী হামিদ ৭৭ পেরিয়ে গেলেও এখন প্রাণবন্ত। মগ্ন আছেন দাবার বোর্ডে। 

ট্র্যাকে ইতিহাস শাহ আলমের

শাহ আলম, অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে ঝড় তোলা এক বিস্ময় মানব। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসে হয়েছিলেন দ্রুততম মানব। টানা দু'বার সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হয়েছিলেন ১৯৫৮ সালের ৫ মে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহেবনগর গ্রামে জন্ম নেওয়া শাহ আলম। বড্ড দুর্ভাগা একজন মানুষও তিনি। ১৯৮৯ সালের ২৯ মে বেইজিং এশিয়াডের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগ দিতে মোটরসাইকেলে মেহেরপুর থেকে ঢাকায় পথে ছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে পাবনার বেড়ার দাড়িয়াপুরে সড় দুর্ঘটনায় সর্বনাশ। গুরুতর আহত হয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা পর দেশসেরা অ্যাথলেট মোহাম্মদ শাহ আলম চলে যান না ফেরার দেশে।

মৃত্যুর পর ক্রীড়া ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শাহ আলম ১৯৯১ সালে পেয়েছিলেন স্বাধীনতা পুরস্কার। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অ্যাথলিটের আলোচনায় এখনো তার নামটাই আসে সবার আগে!

বাজিমাত মোশাররফের

মোশাররফ হোসেন মুষ্টিযোদ্ধা। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এশিয়ান গেমসে কোনো পদক জয় করেন।১৯৮৬ এশিয়ান গেমসে তিনি ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন পান তিনি। সে বছরই সিওলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে প্রথমবার অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। আর দেশের হয়ে প্রথম পদক জেতেন বক্সার মোশাররফ। সেই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৯ সালে তিনি পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।

উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার

তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে দাবায় প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাবধারী নিয়াজ মোরশেদ। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব দাবা সংস্থা (ফিদে) তাকে মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ড মাস্টারের (জিএম) মর্যাদা দেয়। এশিয়ার ৫ম গ্র্যান্ড মাস্টার তিনি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত টানা চার বছরের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি।

নিয়াজের হাত ধরেই দাবা জনপ্রিয়তা পায় বাংলাদেশে। আর তিনি নিজেও পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতি। যার মধ্যে আছে ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮৯ সালে পান স্বাধীনতা পুরস্কার।

কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশ প্রথম স্বর্ণ

১৯৯০ কমনওয়েলথ গেমসে বেজে উঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। দেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণ জেতেন শ্যুটার আতিকুর রহমান। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই শ্যুটার ১৯৯৪ সালে জেতেন স্বাধীনতা পুরস্কার। সেই বছরই বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ১৯৯০ এশিয়ান গেমসে কাবাডি থেকে রুপা পায় বাংলাদেশ।

সাদা পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশ

২৬ জুন, ২০০০। দশম দেশ হিসেবে আইসিসির পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা পেয়ে যায় বাংলাদেশ। সাদা পোশাকের অভিজাত অঙ্গনে পা রাখার টিকিট মেলে। ১০ নভেম্বর, ২০০০ সাল। টেস্ট অভিষেক। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ ভারত। তার পথ ধরেই ১০ জানুয়ারি ২০০৫, প্রথম টেস্ট জয়। ম্যাচের পর ম্যাচ হার কিংবা ড্রয়ের আক্ষেপ শেষে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল কাঙ্ক্ষিত সেই জয়ের দেখা। পাঁচ বছর দুই মাস, ৩১ হার, ৩টি ড্র আর অনেক প্রতীক্ষার আরাধ্য জয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়!

তারপর সময়ের পথ ধরে আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মাশরাফি বিন মর্তুজা কিংবা সাকিব আল হাসানদের হাত ধরেই তো ক্রিকেট এখন অনন্য উচ্চতায়। জাতীয় খেলা কাবাডি কিন্তু ক্রিকেট হয়ে গেল দেশের নাম্বার ওয়ান খেলা। ক্রিকেট ধীরে ধীরে জাতীয় জীবনে বড় প্রভাবক হয়ে পড়েছে। ক্রিকেট এখন এই বাংলায় নেহাত মাঠের খেলাই নয়, দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের একটা অংশও বটে।

গিনেস বুকে যার নাম

জোবেরা রহমান লিনু। বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত এক মুখ। টেবিল টেনিস দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ অব্দি ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন। এই সাফল্যের পথ ধরে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ওঠে যায় তার নাম। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখান লিনু।

মুধু টেবিল টেনিস নয়, সাইক্লিংয়েও বেশ দক্ষ লিনু।  ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০ সালে জাতীয় সাইক্লিং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ৯ জুন ১৯৬৫ সালে জন্ম নেওয়া জোবেরা রহমান লিনু। এখন তো লেখালেখিতেও ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে। ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে করেছেন কাজ।

ক্রিকেটে নারী জাগরণ

সময়ের সঙ্গে একটা সময় পথচলা শুরু হয় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের। ২০০৭ সালের জুলাইয়ে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর একটু একটু করে এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর, নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ৯ উইকেটে হারিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিকের মর্যাদা পায় টাইগ্রেসরা।

তবে সেরা সাফল্যটা এসেছে ২০১৮ সালে। সাকিব আল হাসান কিংবা মাশরাফি বিন মর্তুজারা যা পারেননি তাই করে দেখিয়েছেন সালমা খাতুন আর জাহানারা আলমরা। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ শিরোপা জেতে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে অনন্য উচ্চতায় পা রাখে টাইগ্রেসরা। বছরের শেষটাতে এসে মেয়েরা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার টিকিটও নিশ্চিত করেছে। 

নাম্বার ওয়ান সাকিব

বাংলাদেশের জান-সাকিব আল হাসান! বিজ্ঞাপনের এই লাইনটাই এখন সবার মুখে। এই অলরাউন্ডারের হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে পা রেখেছে নতুন উচ্চতায়। ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডে অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ের নাম্বার ওয়ানে উঠে আসেন তিনি। এরপর টেস্টেও চমক দেখিয়ে হয়ে যান সেরা অলরাউন্ডার। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটে একই সময় সেরা অলরাউন্ডার হয়ে সাকিব উঠে যান চূড়ায়। ক্রিকেট বিশ্বে সেবারই প্রথম ঘটেছিল এমন ঘটনা।

১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরায় জন্ম সাকিবের। প্রথম মাগুরার ইসলামপুর পাড়া ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়েই খুঁজে পান সাফল্যের সিঁড়ি। তারপর বিকেএসপিতে ভর্তি। ১৫ বছর বয়সে সুযোগ মেলে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। একইসঙ্গে জাতীয় লিগে খুলনা বিভাগীয় দলে খেলতে শুরু করেন এই অলরাউন্ডার। তারপর আর আটকায় কে? দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বড় ফ্রাঞ্চাইজি আসরেও হয়ে উঠেন সেরাদের সেরা।

খেলেছেন ৫৭ টেস্ট, করেছেন ৩৯.৭০ গড়ে ৩৯৩০ রান। সেঞ্চুরি ৫টি,হাফসেঞ্চুরি ২৫টি। স্পিন যাদুতে নিয়েছেন ২১০ উইকেট। বিস্ময়কর হলো টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট হাতে দলের ১৩.৯০% ও বল হাতে ২৭.২৪ উইকেট তুলে নিয়েছেন সাকিব।

ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ২০৯টি, ৩৮.০৮ গড়ে করেছেন ৬৪৩৬ রান। সেঞ্চুরি ৯টি, হাফসেঞ্চুরি ৪৮টি, উইকেট নিয়েছেন ২৬৬টি। সব মিলিয়ে তিনি শুধু বাংলাদেশের সর্বকালের সেরাই নন, বিশ্বের ক্রিকেটে ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডারদের অন্যতম। ইর্ষণীয় সব রেকর্ডই এগিয়ে রাখছে তাকে।

যুবাদের বিশ্বজয়

উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়-এমনই শিরোনামে রঙিন হয়েছিল দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতায়! ২০২০ সালে আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় জুনিয়র টাইগাররা। যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে ট্রফি জেতে বাংলাদেশ।

এটি যে কোন স্তরের ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিশ্বকাপ জয়। ১৯৯৭ সালের পর  প্রথম ক্রিকেটের কোন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ট্রফি জয়ের ঘটনা। ফাইনালে চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে আকবর আলী-পারভেজ হোসেন, শরিফুল ইসলামরা, তানজীব হাসানরা গড়ে নতুন এক ইতিহাস। 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে নিশ্চিত করেই এই অর্জন থাকছে ওপরের সারিতে। ভারত বধের পর নতুন কাব্য লেখা আকবর আলির দল দেশে ফিরেই পেয়েছে বীরোচিত সংবর্ধনা। বড়রা যা করে দেখাতে পারেনি, স্বাধীনতার পঞ্চাশের ঐতিহাসিক ক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে যে সাফল্য ছিল অধরা, তাই তারা উপহার দিলেন গোটা জাতিকে! এখন আমাদেরও সংগ্রহে আছে একটা বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ জয়ী সোনার বাংলা!

এটি/এমএইচ