২০০৮ ও এর পরবর্তী অলিম্পিক এলেই বাংলাদেশে আলোচিত হন ভারতের শ্যুটার অভিনব বিন্দ্রা। ২০০২ ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের শ্যুটার আসিফ হোসেন খান তাকে হারিয়ে স্বর্ণ জেতেন। এরপর আসিফের পথ সেভাবে প্রশস্ত না হলেও বিন্দ্রা ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতেছেন। ১০০ কোটির অধিক জনসংখ্যাবহুল দেশে অভিনব বিন্দ্রাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একক ইভেন্টে অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতেছেন। ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের অভিনব বিন্দ্রার সঙ্গে অলিম্পিক, বাংলাদেশ ও ভারতের শ্যুটিং নিয়ে কথা বলেছেন। 

ঢাকা পোস্ট : ভারতে ক্রিকেট খুবই জনপ্রিয়, এরপর ফুটবল এবং হকিও। এত জনপ্রিয় টিম খেলা থাকতে আপনি কিভাবে শ্যুটিংয়ে আকৃষ্ট হলেন। 

বিন্দ্রা: ছোটবেলা থেকেই আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম। আমার পরিবার খুবই উৎসাহ দিতো। আমার শ্যুটিংয়ে ভালোলাগা শুরু হয় ১৯৯২ বার্সেলোনা গেমস দেখার পর থেকে। আরও গভীরভাবে বলতে গেলে লিম্বা রামের শ্যুটিং দেখার পর। ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিক থেকেই আমার ধ্যান জ্ঞান হয় শ্যুটিং। তখন থেকেই আমি কল্পনা করি অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতার।

ঢাকা পোস্ট : ২০০২ সালে কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে বাংলাদেশের শ্যুটার আসিফ হোসেন খানের কাছে আপনি হেরেছিলেন। সেই দিনটির কথা কি এখনো মনে আছে?

বিন্দ্রা: হ্যাঁ আসিফ এবং সেই ইভেন্টের কথা মনে আছে। আসিফ সেই গেমসে দারুণ খেলেছিল। সে কমনওয়েলথে দারুণ ছন্দে থেকে আমাকে হারিয়েছে। আমি মনে করি সেটা বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে দারুণ এক মুহূর্ত ছিল। আসিফ এখনো কোচিং এসেছে এটা দেখে ভালো লাগছে। আসিফের প্রতি আমার সব সময় শুভকামনা।

ঢাকা পোস্ট : ২০০২ সালে কমনওয়েলথে হার। এর ছয় বছরের মধ্যে অলিম্পিকে স্বর্ণ। এই ছয় বছর নিজেকে কিভাবে প্রস্তুত করেছিলেন?

বিন্দ্রা: আগেই বলেছি আমি ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিক দেখার পর থেকেই অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ের বাসনা ছিল। সেই লক্ষ্যে শুরু থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। তবে মূল পরিবর্তন ও পরিকল্পনাটা শুর হয় ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকের পর থেকে। ওই অলিম্পিকে আমি আমার ক্যারিয়ারের সেরা স্কোর করেছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল পরবর্তী অলিম্পিকে আমার দ্বারা স্বর্ণ জয় সম্ভব। এরপরই মূল অধ্যাবসায় ও অনুশীলন শুরু। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে আমি ২০০৪-০৮ পর্যন্ত বিশ্বের সেরা প্রযুক্তি, যন্ত্র ও অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছি । আমি প্রতি দিনই নিজেকে ট্যাকনিক্যালি ও মানসিকভাবে তৈরি করতে পেরেছি। বেইজিং পৌঁছানো মাত্রই আমার মধ্যে ভিন্ন এক প্রকার আত্মবিশ্বাস জন্মে, ‘আমি সেরা হতে পারব।’

ঢাকা পোস্ট : আপনার জীবনের সাফল্যের রহস্য এবং জীবন দর্শন কি ?

বিন্দ্রা: আপনি খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা এমনকি যে কোনো পেশাজীবী হন না কেন আমার দৃষ্টিতে সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত সব সময় জানতে ও শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। এর সাথে আরেকটি বিষয় খুব জরুরি পৃথিবী, পরিবেশ সময়ের সাথে পরিবর্তন হলেও নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে নিবেদিতভাবে কাজ করতে হবে। 

ঢাকা পোস্ট : ১০০ কোটি জনগণের দেশে আপনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছেন। আপনি নিজেকে ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ মনে করেন কি?

বিন্দ্রা: আমি মনে করি না একজনের সাফল্যের সঙ্গে অন্যদের সাফল্যের তুলনা খুব বেশি প্রয়োজন। সবাই সবার মেধা ও শ্রম দিয়ে সাফল্য অর্জন করে। সবার সাফল্যের মহত্ব রয়েছে। আমি ভারত ও গোটা বিশ্বের মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়ে খুব খুশি। ২০০৮ এ যেমন পেয়েছি এখনও তেমন। মানুষের এই ভালোবাসায় আমি শ্যুটিং ও খেলার সাথে থাকতে চাই আমার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।

ঢাকা পোস্ট : আপনি ২০০৮ সালে অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতেছেন। তিন বছর পর ২০১১ বিশ্বকাপ জিতে মহেন্দ্র সিং ধোনি অনেকটা আপনার চেয়েও বেশি আলোচিত ছিলেন। আপনার কি মনে হয় না মাঝে মধ্যে ক্রিকেটের ছায়ায় থাকায় অন্য ডিসিপ্লিনের বড় তারকারা?

বিন্দ্রা: সন্দেহাতীতভাবে ক্রিকেট দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। যাই হোক আমার এটা নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই। আমি যথেষ্ট সম্মান ও জনপ্রিয়তা পেয়েছি। আমার পরবর্তীতে যারা ভারতকে দিয়েছে অন্য ডিসিপ্লিনের যেমন পিভি সিন্ধু, নিরাজ চোপরা আরো অনেককেও দেশ ও জনগণ সম্মান দিচ্ছে। 

ঢাকা পোস্ট : ভারতে ক্রীড়াবিদদের খুবই কদর। এই করোনাকালে ক্রীড়া তারকাদের কি রকম ভূমিকা রাখছেন জনগণের জন্য এবং আপনি কি এতে সন্তুষ্ট ?

বিন্দ্রা: অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদরা শুধু ভারত নয় বিশ্বজুড়েই রোল মডেল। ভারতের এই কঠিন সময়ে অনেক ক্রীড়াবিদ আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে, অনেক সামাজিক বার্তা দিচ্ছে , অনেক খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। যে যেভাবে পারে জনগণের পাশেই রয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : ভারতে করোনা মহামারির মধ্যে আইপিএল চলছিল। সেই সময় আইপিএল নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। আপনার দৃষ্টিতে কেমন ছিল বিষয়টি?

বিন্দ্রা: আইপিএল শুধু ভারত নয় সারা বিশ্বে একটি আলোচিত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এর পেছনে বিনিয়োগ অনেক। তারপরও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আগে। সব কিছু মিলিয়ে বিসিসিআই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 
 
ঢাকা পোস্ট : কোনো শ্যুটার বা এমন কোনো ক্রীড়াবিদ দেখেন কিনা যে ব্যক্তিগত ইভেন্টে ভারতের হয়ে অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতবে?

বিন্দ্রা: ভারতে খেলার মান ও আগ্রহ দুইটিই বাড়ছে। এখন অনেক রাজ্য প্রতিযোগিতাগুলো দেখি খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। পাশাপাশি প্রতিটি খেলাতেই ভারতে কোনো না কোন রোল মডেল তৈরি হচ্ছে যাকে দেখে পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। আমি আশাবাদী ভারত আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় আরো সাফল্য পাবে। আমি খুবই আশাবাদী এক দশকের মধ্যে ভারতে এমন ক্রীড়াবিদ আসবে যারা বিশ্বজয় করবে এবং আমি একমাত্র ব্যক্তিগত স্বর্ণজয়ী হিসেবে আর থাকব না।

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আবার আসি। বাংলাদেশের শ্যুটার আপনাকে ২০০২ সালে পরাজিত করল। এরপর অলিম্পিক তো দূরের কথা এশিয়ান পর্যায়েও বাংলাদেশ তেমন কিছু করতে পারেনি। আপনি কি মনে করেন এই বিষয়টি এবং পরামর্শও দিতে পারেন ।

বিন্দ্রা: আমি মনে করি বাংলাদেশের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য হাই পারফরম্যান্স অ্যাথলেটদের নিবিড় ও আধুনিক অনুশীলন প্রয়োজন। আমার ফাউন্ডেশন থেকে পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছে অ্যাথলেটরা। বাংলাদেশেও এ রকম কিছু প্রয়োজন। বাংলাদেশের মেধাবী শ্যুটার আছে অবশ্যই ভালো কিছু সম্ভব। 

এজেড/এটি