বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক কারা, আছে ধোঁয়াশাও!
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বিশ্বের বুকে ঠাঁই পায় নতুন মানচিত্র ও পতাকা। ক্রীড়াবিদরা বাংলাদেশের জার্সি পরে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন নানা খেলায়। অনেক খেলায় বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়করা দুনিয়া ছেড়েছেন, কেউ এখনও ক্রীড়াঙ্গনে জড়িয়ে আছেন, আবার কেউবা নিভৃত জীবনযাপনে। বিজয়ের ৫৩ বছর পরেও অনেক খেলায় প্রথম অধিনায়ককে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর হাতেই অধিনায়কত্ব ছিল বাংলাদেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পরেও। স্বাধীনতার পর প্রথম আনুষ্ঠানিক খেলা হিসেবে গণ্য করা হয় ১৯৭২ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ও মুজিবনগর একাদশের ম্যাচকে। সেই ম্যাচে মুজিবনগর একাদশের অধিনায়ক ছিলেন পিন্টু। ১৯৭২ সালে ঢাকা একাদশ আসামের বরদলুইয়ে খেলতে যায়, সেই দলেরও অধিনায়ক ছিলেন পিন্টু। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে বাংলাদেশ তার নেতৃত্বেই খেলেছে। এক মাস আগে গত ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ফুটবলের এই প্রথম অধিনায়ক দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক ছাড়া আজই প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন।
বিজ্ঞাপন
ক্রিকেট এখন তিন ফরম্যাটের খেলা। ওয়ানডেতে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, টেস্টে নাইমুর রহমান দুর্জয় ও টি টোয়েন্টিতে শাহরিয়ার নাফিস প্রথম অধিনায়ক হলেও দেশের ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃত শামীম কবির। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এমএসসির বিপক্ষে খেলা দলটিই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সেই দলকে নেতৃত্ব দেওয়া শামীম কবীরকে তাই প্রথম অধিনায়ক ধরা হয়। ২০১৯ সালে তিনি পরপারে পাড়ি দিয়েছেন।
ফুটবল, ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক দুনিয়ায় না থাকলেও, এখনও জীবিত হকির প্রথম অধিনায়ক আব্দুস সাদেক। ১৯৭৮ সালে এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ হকি দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এর আগে শ্রীলঙ্কা হকি দল বাংলাদেশে সিরিজ খেলতে এসেছিল। তখনও সাদেকই ছিলেন অধিনায়ক। সত্তরের দশকে হকি বাংলাদেশে জনপ্রিয় খেলা হলেও জাতীয় দলের প্রথম খেলা বেশ বিলম্বেই হয়েছে বলে জানান তিনি, ‘স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দল নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। আরেকবার ঢাকা একাদশ নামে। বাংলাদেশ নামে খেলা একটু দেরিতেই হয়েছে, যখন শ্রীলঙ্কা খেলতে আসে।’
আব্দুস সাদেক শুধু বাংলাদেশ হকি দলের প্রথম অধিনায়কই নন, আবাহনী ক্লাবের প্রথম ফুটবল এবং হকি অধিনায়কও। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এখন বর্ষীয়ান ক্রীড়াবিদও আব্দুস সাদেক। তার মতে জীবিতদের মধ্যে সিনিয়র ক্রীড়াবিদদের সংখ্যা খুব সীমিত, ‘এখন বোধহয় জামান ভাই (কিংবদন্তি সাংবাদিক ও সাবেক ক্রীড়াবিদ) সবচেয়ে সিনিয়র। এরপর বশির ভাই, হাফিজ ভাই তারপর প্রতাপ দা। আমি এবং টিপু সমসাময়িক।’
ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি তিন শীর্ষ খেলায় পুরুষ দলের প্রথম অধিনায়ক নিয়ে তেমন কোনো ধুম্রজাল নেই। জাতীয় খেলা কাবাডির অধিনায়ক নিয়ে খানিকটা দ্বিমত রয়েছে। ১৯৭৪ সালে ভারত বাংলাদেশে শুভেচ্ছামূলক কাবাডি সিরিজ খেলতে আসে। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন মকবুল হোসেন। ওই দলের অন্যতম সদস্য সুবিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘বাংলাদেশের কাবাডির প্রথম অধিনায়ক মকবুল। তিনি কয়েক মাস আগে মারা গেছেন।’
বাংলাদেশের কাবাডির অন্যতম কিংবদন্তি আব্দুল জলিল। তার মত একটু ভিন্ন, ‘১৯৭৩ সালে দিল্লি রুরাল গেমস খেলতে বাংলাদেশ থেকে কাবাডি দল গিয়েছিল। বাংলাদেশ হিসেবে গেলে সেই দল থেকে প্রথম অধিনায়ক স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ। তবে সিরিজ/টেস্ট বিবেচনায় মকবুল সাহেবই প্রথম অধিনায়ক।’ বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রথম কোচ ছিলেন সাহেব আলী। তিনি অত্যন্ত ভালো মানের কাবাডি খেলোয়াড় ও কোচ ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভারত বাংলাদেশে আসলে কাবাডি দলেরও কোচ ছিলেন প্রথম ফুটবল কোচ সাহেব আলী।
কাবাডির মতোই খানিকটা ধুম্রজাল ভলিবলে। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ভলিবল। সেই ভলিবলে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক কে তা নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত। সাবেক ভলিবল খেলোয়াড় ও সংগঠক আনিসুর রহমানের মতে, ‘৭২-৭৩ সালের দিকে দিল্লিতে ভলিবল খেলতে যায় বাংলাদেশ। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী বাবু।’ আবার কারও দৃষ্টিতে ১৯৭৪ সালে রাশিয়ার ক্লাব বাংলাদেশে খেলতে আসে। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন ফারুক। তাই তিনিই প্রথম অধিনায়ক। ভলিবলের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা আনিসুর রহমানের মন্তব্য, ‘৭৪ সালে বেশ কয়েকটি বিভাগে রাশিয়ার ক্লাব খেলেছে। যে বিভাগে খেলা হয়েছে সেই বিভাগ থেকে অধিনায়ক করা হয়েছে। ঢাকা বিভাগে অধিনায়ক ছিল ফারুক।’
আরও পড়ুন
ভলিবল সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে— ফারুক বেঁচে নেই। গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও ক্রীড়াঙ্গনে আসেন কদাচিৎ। ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদে দায়িত্ব পালনের পর তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনেরও মহাসচিব ছিলেন। কর্পোরেট কোম্পানি পেপসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন একসময়।
পুরুষ ভলিবলের অধিনায়কত্ব নিয়ে খানিকটা দ্বিমত থাকলেও নারী দলের অধিনায়ক নিয়ে অনেকেই একমত। খুলনার হেলেনা খান ইভা বাংলাদেশ নারী ভলিবলের প্রথম অধিনায়ক। তার মা হোসনে আরা বেগম বাংলাদেশ নারী ভলিবলের পথিকৃৎ। কয়েক মাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। অন্যদিকে, ইভা দীর্ঘদিন আমেরিকায় জীবনযাপন করছেন।
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক নিয়ে মতভেদ অনেক। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে ২০১০ নারী সাফ ফুটবল থেকে ফিফার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। সেই হিসেবে তৃষ্ণা চাকমা প্রথম অধিনায়ক। সাবেক ফুটবলার তৃষ্ণা বলেন, ‘ছোটন স্যার ও অনেকের মুখে শুনেছি আমি প্রথম অধিনায়ক। আবার কেউ বলে আমার আগেও ছিল।’
নারী দলের সাবেক কয়েকজন ফুটবলারের দৃষ্টিতে ডালিয়া আক্তার প্রথম অধিনায়ক। তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ইন্দো-বাংলা গেমসে অংশগ্রহণ করে। ডালিয়া এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইতিহাস অবশ্যই সঠিক এবং নির্মোহ হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল এখন ভালো অবস্থানে, আমরা গর্বিত। কিন্তু অতীতকে এড়ানো যাবে না। আমার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সিনিয়র পর্যায়ে খেলেছে। ইন্দো-বাংলা গেমসে সাফল্যও আছে।’
এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। সেই ক্রিকেট বোর্ডে পুরুষ অধিনায়কদের তালিকা থাকলেও নেই নারী অধিনায়কদের কোনো তালিকা। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট অনেকের দেওয়া তথ্যমতে– তাজকিয়া আক্তার বাংলাদেশ নারী দলের প্রথম অধিনায়ক।
বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়কদের মধ্যে এখন বর্তমানে একজন ফেডারেশনের সভাপতি। সত্তর-আশির দশকে বাস্কেটবল ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশ বাস্কেটবল দলের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন ডাক্তার শামীম নেওয়াজ। যিনি ক্রীড়াঙ্গনে আকা হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৯ সালে তার নেতৃত্বে এশিয়ান বাস্কেটবল খেলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার এত বছর পর বাংলাদেশ বাস্কেটবল দলের খেলা প্রসঙ্গে আকা বলেন, ‘স্বাধীনতার ২-৩ বছর পর বাস্কেটবল অসংগঠিত ছিল। এর মাঝে ২-১ বার খেলার আমন্ত্রণ আসলেও যাওয়া হয়নি। ৭৫ পরবর্তী ঘটনায় আরও ২-১ বছর সেভাবে বাংলাদেশের দল হিসেবে খেলা হয়নি। ঘরোয়া পর্যায়ে টুর্নামেন্ট হয়েছে। অবশেষে ৭৯ সালে আমরা এশিয়ান বাস্কেটবল খেলতে যাই। খেলতে যাওয়া ও আসার পথেও ম্যাচ খেলেছি।’
বাস্কেটবলের মতো অবস্থা হ্যান্ডবলেও। আশির দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে হ্যান্ডবল প্রচলন ও ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হলেও সিনিয়র দল গঠন হয়েছে অনেক পরে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ হ্যান্ডবল নারী ও পুরুষ দল দেশের বাইরে প্রথম খেলতে যায়। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন আকরাম ও তন্দ্রা। আকরাম এখন বাংলাদেশ আনসারে চাকরি করে খেলাধুলার সঙ্গে থাকলেও, তন্দ্রাকে ক্রীড়াঙ্গনে দেখা যায় না। হ্যান্ডবলের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আকরাম বলেন, ‘এটা আসলে বিশেষ অনুভূতি, একটি খেলায় দেশের প্রথম অধিনায়ক।’
অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবা, কারাতে, জুডো, শ্যুটিং মুলত ব্যক্তিগত খেলা। মিশ্র-দলীয় ইভেন্ট কিছু খেলায় থাকলেও সেভাবে অধিনায়কত্ব নেই। দলীয় খেলায় অধিনায়কত্ব বড় বিষয় হলেও, বাংলাদেশের এমন অনেক খেলায় প্রথম অধিনায়কের বিষয়টি এখনও সেভাবে মীমাংসিত নয়।
এজেড/এএইচএস