অলিম্পিক গেমসের মেইন প্রেস সেন্টার, ভেন্যু টু ভেন্যু সাংবাদিকদের নৈমিত্তিক রুটিন। আজকের (মঙ্গলবার) সকালটা অবশ্য একটু ভিন্ন ছিল। ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন এআইপিএসের শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান ছিল এদিন। ভেন্যু বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ আর্ন্তজাতিক সংস্থা ইউনেস্কোর সদরদপ্তর। 

প্যারিসের অন্যতম অভিজাত এলাকায় ইউনেস্কোর অফিস। মেট্রো থেকে নেমে কয়েক মিনিট হেঁটেই চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি দেশের পতাকার সারি। যেখানে বাংলাদেশের পতাকাও উড়তে দেখা গেল। বেশ বড় আয়তন নিয়েই আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিস। নানা আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে ইউনেস্কোর সদরদপ্তরে প্রবেশ। 

মূল ভবন নয়-দশ তলা বিশিষ্ট হলেও আজকের অনুষ্ঠানে শুধু প্রবেশাধিকার ছিল নিচতলায়। হল রুমের পাশে দেখা গেল একটি বড় স্পোর্টস রুম। নিচতলার অন্যপ্রান্তে রয়েছে লাইব্রেরি। আর মাঝামাঝি জায়গাজুড়ে বড় বাগান।

এআইপিএসের শতবর্ষ অনুষ্ঠান ইউনেস্কোর নিচ তলায় বিশাল হল রুমে। দেড়ঘণ্টা ব্যাপী এই অনুষ্ঠান কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। দশ বা এর অধিক অলিম্পিক কাভার করা সাংবাদিকদের একটি সনদ ও ক্রেস্ট দিয়েছে এআইপিএস। সাংবাদিকদের পাশাপাশি কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ সের্গেই বুবকা, সেবাস্তিয়ান কো, নাদিয়া কোমানেচি, ডালে থম্পসনসহ আরও ১২ জনকে সম্মাননা প্রদান করেছে। একই মঞ্চে কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিকরা। এমন সুন্দর মুহূর্ত সবাই ফ্রেমবন্দী করে রাখার চেষ্টা করেছেন।

বুবকা-নাদিয়া যখন অ্যাথলেট, সেই সময়ের অনেক সাংবাদিক আজ সম্মাননা পেয়েছেন। একই মঞ্চে পরিচিতদের পেয়ে আরও একটু খোশগোল্পে মেতে উঠেছিলেন অনেকে।

অনুষ্ঠান শেষ হতেই কয়েকটি জটলা পাকল। সেই জটলা কেন্দ্রে পোলভোল্টের রাজা সের্গেই বুবকা ও জিমন্যাস্টিক্সের রাণী নাদিয়া কোমাচিনি। দুই কিংবদন্তির বয়সের গণ্ডি ৬০ পার হলেও তারকাখ্যাতি যেন সেই খেলোয়াড়ী জীবনের মতোই। সাংবাদিকদের এক জটলা থেকে বের হচ্ছেন তো আরেক জটলায় গিয়ে পড়ছেন। ইউনেস্কো-এআইপিএসের লোকজন এসে তাদের সরিয়ে নিতে হয়েছে কয়েকবার।

রোমানিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্স নাদিয়া কোমানেচির অলিম্পিক গেমসের পদক নয়টি। এর মধ্যে স্বর্ণই পাঁচটি। মাত্র দুই অলিম্পিক খেলে পাঁচটি স্বর্ণ জিতেছেন নাদিয়া। অলিম্পিকের পাশাপাশি বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্স এবং আরও অনেক প্রতিযোগিতায় নাদিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব ছিল একচ্ছত্র। প্যারিসে সাংবাদিকরা আজ পাওয়ার পর আবার উঠল অলিম্পিক-জিমন্যাস্টিক্সে একাল-সেকালের আলোচনা। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ও সাফল্য প্রসঙ্গও। 

নাদিয়া তিন-চার ভিন্ন ভিন্ন জটলায় সাংবাদিকদের প্রায় একই প্রশ্নের একই উত্তর দিয়েছেন। এত বড় কিংবদন্তিকে পেয়ে অনেক সাংবাদিকই চেষ্টা করেছেন একান্তে দু’একটি মন্তব্য নেওয়ার। কয়েকজন সেই সুযোগও পেয়েছেন। তবে আরেক কিংবদন্তি সের্গেই বুবকার ক্ষেত্রে অবশ্য সবাই সেই সুযোগটা পাননি।

অলিম্পিক গেমসে সের্গেই বুবকার স্বর্ণ মাত্র একটি। তবে সেই এক স্বর্ণ দিয়ে বুবকাকে বিচার করা মস্ত বড় ভুল। অ্যাথলেটিক্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট পোল ভোল্ট। সেই পোল ভোল্ট যেন বুবকারই ‘প্যাটেন্ট’। পোল ভোল্টে তার ত্রিশটির বেশি বিশ্বরেকর্ড রয়েছে। সেই রেকর্ডের অধিকাংশই নিজের রেকর্ড নিজে ভাঙার ঘটনা।

অ্যাথলেটিক্সের আকর্ষণ থাকে স্প্রিন্টে। তবে আশি-নব্বইয়ের দশকে বুবকার পোল ভোল্টও আলাদা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলাদেশেও একটি প্রজন্মের কাছে বুবকা বড় তারকাই। ভিড়ের মধ্যে বুবকা এটি শুনে একটু হেসে বলেছেন, ‘ওহ দ্যাটস গুড।’

কিংবদন্তি জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচির সঙ্গে প্রতিবেদক আরাফাত জোবায়ের

ব্যক্তিগত খেলার অ্যাথলেটরা বেশি আলোচনায় আসেন অলিম্পিকে পদক জিতে। বুবকার মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের অলিম্পিক ভাগ্য ভালো ছিল না। ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জলস অলিম্পিক বয়কট করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পরবর্তীতে ইউক্রেনসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র হয়েছে। আশির দশকের অনেকের কাছে বুবকা সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া)। আজ ইউনেস্কো হলে বুবকার সামনে এক সাংবাদিক রাশিয়ান উচ্চারণ করতেই একটু কণ্ঠস্বর বাড়িয়েই বললেন, ‘আই অ্যাম ইউক্রেনিয়ান, নট রাশিয়ান।’ কিছুক্ষণ পর সেই সাংবাদিকের সঙ্গে আবার দেখা হলেও একই কথা বললেন, ‘আই অ্যাম ইউক্রেনিয়ান।’

সময়ের সঙ্গে অলিম্পিক গেমসেরও বিবর্তন ঘটেছে। সংবর্ধনা পাওয়া সাংবাদিকরা তাদের কাভার করা প্রথম গেমসের সঙ্গে এখনকার গেমসের ভিন্নতার চিত্র তুলে ধরেছেন। ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রচেষ্টায় ১৯২৪ সালে এআইপিএসের জন্ম। আজ শতবর্ষ অনুষ্ঠানে ১০০ বছর আগের এআইপিএস সভার ঐতিহাসিক ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। শতবর্ষে সুন্দর মেলবন্ধন হয়েছে ইতিহাস-বর্তমান এবং কিংবদন্তি-সাংবাদিকের। শতবর্ষে সাংবাদিকদের ভোটাভুটিতে শতাব্দীর সেরা পুরুষ অ্যাথলেট বক্সার মোহাম্মদ আলী ও নারী অ্যাথলেট টেনিস খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামস নির্বাচিত হয়েছেন।

এজেড/এএইচএস