টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে সাঁতারু আরিফ

ফ্রান্সে চলছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সর্ববৃহৎ প্রতিযোগিতা অলিম্পিক গেমস। সেই ফ্রান্সেই রয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক এক অলিম্পিয়ান। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে খেলা সাঁতারু আরিফুল ইসলাম ফ্রান্সে নিভৃতে জীবনযাপন করছেন গত কয়েক বছর। 

২২ বছর বয়সে অলিম্পিক খেলা সাঁতারু আরিফের বয়স এখন ২৫ বছর। অথচ ৩০ বছর পর্যন্ত সাঁতারুরা টপ ফর্মে থাকেন। সেখানে বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করা সাঁতারু ২৫ বছর বয়সেই দাড়ি টেনেছেন।

গত অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আরিফ। এবার অলিম্পিক আয়োজকের দেশেই বসবাস। দুই অলিম্পিকে দুই ঘটনার মুখোমুখি সাঁতারু আরিফুল, ‘এখানে ফরাসি ও অন্য দেশের অনেকেই জানে আমি টোকিও অলিম্পিক খেলেছি। তারাও অনেক জিজ্ঞেস করছে, ‘‘প্যারিস অলিম্পিক হচ্ছে আমার কেমন লাগছে?’’ আসলে আমার তেমন কোনো অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া নেই। প্যারিস থেকে কয়েক’শ কিলোমিটার দূরের শহরের থাকি। অলিম্পিকের খোঁজ-খবর সেভাবে রাখা হচ্ছে না।’ 

প্যারিস থেকে কয়েক’শ কিলোমিটার দূরে ফ্রান্সের ব্রেস্ট শহরে বসবাস করেন আরিফ। সেই শহরে সার্কেল ডেস নাগেরর্স দি ব্রেস্ট ক্লাবে বাচ্চাদের সাঁতার শেখান তিনি। সাঁতারের কোচের পাশাপাশি রেস্টুরেন্টেও কাজ করছেন এই অলিম্পিয়ান সাঁতারু। কয়েক বছর পর রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় আরও মনোযোগী হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে তার। দেশের সাঁতারের সঙ্গে গত কিছুদিন যাবৎ একেবারেই যোগাযোগ নেই এক সময়ের সেরা সাঁতারুর।

২০২০ টোকিও অলিম্পিকে আরিফ খেলেছিলেন ওয়াইল্ড কার্ডে। সেই সময় দেশের অন্যতম সেরা সাঁতারু ছিলেন তিনি। জাপানের অলিম্পিকে খেলার সময় তার লক্ষ্য ছিল পরের আসরে সরাসরি খেলা। পরের অলিম্পিক আসতে আসতে এখন তিনি পেশাদার সাঁতার থেকেই বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে বলেন, ‘টোকিও অলিম্পিক খেলে আমি তিন মাস দেশে ছিলাম। আমার সংস্থায় চাকরিও ছিল। সেখানে তেমন সম্মান পাইনি। ফেডারেশনকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। তারা অপেক্ষা করতে বলেছিল। অপেক্ষাও করেছিলাম, পরবর্তীতে দেশে আর ভালো না লাগায় ফ্রান্সে এসে পড়ি। ফেডারেশনকে এটি জানালেও আমার সংস্থাকে জানাইনি অবশ্য।’

প্রতি আসরের আগে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনকে ৪-৫ জন ক্রীড়াবিদের জন্য বৃত্তির কোটা দেয়। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন ডিসিপ্লিন ও খেলোয়াড়ের সম্ভাবনা বিচার-বিবেচনা করে সেই বৃত্তি প্রদান করে। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে সেই বৃত্তির আওতায় ছিলেন সাঁতারু আরিফ। জাপানের টোকিও অলিম্পিকের জন্য আরিফ প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ফ্রান্সে ট্রেনিং করেন। 

উন্নত বিশ্বের দেশে গেমস, টুর্নামেন্ট ও ট্রেনিং হলে ক্রীড়াবিদ পালানোর ঘটনা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে রয়েছে। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে আমেরিকায় খেলতে গিয়ে আর ফিরেননি দেশসেরা দ্রুততম মানব ও কৃতি অ্যাথলেটদের অনেকেই। আরিফ অবশ্য সেই পথে হাঁটেননি। অলিম্পিকের অধীনে ফ্রান্সে বৃত্তি সম্পন্ন ও টোকিও অলিম্পিক খেলে দেশে ফিরে পুনরায় ফ্রান্সে এসেছেন। ভিসার মেয়াদ থাকতেই আবার ভিসা বৃদ্ধির আবেদন করেছেন। প্রথম দফায় দুই বছর এবং পরের দফায় ভিসা বৃদ্ধি পেয়েছেন পাঁচ বছর। যার মেয়াদ ২০২৭ পর্যন্ত। বিকেএসপির সাবেক এই শিক্ষার্থী ২০১৯ কাঠমান্ডু এসএ গেমসে পদক জিতেছিলেন।

ফুটবল, ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশের অন্য খেলার ক্রীড়াবিদরা আর্থিকভাবে তেমন স্বচ্ছল নন। অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে উন্নত দেশে স্থায়ী আবাস গড়তে চান। অনেকে একেবারে খেলা ছেড়ে চলে যান, আবার খেলতে গিয়ে পালিয়ে যান কেউ। আরিফ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ফ্রান্সে বসবাস করছেন। তবে তিনি অলিম্পিকে খেলেছেন এবং বৃত্তির আওতায় ছিলেন ফ্রান্সে। ফেডারেশন ও অলিম্পিক এসোসিয়েশন তার পেছনে বিনিয়োগ করেছে। সাঁতার ও দেশের ক্রীড়াঙ্গন সেই বিনিয়োগ প্রাপ্তির আগেই তিনি খেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন উঠে ক্রীড়াঙ্গনে।

এ নিয়ে ব্রেস্ট শহর থেকে আরিফের মন্তব্য, ‘বিদেশে আসা ও থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে বিদেশ থাকা অনেক কষ্টের। নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারার কষ্ট প্রবাসী ছাড়া সবাই বুঝবে না। আমি অলিম্পিক খেলে দেশে ফিরেছিলাম, দেশে থেকে সাঁতার করতেই। সম্মান ও মর্যাদা না পাওয়ায় আবার ফ্রান্সে ফিরি। ফ্রান্সে ফেরার কয়েক মাস পর ফেডারেশনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এরপর এখানে কোচ হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করি। পরবর্তীতে ফেডারেশনকে বলেছি ফ্রান্সে আমার যোগাযোগ রয়েছে। কোচিং কোর্স বা ট্রেনিং বিষয়ে সহায়তা করতে পারি।’

টোকিও অলিম্পিকে খেলেছিলেন আরেক সাঁতারু ইংল্যান্ড প্রবাসী জুনাইনা আহমেদ। তারও এখন বাংলাদেশের সাঁতারের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অলিম্পিয়ান পরিচয় পাওয়া সারা বিশ্বের ক্রীড়াবিদের জন্য স্বপ্ন। ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি একজন অলিম্পিয়ানের দায়বদ্ধতা অনেক। ক্রীড়াবিদরা যেমন সেই দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না, আবার ফেডারেশনও সেই ধারণা ও সুযোগ দেয় না অনেক সময়। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশিবার অলিম্পিকে খেলেছেন সাঁতারু ডলি আক্তার। তিনি ক্যারিয়ারের শেষদিকে সাঁতার ছেড়ে ভলিবলে মনোযোগী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন সাইদুর রহমান ডন। সাবেক এই অ্যাথলেটও দীর্ঘদিন ধরে প্রবাস জীবনে।

অলিম্পিয়ান সাঁতারুদের খেলা থেকে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এমবি সাইফের মন্তব্য, ‘সময়ের সেরা ও আন্তর্জাতিক সাঁতার ফেডারেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ফেডারেশন অলিম্পিকের সাঁতারু মনোনয়ন দিয়ে থাকে। অলিম্পিয়ান সাঁতারু অবশ্যই ক্রীড়াঙ্গনের সম্পদ। ফেডারেশন তাদের দেশের স্বার্থে রাখতে চায়। অলিম্পিকে অংশগ্রহণের পর যদি তারা ব্যক্তিগত কারণে খেলার সঙ্গে না থাকেন বা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সম্পৃক্ত থাকতে না চান, সেখানে ফেডারেশনের তেমন কিছু করার থাকে না।’

এজেড/এএইচএস