প্যারিসেই সাঁতারের ভেন্যু লা ডিফেন্স অ্যারেনা। যার অবস্থান মিডিয়া সেন্টার পোর্তে মেলিয়ত থেকে তেমন দূরত্বেও নয়। এরপরও মেইন মিডিয়া সেন্টার থেকে নেই কোনো শাটল। তাই বাংলাদেশি সাঁতারু সামিউল ইসলাম রাফির ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট কাভার করতে সকাল ৯টার দিকেই লা কর্নোভ বাসা থেকে রওনা। 

লা কর্নোভের সাত নম্বর মেট্রোর বদলে প্যারিস রয়েলে এক নম্বর লাইনে উঠতেই সাঁতারের আঁচ পাওয়া গেল। প্রতি স্টেশনেই যত লোক উঠছে, নামছে খুবই কম। কারণ প্রায় সবারই গন্তব্য লা ডিফেন্স স্টপেজ। 

লা ডিফেন্স মেট্রো স্টেশন থেকে বের হতেই সাঁতারের ভেন্যুর আবহ। সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটছেন। গেমসের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড থাকায় একটু ধীরেই হাঁটছিলাম। এক পাশ দিয়ে হাঁটছি, আরেক পাশে দেখছি লাইনের পর লাইন। যত সামনে আগাই ততই দেখি লাইনের ভিড়। লাইনে দাঁড়ানো কারও টিকিট রয়েছে, আবার কেউ এসেছেন টিকিট পাওয়ার প্রত্যাশায়। বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ রেজাউল হক বাদশা ফ্রান্সে এসেও সাঁতারের টিকিট জোগাড় করতে পারেননি। অলিম্পিকে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সাঁতার ডিসিপ্লিনের সাক্ষী হতে চান সবাই। গেমসে অ্যাক্রিডিটেড মিডিয়ার উদ্বোধনী-সমাপনী অনুষ্ঠান কাভার ছাড়া হাই-ডিমান্ড টিকিটের তালিকায় শুধু সাঁতার।

সাঁতারের ভেন্যুতে দর্শনার্থীদের লম্বা লাইনের একাংশ

লা ডিফেন্স স্টেশন থেকে সাঁতার ভেন্যুর দূরত্ব প্রায় আধ কিলোমিটার। এই ৫০০ কিলোমিটার পথে হাজার হাজার মানুষের লাইন। ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির জন্য দর্শকদের এমন লাইন দেখতে অভ্যস্ত। সাঁতার দেখতে এমন লাইন এবং এত ভিড় বাংলাদেশিদের জন্য খানিকটা বিস্ময়েরই। ইউরোপীয়ান দেশ ও অলিম্পিকে ক্রীড়াপ্রেমীদের ভিড়ই থাকে অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার ঘিরে। প্যারিস অলিম্পিকে সাঁতার দেখতে এসেছেন ফ্রান্সের পাশ্ববর্তী অনেক দেশ থেকেই। সাঁতারে দর্শকদের এতটাই চাপ যে ভলান্টিয়াররা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় কিছুক্ষণ পরপর নানা ঘোষণা ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।

আধা কিলোমিটার হাঁটার পর লা ডিফেন্স অ্যারেনায় সাঁতার ভেন্যুতে প্রবেশ। সুবিশাল ও সৌন্দর্য্যে ঘেরা কমপ্লেক্স। নিচ তলায় সুবিশাল মিডিয়া সেন্টার। অন্য যেকোনো ভেন্যু মিডিয়া সেন্টারের চেয়ে বড়। মিডিয়া সেন্টারের কয়েক ধাপ ওপরে মিডিয়া ট্রিবিউন। সেই ট্রিবিউনে গিয়ে সাঁতারের বিশালতা চোখে পড়ল। প্রত্যেক সাংবাদিকের ডেস্কের সামনে স্ক্রিন ও ফলাফল শিট। দর্শকদের জন্যও রয়েছে অত্যাধুনিক কয়েকটি জায়ান্ট স্ক্রিন।

প্রায় বিশ হাজার ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়াম। আজ সকাল থেকে ছিল ফ্রি স্টাইলের হিট। সেই হিট দেখতেই স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভরপুর। বিভিন্ন দেশের পতাকা নিয়ে অনেক দর্শক-সমর্থক স্লোগানও দিচ্ছেন। লেন, পানি ও প্রযুক্তি সবকিছু মিলিয়ে অত্যাধুনিক পরিবেশ।

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সেই দেশে সাঁতারের বেহাল অবস্থা। সাঁতার পুরোটাই টাইমিং নির্ভর খেলা। চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদী, বাংলাদেশের সাঁতারের দুঃখ ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড। কয়েক কোটি টাকা ব্যযে স্কোরবোর্ড নির্মিত হলেও এখনও অচল। বাংলাদেশের সাঁতার প্রতিযোগিতা ও অনুশীলন হয় হ্যান্ড টাইমিংয়ে। শুধু ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড নয়, বাংলাদেশ সাঁতারের প্রধান ভেন্যু মিরপুরস্থ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কমপ্লেক্সে রয়েছে আরও নানা সমস্যা। গ্যাসলাইন না থাকায় শীতকালে হয় না অনুশীলন, বিদ্যুৎ-সহ আরও অনেক সমস্যাই রয়েছে। এত সীমাবদ্ধতা নিয়ে বাংলাদেশি সাঁতারুদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদক প্রত্যাশা করা বাতুলতাই।

ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশের অন্য সকল খেলাই মূলত দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি। সেই গণ্ডিতে এক সময় দাপট ছিল বাংলাদেশ সাঁতারের। ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান একাই পাঁচটি স্বর্ণ জিতেছিলেন। মোশাররফের মতো দাপুটে সাঁতারু বাংলাদেশে আর আসেনি। ২০১৬ সালের গৌহাটি এসএ গেমসে মাহফুজা খাতুন শিলা স্বর্ণ জেতেন দু’টি। গত এক দশকে বাংলাদেশের সাঁতারে অর্জন ও সাফল্য বলতে শিলার স্বর্ণই। আজ প্যারিস অলিম্পিকে পুরুষ ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলঙ্কা ও নেপালের চেয়েও পেছনে। শ্রীলঙ্কান সাঁতারু আভিসিংহে ৫৪ ও নেপালের সাঁতারু শাহ’র অবস্থান ৫৯তম। পাহাড়ী দেশ নেপালও বাংলাদেশের চেয়ে সাঁতারে এগিয়ে।

সাঁতার অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় ডিসিপ্লিন। যেখানে বাংলাদেশের সাঁতারুরা ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে প্রতি আসরে অংশগ্রহণ করছেন। সাঁতার বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিসিপ্লিন ও নদীমাতৃক বাংলাদেশে সম্ভাবনা থাকলেও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষেদের সুদৃষ্টি খুব কমই ছিল এই খেলার প্রতি। সব সময় নানা ঘাটতি নিয়েই চলেছে সাঁতার।

ফুটবল, ক্রিকেট বাদে অন্য সকল ফেডারেশনের মূল পদ সাধারণ সম্পাদক। গত দেড়যুগ ধরে সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে বসছেন রাজনৈতিক আশীবার্দপুষ্ট ব্যক্তি। ব্যাকস্ট্রোক-ফ্রি স্টাইল নিয়ে তেমন ধারণা না থাকা ব্যক্তিদের হাতেই দেশের সাঁতার। নব্বইয়ের দশকে সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন দেশসেরা সাঁতারুই। সর্বোচ্চ টেকনিকসম্পন্ন ব্যক্তি ফেডারেশনের মূল পদে থেকে সাঁতারের উন্নয়নের চেয়ে নানা কাণ্ডে বিতর্কিত হয়েছেন বেশি!

এজেড/এএইচএস