প্যারিস থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের শহর সাতেউরো। নির্জন পরিবেশে চলছে অলিম্পিকের শুটিং প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশের প্রতিযোগী রবিউল ইসলামের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল কাভার করতেই এত পথ পাড়ি দেওয়া। 

পথিমধ্যে গাড়ির ইলেকট্রিক চার্জিং সমস্যায় নানা ভোগান্তি। কোনো মতে রেঞ্জে উপস্থিত হওয়া। রবিউল প্রত্যাশিতের চেয়ে কম স্কোর করায় এত পথ পাড়ি দিয়ে আসা অনেকটাই বৃথা লাগছিল। শুটিং রেঞ্জ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ চোখ পড়ল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির টি শার্ট পড়া সুদর্শন লোকের দিকে। একটু কাছে গিয়েই নিশ্চিত তিনি ভারতীয় কিংবদন্তী ক্রীড়াবিদ অভিনব বিন্দ্রা। যিনি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিক গেমসে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ জেতেন। 

অভিনব বিন্দ্রার একান্ত সাক্ষাৎকার পড়ুন নিচের লিংকে

বিন্দ্রাকে কাছে পেয়ে পথের ভোগান্তি ও রবিউলের ব্যর্থতা অনেকটাই ম্লান। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বিন্দ্রার সঙ্গে বেশ কয়েক মিনিট সময় কাটালাম। অতি অল্প সময়ে বিন্দ্রার ভদ্রতা-বিনয়ী ভাব বুঝে উঠতে সময় লাগেনি। তিন বছর আগে মুঠোফোনে সাক্ষাৎকারে খানিকটা টের পেলেও সামনাসামনি দর্শনে বিনয়ের পুরোটাই ফুটে উঠল। 

 ভারতীয় কিংবদন্তী ক্রীড়াবিদ অভিনব বিন্দ্রার সঙ্গে প্রতিবেদক।

বাংলাদেশি সাংবাদিক তাই কোনো প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ অবতারণার আগেই বিন্দ্রার জিজ্ঞাসা, ‘আসিফ কেমন আছে? কোথায়- কি করছে?’ আসিফ বাংলাদেশের তারকা শুটার। ২০০২ কমনওয়েলথ গেমসে বিন্দ্রাকে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে পরাজিত করেছিলেন। কমনওয়েলথে বাংলাদেশি শুটারের কাছে পরাজিত বিন্দ্রাই ৬ বছর পর ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতেন। তাই বিন্দ্রা-আসিফ দুই চরিত্র ভারতীয় উপমহাদেশের শুটিংয়ে সমান্তরলভাবেই চলছে দুই যুগের বেশি সময়।

আসিফ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে তরুণ শুটিং শিক্ষার্থীদের কোচ। শুটিং ফেডারেশনেও নানা ভূমিকায় কাজ করছেন। এক সময়ের সতীর্থের অবস্থা জানার পর এবার প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের মুখে বিন্দ্রা। আপনি শুটিং ছাপিয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের একজন আইকন। সেখানে বাংলাদেশের আসিফ নিজেকে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি! এমন প্রশ্নে শুটার বিন্দ্রা বনে গেলেন দার্শনিক,‘এটাই জীবনের বৈচিত্র্যতা। আসিফ তো খুবই উঁচু মানের শুটার। শেষ পর্যন্ত সেভাবে বিকশিত হতে পারেননি। আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারত।’

বিন্দ্রার জিজ্ঞাসা, ‘আসিফ কেমন আছে? কোথায়- কি করছে?’ আসিফ বাংলাদেশের তারকা শুটার। ২০০২ কমনওয়েলথ গেমসে বিন্দ্রাকে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে পরাজিত করেছিলেন। কমনওয়েলথে বাংলাদেশি শুটারের কাছে পরাজিত বিন্দ্রাই ৬ বছর পর ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতেন। 

আসিফ ছাড়াও বাংলাদেশের শুটিংয়ের প্রতি বিন্দ্রার দুর্বলতা রয়েছে। আসিফের প্রসঙ্গ শেষ হতেই জানতে চাইলেন বাংলাদেশের শুটিংয়ের কেমন অবস্থা-কিভাবে চলছে। বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইন্তেখাবুল হামিদ অপুকেও চেনেন তিনি। ১৯৯০ সালে অকল্যান্ড কমনলওয়েলথে দলগত ও ২০০২ সালে ম্যানেচষ্টার কমনওয়েলথে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ জিতলেও বাংলাদেশের শুটিং প্রত্যাশিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। খেলোয়াড়দের মান, ফেডারেশনের পরিকল্পনার অভাবের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের বড় সহায়তা না পাওয়ায় অন্যতম বড় কারণ।

শুটিংয়ে ভারতের সরকারের আর্থিক অনুদান সম্পর্কে বিন্দ্রার তথ্য, ‘বছরে ৫০-৬০ কোটি রুপি সরকার শুটিংয়ের পেছনে ব্যয় করে। বছর ভেদে সেটা আরো বেশি হয়।’ আর বাংলাদেশে সর্বসাকুল্যে এক কোটিও নয়। রাইফেল, পিস্তল ও গুলির মতো ব্যয়বহুল খেলায় যা একেবারেই অপ্রতুল।

২০০৮ সালে বিন্দ্রা অলিম্পিকে স্বর্ণ পাওয়ার পরই মূলত ভারত শুটিংয়ে জোর দিয়েছে। ভারতের অলিম্পিক ইতিহাসে এতদিন বিন্দ্রাই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ী। টোকিও অলিম্পিকে অ্যাথলেট নিরোজ চোপড়া স্বর্ণ জিতে এখন তার সঙ্গী। নিজের একক অর্জন আর একক না থাকায় যেন অনেক খুশি বিন্দ্রা, ‘আমি ভারতকে প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণ দিয়েছি। গত অলিম্পিকে নিরাজ পেয়েছে। এই অলিম্পিকেও সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে শুটিংয়ে আশা রয়েছে। আমি চাই প্রতি অলিম্পিকেই ভারত অন্তত একটি করে স্বর্ণ জিতুক।’

অভিনব বিন্দ্রা প্যারিস এসেছেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দূত হিসেবে। ১০ আগস্ট আইওসি মেরিট অর্ডার পদকও পাবেন। এ নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া,‘শুটিংই আমার জীবন। শুটিংয়ে অর্জন ও ক্রীড়াঙ্গনের অবদানের জন্য আইওসি এই স্বীকৃতি আমাকে আরো ক্রীড়াঙ্গনের দিকে ধাবিত করবে।’ অভিনব বিন্দ্রা ভারতে শুটিং সেন্টার করেছেন। শুটিং শেখানো ছাড়াও বাচ্চাদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে তার যথেষ্ট নজর। ৬০ হাজারের বেশি স্কুলগামী বাচ্চাদের তিনি চ্যারিটি করেন।

ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সভাপতি রজার বিনি, আগে ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি উষা। দেশ সেরা অলিম্পিয়ান হয়েও দেশের অলিম্পিক কমিটির প্রধান হওয়ার তেমন ইচ্ছেই নেই তার,‘আমি অলিম্পিক পদক জিতেছি ঠিক আছে, ভারতের ক্রীড়া প্রশাসনে আরো অনেক সিনিয়র ও দক্ষ সাবেক ক্রীড়াবিদ রয়েছেন তারা সে পদে আগে বসুক। আমি শুটিং ও চ্যারিটি নিয়েই আছি।’

শুটিং কমপ্লেক্সের বাইরে বিন্দ্রার পাশে ছিলেন সাবেক টেনিস খেলোয়াড় মনিসা। তিনি ভারতের অলিম্পিক কমিটিতে আছেন। বিন্দ্রার মন্তব্য শুনে মুখায়বে প্রকাশ করলেন বিন্দ্রা পদ-পদবীর জন্য নির্লিপ্তই। এজন্যই বিন্দ্রারা একটি খেলার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের আইকন হন আর বাংলাদেশের সাকিবরা...।

এজেড/এফআই