অলিম্পিকে ইসরায়েলের জন্য বাড়তি আয়োজন, দানা বাঁধছে ক্ষোভ!
মালির বিপক্ষে পার্ক দে প্রিন্সেসে খেলতে নেমেছে ইসরায়েল। অলিম্পিকের ফুটবল ইভেন্টের বিচারে খুব বড় কোন ম্যাচ নয়, একথা যেকোনো ফুটবল ভক্তই মেনে নেবেন অকপটে। কিন্তু ‘ডি’ গ্রুপের এই ম্যাচ খবরের শিরোনাম হয়েছে ভিন্ন এক কারণে। পুরো ম্যাচে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে রাখা হয়েছিল ১ হাজার বাড়তি পুলিশ সদস্য। ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই এমন ব্যবস্থা নিয়েছে আয়োজক ফ্রান্স।
অবশ্য ইসরায়েলের জন্য পুরো আসরেই এমন বাড়তি নিরাপত্তার বিধান রেখেছে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ সামরিক শক্তি ফ্রান্স। আর এই নিয়ে ক্ষোভ জমেছে ব্যাপক আকারে। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানির পরেও তাদের বাড়তি নিরাপত্তা এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে অলিম্পিকে আমন্ত্রণের বিরোধিতা করেছেন অনেকেই।
বিজ্ঞাপন
সাবেক ফুটবলার এবং রাজনীতি বিশেষজ্ঞ জ্যুলস বয়কফ এবারের অলিম্পিককে ‘বিগত এক দশকে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় সবচেয়ে আক্রমণাত্মক আসর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর পেছনে অবশ্য আছে ব্যাখ্যাও। ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের কারণে অলিম্পিকে রাশিয়ার জাতীয় সংগীত না বাজানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও একই অভিযোগ থাকলেও ইসরায়েলের ওপর এমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না আয়োজক দেশটি।
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলের অ্যাথলেটদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। ফিলিস্তিনপন্থী ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপ সেবারে ৯ ইসরায়েলি অ্যাথলেটকে জিম্মি করে। পরবর্তীতে পশ্চিম জার্মান সরকারের পুলিশি অভিযান চালানো হলে ৯ বন্দী অ্যাথলেট, ৫ আক্রমণকারী এবং ১ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এরপর থেকেই অলিম্পিকে ইসরায়েল নিজেদের অ্যাথলেটদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। যার সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছে ফ্রান্স পুলিশের নিরাপত্তা।
আগামী শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে অলিম্পিকের উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও তাই এখন থেকেই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে প্যারিস অলিম্পিক। আর সেই বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক। এবারের আসরে নেই রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি। বাদ পড়েছেন রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত বেলারুশও। দুই দেশ মিলিয়ে কেবল ১৬ জন অ্যাথলেট থাকছেন অলিম্পিকে। তারা অবশ্য খেলবেন নিরেপেক্ষ হিসেবে। রুশ আগ্রাসনে সমর্থন না দেয়ায়ত নিরেপেক্ষ বিবেচনায় তাদের অলিম্পিকে আসার সুযোগ করে দিয়েছে ফ্রান্স।
আরও পড়ুন
বিতর্কের অন্য এক কারণ হিজাব নিষেধাজ্ঞা। এবারের আসরে কোনো ফ্রেঞ্চ মুসলিম নারী ক্রীড়াবিদ হিজাব পরিধান করে খেলায় অংশ নিতে পারবেন না বলে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে ফ্রান্স। অন্য দেশের ক্রীড়াবিদরা হিজাব পরিধান করতে পারবেন। তবে ফ্রান্সের সেক্যুলার আইন দেশটির সব মুসলিম নারী ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরইসঙ্গে ফ্রান্সে অবস্থানকারী অভিবাসীদের ক্যাম্পে কোনো ক্রীড়াবিদ ভ্রমণ করতে পারবেন না বলেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সব দেশের ক্রীড়াবিদের জন্য প্রযোজ্য। দুটো সিদ্ধান্তই মুসলিম ক্রীড়াবিদদের বিপক্ষে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেকেই।
অবশ্য এসবের একেবারেই বিপরীত অবস্থানে আছে ইসরায়েল। দেশটি থেকে এবারে ৮৮ জন অ্যাথলেট অলিম্পিকে অংশ নেবেন। তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা নিরাপত্তাকর্মী। ইসরায়েলের সব অ্যাথলেটকে ২৪ ঘণ্টা ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী দেবে ফ্রান্সের এলিট পুলিশ বাহিনী। অলিম্পিক ভিলেজ কিংবা ভিলেজ ছেড়ে অ্যাথলেটরা বাইরে গেলেও তাদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মী থাকবেন।
এর আগে, গাজায় যুদ্ধের প্রতিবাদে ইসরায়েলকে প্যারিস অলিম্পিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল ফিলিস্তিন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) প্রধান টমাস বাখ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ফিলিস্তিনের এই দাবি নাকচ করে দেন। বাখ নিজেকে ‘রাজনৈতিক ব্যবসা’য় জড়াবেন না জানিয়ে বলেছেন, ‘আইওসির অবস্থান খুব পরিষ্কার। আমাদের দুটি জাতীয় অলিম্পিক কমিটি আছে। বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে এটাই পার্থক্য এবং এ বিষয়ে তারা শান্তিপূর্ণভাবে সহ–অবস্থান করছে।’
এবারের আসরে নেই রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি। বাদ পড়েছেন রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত বেলারুশও। দুই দেশ মিলিয়ে কেবল ১৬ জন অ্যাথলেট থাকছেন অলিম্পিকে। তারা অবশ্য খেলবেন নিরেপেক্ষ হিসেবে। রুশ আগ্রাসনে সমর্থন না দেয়ায়ত নিরেপেক্ষ বিবেচনায় তাদের অলিম্পিকে আসার সুযোগ করে দিয়েছে ফ্রান্স।
ফ্রান্সের টিভি চ্যানেল ‘ফ্রান্স ২’কে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ বলেছেন, ‘আমাদের দেশে ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের স্বাগতম। তাদের অবশ্যই নিজ পতাকার অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে, কারণ অলিম্পিক মুভমেন্ট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
ফ্রান্সের এমন নীতি অবশ্য রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না। রুশ অ্যাথলেট নিষিদ্ধ হয়েছেন, সেইসঙ্গে রাশিয়ান কোনো গণমাধ্যমকর্মীকেও এবারের অলিম্পিকে প্রবেশ করতে দেয়নি ফ্রান্স এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। আয়োজক দেশের বিশ্বাস, সাংবাদিকতার নামে তাদের দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারে রুশ সাংবাদিকরা।
ফ্রান্সের বামপন্থী আইনপ্রণেতা থমাস পর্টেস সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গত শনিবার এক প্রো-ফিলিস্তিন র্যালিতে অংশ নিয়ে জানিয়েছেন, ইসরায়েলের কূটনীতিকরা ফ্রান্সের মাটিতে আমন্ত্রিত না। তিনি ফ্রান্সের সরকারকে নিজেদের ‘দ্বিমুখী নীতি’ থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানান। একইসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘রাশিয়ার মতো’ ইসরায়েলের পতাকা এবং জাতীয় সংগীতও অলিম্পিকে নিষিদ্ধ করা দরকার।
এতকিছুর পরেও অবশ্য ফিলিস্তিনের পক্ষে মন্তব্য ঠেকিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে ফ্রান্সের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলকে নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে ফ্রান্সের সক্রিয় গোষ্ঠী ইউরোপ্যালেস্টাইন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গাজায় ‘গণহত্যা’র প্রতিবাদে স্টেডিয়ামের ভেতরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
জেএ