অলিম্পিক ছাপিয়ে যেন ইন্টারনেট!
প্যারিসে পর্দা উঠার অপেক্ষায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসর অলিম্পিকের। একজন ক্রীড়াবিদ, কোচ ও সংগঠকের অলিম্পিক নিয়ে থাকে নানা পরিকল্পনা। সাংবাদিকদেরও ঠিক তেমনি। নানা তথ্য-উপাত্ত, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও স্বাগতিক দেশের আয়োজক কমিটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তথ্যের আদান-প্রদান করতে হয়। গত ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত। ইন্টারনেট আওতার বাইরে থাকায় প্যারিস অলিম্পিকগামী সাংবাদিকদের কপালেও ছিল চিন্তার ভাঁজ।
অলিম্পিক গেমসের আনুষ্ঠানিকতা অন্য যে কোনো ক্রীড়া আসরের চেয়ে বেশি। গেমস শহরে পৌঁছানোর আগে কিছু রীতি-নীতি অনুসরণ করতে হয়। বিভিন্ন দিনের সূচির কর্মকাণ্ডের নির্দেশনাও আসে সাধারণত ই-মেইলে। নির্দিষ্ট সময়ে রেজিস্ট্রেশন না করলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট কাভারের সুযোগ মেলে না। তাই ইন্টারনেট না থাকায় সাংবাদিকদের মনে একপ্রকার উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সমস্যার সময় আবার বৈশ্বিকভাবে মাইক্রোসফটের সফটওয়্যারেও সমস্যা। বিশ্বজুড়ে অনেক ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকেও কয়েকটি ছিল বাতিলের তালিকায়।
বিজ্ঞাপন
তাই অলিম্পিকগামী ক্রীড়াবিদ-সংগঠক, সাংবাদিকরাও ছিলেন একপ্রকার উৎকন্ঠায়। ফ্লাইট ঠিক থাকবে তো? নানা সংকট ও প্রতিবন্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশের প্যারিস অলিম্পিকগামীদের ফ্লাইট জটিলতা হয়নি। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। ওইদিন রাতেই প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশের শেফ দ্য মিশন ইন্তেখাবুল হামিদ অপু রওনা হন। এরপরের দিন রওনা হয়েছেন আরচ্যার সাগর ইসলাম, শুটার রবিউল ইসলাম ও তাদের কোচরা। প্যারিসে পৌঁছানোর পর তারাও বাংলাদেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট তো নেই-ই। সরাসরি মোবাইল কলেও দেশে যোগাযোগ কষ্টসাধ্য ছিল। অনেক কষ্টে নানা মাধ্যম হয়ে জানা গেছে, তারা ঠিকমতো গেমস ভিলেজে পৌঁছেছেন ও অনুশীলন করছেন।
ক্রীড়াবিদ ও কোচরা থাকেন গেমস ভিলেজেই। তাদের আবাসনের সুন্দর বন্দোব্যস্ত থাকলেও বিশেষত সাংবাদিকদের বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো ইভেন্টে বড় ভাবনার নাম আবাসন। প্যারিসে অলিম্পিক উপলক্ষ্যে আবাসন সংকটও চূড়ান্ত সীমায়। প্যারিস রওনা হওয়ার দিন চারেক আগে বাংলাদেশ অনেকটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিশ্ব থেকে। তাই প্যারিসের আবাসন নিয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিকের সংকট আরো প্রকট হয়। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ও সংকট নিয়েই ২১ জুলাই মধ্যরাতে পাঁচ সাংবাদিকের প্যারিস রওনা হন। পাঁচজনই কাতার এয়ারওয়েজের যাত্রী হওয়ায় দোহায় ট্রানজিট। দোহা বিমানবন্দরের একজন স্টাফ বাংলাদেশি দেখেই বিস্মময়াখা কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘ঢাকা কী এখনো ইন্টারনেট আওতার বাইরে!’
দোহা বিমানবন্দরে ফ্রি-ওয়াইফাই থাকায় তিন দিন পর ইন্টারনেটের সংস্পর্শ। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতেই একেবারে ভিন্ন এক আবহ। প্রবাসে বসবাসরত বন্ধু, সহকর্মীদের উৎকন্ঠাময় পোস্ট। পরিবার-পরিজন,বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই দিন তিনেক। গণমাধ্যম-সামাজিক মাধ্যম ও মোবাইল কল কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে না পেরে অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ। দোহা ট্রানজিটে থাকাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধু, প্রবাসে থাকা অনেক সাবেক ক্রীড়াবিদের ফোন-মেসেজে ইনবক্স ভারী হয়ে উঠল। বিমান ভ্রমণে ট্রানজিট অপেক্ষা ও বিরক্তির অংশ হলেও এবার যেন চোখের পলকেই কেটে গেল ঘণ্টা তিনেক।
ঢাকা থেকে দোহার ফ্লাইট পাঁচ ঘন্টা হলেও দোহা থেকে প্যারিসের ফ্লাইট একটু দীর্ঘ। ফ্লাইটের এই অংশে আবার বিমানের মধ্যেই এক ঘণ্টার ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করেছে কাতার এয়ারওয়েজ। ফ্লাইটরত অবস্থায় ইন্টারনেট পাওয়া চরম বিলাসিতা উপভোগ্যতার চেয়ে গভীর বেদনায় বেশি ভর করল। আর কয়েক ঘণ্টা পর অন্য প্রবাসীদের মতো আমরাও বাংলাদেশে যোগাযোগ করতে পারব না।
প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে নেমেই অলিম্পিকের আবহ। বিমানবন্দরেই অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ভেলিডেট প্রক্রিয়া সম্পন্ন। এরপর যে যার আবাসিক গন্তব্যে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উপশহর লা কর্নোভ। ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের অধিকাংশের আবাস এই এলাকায়। গেমস কাভার করতে আসা সাংবাদিকের দেখে প্রবাসীদের অনবরত প্রশ্ন, ‘ভাই দেশে নেট ঠিক হবে কবে? দেশে আসলে কি অবস্থা? কি চলছে একটু বলেন তো ?’ আবেগমিশ্রিত প্রশ্নের যুক্তি ও ব্যাখ্যা নির্ভর উত্তর দিতে দিতেই আবার আবেগাক্রান্ত প্রবাসীরা বলতে থাকেন, ‘মায়ের সঙ্গে কথা হয় না তিন দিন, জানি না বাচ্চারা কেমন আছে!’
টক হোম নামে একটি বিশেষ অ্যাপ রয়েছে। যা দিয়ে দেশে কথা বলা যায়। সেই অ্যাপে দিনভর চেষ্টা করেও প্যারিসের অনেকে বাংলাদেশ থেকে প্রিয়জনের কণ্ঠ শুনতে পারেননি অনেকে। যাদের ভাগ্য একেবারে সুপ্রসন্ন তারা কয়েক সেকেন্ড/মিনিট কথা বলতে পেরেছেন। এরপর আবার নেটওয়ার্ক সমস্যা। সাংবাদিকরা পেশাগত কাজে ও দায়িত্বে আবেগ দূরে ঠেললেও দিন-শেষে তারাও রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। লা কর্নোভে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নানা প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার মধ্যে নিজেদের মনেও উঁকি দিচ্ছে, ‘আমার পরিবার-অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করব কিভাবে।’
দেশের বাইরে গেলে পরিবার সব সময় থাকে উৎকণ্ঠায়। ঠিকমতো পৌঁছেছে তো? তাই যে দেশেই পৌঁছে সবাই বাসায় খবর দেওয়ার চেষ্টা করে ঠিক আছে সব কিছু। প্যারিসে এসে এবার সেই উপায় ছিল না। ২২ জুলাই প্যারিস সময় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও ঢাকায় কোনো খোঁজ-খবর দেয়া যায়নি। ১৭ ঘণ্ঠার বেশি ভ্রমণক্লান্তিতে চোখে ঘুম ভর করলেও পরিবার-সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগহীনতায় কাটল বিনিদ্র রাত। গ্রীষ্মকালীন সময়ে প্যারিসে সূর্য ডুবছে রাত দশটার পর আবার উঠছে ভোর পাঁচটার আগেই।
গতকাল ২৩ জুলাই ভোরের আলো ফুটে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই প্যারিসের প্রাণকেন্দ্র পোরতে ম্যালিয়তে অবস্থিত মেইন প্রেস সেন্টারের উদ্দেশে যাত্রা। লা কর্নোভ থেকে দুই মেট্রো বদলে ম্যালিয়ত পৌঁছাতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগেনি। সুবিশাল ভবনে দেখা গেল বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার সাংবাদিক-ফটোসাংবাদিক-ভিডিওগ্রাফারের উপস্থিতি। কেউ ভিডিও পাঠাচ্ছেন, কেউ লিখছেন। অন্য দেশের সাংবাদিদের এই ব্যস্ততা দেখে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের একটু অন্য রকমই লাগল।
ইন্টারনেট না থাকায় বাংলাদেশি সাংবাদিকদের নিউজ প্রেরণ নিয়ে নেই ব্যস্ততা। বাংলাদেশে ইন্টারনেট নেই, ছাত্র আন্দোলন-সহিংসতা চলছে। এ খবর দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব মিডিয়াতেও প্রচার হয়েছে। প্যারিস অলিম্পিকের মিডিয়া সেন্টারে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের পেয়ে তাই অন্য দেশের সাংবাদিকদেরও নানা জিজ্ঞাসা। অন্য দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে করতেই মেইন প্রেস সেন্টারে দেখা ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন এআইপিএসের সভাপতি মারলোর সঙ্গে। তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর পেশায় ইন্টারনেটহীন অবস্থায় অলিম্পিকের মতো আসরে আসা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মানসিক অবস্থা সহজেই বুঝলেন। প্যারিস থেকে দেশে নিউজ পাঠানোর কোনো মাধ্যম নেই তাই মিডিয়া সেন্টার থেকে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা গেমসের আনুষ্ঠানিকতা ও তথ্য সংগ্রহে অন্যান্য স্পট পরিদর্শনে।
প্যারিস সময় বিকেল তিনটা-চারটার (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা-আটটা) দিকে সামাজিক মাধ্যমে সুখবর। পাঁচ দিন পর ইন্টারনেট সেবা ফিরে এসেছে সীমিত পরিসরে। মোবাইল ডাটা না থাকলেও ব্রডব্যান্ডের গ্রাহকরা ইন্টারনেট পেয়েছেন কিছু কিছু জায়গায়। এই খবর পেয়ে প্যারিসে বাংলাদেশি প্রবাসীরা একটু হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে পারলেও অনেকে আবার খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর দেশে যোগাযোগ করতে পেরেছে। প্রবাসীদের চোখে-মুখে স্বস্তি দেখে বাড়তি প্রশান্তি লাগল। দেশে ইন্টারনেট ফিরে আসায় অলিম্পিক কাভার করতে আসা সাংবাদিকদেরও যেন প্রাণ ফিরল!
এজেড/এফআই