খেলাধুলার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ক্রিকেট বাদে বাংলাদেশের অন্য সকল ফেডারেশন আর্থিকভাবে দুর্বল। ফেডারেশনের নিজস্ব কোনো আয়-ও নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বার্ষিক অনুদানের ওপরই নির্ভরশীল তারা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোকে গড়পড়তা পরিচালন ব্যয় ১৫-২৫ লাখের মতো বরাদ্দ করা হয়। ফলে কোনো কোনো এসোসিয়েশনের বরাদ্দ এক লাখের নিচেও রয়েছে। পরিচালন ব্যয়ের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও আয়োজন এই দুই খাতেও বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে আসছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রশিক্ষণ ও আয়োজন বাবদ ৫৯ ফেডারেশন/এসোসিয়েশনকে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ০.২৭৮ শতাংশ বেশি। সাড়ে ১৭ কোটির মধ্যে প্রশিক্ষণ খাতে ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৩৯ হাজার আর প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এই দুই খাত মিলিয়ে একমাত্র আরচ্যারি ফেডারেশনের বরাদ্দ এক কোটি ২ লাখ  টাকা। প্রশিক্ষণে ৭২ লাখ এবং খেলাধুলা আয়োজনে ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ। 

আরচ্যারি টানা দুই অলিম্পিকে সরাসরি খেলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নিয়মিত পদক ও সাফল্য আনছে ইভেন্টটি। তাই একমাত্র আরচ্যারির বরাদ্দ কোটির ওপরে হলেও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। আরচ্যারির পরে বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের। প্রশিক্ষণে ৫৭ আর আয়োজনে ৩৮ লাখ মিলিয়ে মোট বরাদ্দ ৯৬ লাখ। অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, দাবা, শ্যুটিং এবং হকির মতো জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করা ডিসিপ্লিনের বরাদ্দ রোলার স্কেটিংয়ের চেয়ে ২০-৩০ লাখ কম। 

ফুটবল ও ক্রিকেটের পর দেশের সবচেয়ে বড় খেলা ও ফেডারেশন হিসেবে স্বীকৃত হকি। সেই হকি ফেডারেশনের জন্য প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ মাত্র ১১ লাখ। অথচ অপ্রচলিত ও অজনপ্রিয় খেলা ব্রিজে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ ১৭ লাখ। গতকাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী সভায় হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ এই অসঙ্গতির বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন।

অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই ডিসিপ্লিন। সেই দুই ডিসিপ্লিনে প্রশিক্ষণ ও আয়োজন মিলিয়ে বরাদ্দ যথাক্রমে ৭৪ ও ৭২ লাখ। অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টু বরাদ্দের বৈষম্য সম্পর্কে বলেন, ‘অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতারের মতো খেলায় আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। আমরা এশিয়ান পর্যায়ে (ইনডোরে) একটি স্বর্ণ এনেছি। এরকম আরও স্বর্ণ আনতে অ্যাথলেটদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় খেলায় বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে অন্যত্র বাড়ানোটা সমীচীন নয়।’

সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এমবি সাইফ বলেন,‌ ‘আমরা বছরে প্রায় ৯-১০ মাস প্রশিক্ষণে রাখি শীর্ষ সাঁতারুদের। ১০ মাসে পুলের বিদ্যুৎ বিলই আসে ৩০-৪০ লাখ টাকা। সাঁতারুদের খাবার, কোচদের বেতন ও আনুষঙ্গিক মিলিয়ে ব্যয় কোটি টাকার ওপর। সেখানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রশিক্ষণ বরাদ্দ অর্ধেকেরও কম। এরপরও আমরা কষ্ট করে অনুশীলন চালিয়ে যাই।’

দাবা ফেডারেশনে প্রতি মাসেই একাধিক টুর্নামেন্ট চলে এবং প্রতি মাসেই বিদেশ ভ্রমণ করেন দাবাড়ুরা। সেই দাবা ফেডারেশনে বরাদ্দ মাত্র ৩০ লাখ (প্রশিক্ষণ ১০ লাখ ও আয়োজন ১৯)। যা একেবারেই অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম, ‘আমাদের দাবা অলিম্পিয়াড ও বিশ্বকাপে যেতেই ৩০ লাখের বেশি ব্যয় হয়। সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের বিদেশে প্রেরণ না করলে নর্ম হয় না ও রেটিং বাড়ে না। দাবা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম সফল ডিসিপ্লিন। অন্য ফেডারেশনের বরাদ্দ কম-বেশি নিয়ে মন্তব্য না করে বলবো দাবায় আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল।’

দাবার মতো খেলায় প্রশিক্ষণ বরাদ্দ মাত্র ১০ লাখ হলেও উশু-রোলার স্কেটিংয়ের মতো অজনপ্রিয় খেলার জন্য ৪২ ও ৫৭ লাখ, তখন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। জাতীয় খেলা কাবাডি গত কয়েক বছর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কাবাডিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলেও এশিয়ান গেমসে চরম ব্যর্থ। এরপরও সেই কাবাডি ফেডারেশনের বরাদ্দ তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮৬ লাখ। 

ফেডারেশনগুলোর সাধারণ সম্পাদকের নিয়ে একটি সংগঠন রয়েছে। সেই জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ফোরামের সভাপতি আসাদুজ্জামান কোহিনুর। যার ফেডারেশনগুলোর যৌক্তিক প্রাপ্যতা নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সঙ্গে বাজেট সংক্রান্ত বিষয়ে নিবিড় সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন ছিল। তিনি গতকাল বাজেট সভার (হ্যান্ডবল ফেডারেশন আমন্ত্রিত ছিল না) পর আজ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কর্তাদের কাছে নিজের ফেডারেশনের প্রশিক্ষণ ও আয়োজন দুই খাতেই বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে এসেছেন। ২৫ বছরের বেশি সময় সাধারণ সম্পাদক থাকলেও এখনও আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবলে (সিনিয়র পর্যায়ে) বাংলাদেশ দলকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। নিজের ফেডারেশনকে যেখানে সফল করতে পারেননি, সেখানে তার নেতৃত্বে সকল ফেডারেশনের স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত হয় প্রশ্ন থেকেই যায়।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রশিক্ষণ ও আয়োজনের বরাদ্দের বৈষম্য ও যৌক্তিকতা নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে চরমভাবে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নতুন সচিব আমিনুল ইসলাম এসেছেন মাত্র মাস ছয়েক হয়েছে। উত্থাপিত প্রশ্নের যৌক্তিকতা মানলেও সমাধান তার হাতে নেই। এরপরও পুনর্মূল্যায়নের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘কাল নির্বাহী সভায় এটি আলোচনা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে আলাপ করব এবং আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি অধিকতরভাবে খতিয়ে দেখছে।’

ক্রিকেট বোর্ড আশি-নব্বইয়ের দশকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। জাতীয় দলের বিদেশি কোচের বেতন দেওয়া হতো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে। সময়ের বিবর্তনে এখন ক্রিকেট বোর্ড এনএসসির আর্থিক কোনো সহায়তা নেয় না। দেশের আরেক শীর্ষ ফেডারেশন ফুটবলে গত তিন অর্থবছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ উন্নয়ন ও আয়োজন বাবদ বরাদ্দ করে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২০ কোটি টাকা দিয়েছিল। সেই আমানতের বিপরীতে সুদ দিয়ে উন্নয়ন ও আয়োজন করার কথা ছিল ফুটবলের। তাই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফুটবল ফেডারেশনকে পরিচালন ব্যয় ছাড়া প্রশিক্ষণ ও আয়োজন খাতে অর্থ বরাদ্দ করে না। যদিও ফুটবল ফেডারেশন সরকারের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। স্থায়ী আমানত খরচ করেছে তারা।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি বরাদ্দ পায়। সরকারি সেই বরাদ্দের ভিত্তিতেই মূলত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোকে পরিচালন, প্রশিক্ষণ ও খেলাধূলার জন্য অনুদান প্রদান করে। সরকারি এই ক্রীড়া মঞ্জুরি খাতে বেশি বরাদ্দ না দেওয়ায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও ফেডারেশনের চাহিদা পরিপূর্ণ করতে পারে না। অর্থ মন্ত্রণালয় খাতভিত্তিক বরাদ্দ প্রদান করায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সেখানে তেমন কিছু করার থাকে না। নতুন অর্থবছরের আগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পর্যালোচনা করে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোন ফেডারেশনে কত বরাদ্দ, সেই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পেশ করতে পারে। তাই ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ ফেডারেশনগুলোকে নতুন অর্থবছরের মাস ছয়েক আগেই সামনের বছরের সূচি চেয়েছেন। তিনি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এটি বলে আসছেন। এরপরও কেন যেন ফেডারেশন-জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে।

এজেড/এএইচএস