বাংলাদেশের দাবার তৃতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার। আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই স্কুলজীবন থেকে অদ্যবধি তাদের বন্ধুত্ব। মৃত্যুই সেই বন্ধুত্বের ছেদ ঘটাল। বন্ধুকে নিয়ে বন্ধুর লেখা অনুলিখন করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের-

জিয়ার সাথে আমার পরিচয় স্কুল থেকেই। আমি ও জিয়া দুই জনই সেন্ট জোসেফের ছাত্র ছিলাম। জিয়া অবশ্য সপ্তম শ্রেণীর পর গভঃল্যাবটেরী স্কুলে যায়। জিয়া সিটি কলেজ আমি নটরডেমে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার আমরা একই বিভাগে। আমি নৃবিজ্ঞান-জিয়াও নৃবিজ্ঞান। আমার ও জিয়া দুই জনেরই জন্ম ১৯৭৪ সালে। এরপরও একাডেমিকে শুরু থেকে আমি ওর চেয়ে এক বছর সিনিয়র ছিলাম। আমাদের সম্পর্ক কখনোই সিনিয়র-জুনিয়র ছিল না। একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিষয় নেয়ায় জিয়াও পরের বছর নৃবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিল। 

১৯৮৩ সালে আমি দাবা ফেডারেশনে প্রথম খেলতে আসি। আমি আসার কিছু দিন পর জিয়াও আসে। প্রায়ই জিয়া আমাকে বলতেন, ‘তুমি দাবায় আমার অল্প দিনের সিনিয়র।’ আমার অবশ্য দাবার ইতিহাস, রেকর্ড ও নানা ঘটনা তেমন মনে থাকে না। অনেক ঘটনাই জিয়ার কাছে জানতে চাইতাম, ‘বল তো জিয়া, এটা কখন, কিভাবে হয়েছিল।’ জিয়া একেবারে হুবুহু বলত। 

দেশের দাবার পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার, সবার আগে বিদায় জিয়ার; ছবি - সংগৃহীত

৪১ বছরের বন্ধুত্ব। আমার জীবনের একটাই অংশই যেন জিয়া। অসংখ্য স্মৃতি-ঘটনা। জিয়া ও আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম সময় ছিল নব্বইয়ের দশকের দিকে। আমরা অসংখ্যবার কলকাতায় টুর্নামেন্ট খেলেছি। বাংলাদেশ থেকে কেউ তখন কলকাতায় গেলে সেটা আমি আর জিয়াই ছিলাম সবচেয়ে বেশি। কত অসংখ্য দিন, রাত এক সঙ্গে দেশে-দেশের বাইরে কাটিয়েছি। গল্প-আড্ডার অধিকাংশই দাবা ঘিরে। 

নব্বইয়ের দশকে আমরা দুই জনই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। তখন আমাদের দুই জনের চোখে স্বপ্ন নিয়াজের পর গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। গ্র্যান্ডমাস্টার হতে নর্ম, রেটিং নানা বিষয়। এসব অর্জন করতে প্রয়োজন টুর্নামেন্ট খেলা। বিদেশে টুর্নামেন্ট খেলা মানেই অর্থ, ভিসা নানা বিষয়। কত দিন-রাত আমি আর জিয়া কোন টুর্নামেন্ট খেলব, কত টাকা আছে, স্পন্সর কোথায় কত দিন-রাত যে আমাদের এ রকম পরিকল্পনায় কেটেছে। অনেক সময় অতি স্বল্প বাজেটেও সাহস করে বিদেশে খেলেছি। অনেক কষ্ট করে দিন পার করেছি। আবার কখনো শেষে প্রাইজমানি পেয়ে আবার বিশাল উল্লাসও করেছি। সুখ-দুঃখের সব কিছ্রুই সঙ্গী ছিল জিয়া।

নিয়াজ ভাইয়ের পর জিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার হয়।  তখন আমিও আত্মবিশ্বাস পেলাম বন্ধু জিয়া হতে পারলে আমিও পারব। জিয়াও আমাকে সর্বাত্মক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, ‘তুমিও পারবে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে। চেষ্টা করো অবশ্যই হবে।’ এরপর আমিও একদিন গ্র্যান্ডমাস্টার হই। জিয়ার পরপরই আমি এটাও বড় তৃপ্তি।

গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর দাবায় আর সেভাবে মনোযোগ রাখতে  পারিনি। পেশাগত দায়িত্ব ও ব্যস্ততায় মাঝে মধ্যেই দাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। জিয়া প্রায়ই ফোন করে বলত, ‘রিফাত এই টুর্নামেন্ট খেলবে নাকি, আসো এক সঙ্গেই খেলি।’ দাবার আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও অন্তত জিয়ার সঙ্গে আমার কথা হতোই। আমরা একই বিভাগে আবার দুই জনই গ্র্যান্ডমাস্টার। ব্যক্তি ও সামাজিক আড্ডায় আমার ও জিয়ার প্রসঙ্গ পাশাপাশিই আসত। রিফাত ও জিয়া যেন একে অন্যের পরিপূরক।

প্রতিবেদকের সঙ্গে চার গ্র্যান্ডমাস্টার, সবার ডানে জিয়া। মাঝে প্রতিবেদক, বাম থেকে দ্বিতীয় রিফাত

সময়ের পরিক্রমায় আমি ও জিয়া দুই জনই বিয়ে করলাম। পারিবারিক দায়িত্ব বাড়ল আমাদের বন্ধুত্ব কমেনি, বরং বেড়েছে। আমাদের দুই বন্ধুর মতো আমাদের স্ত্রীরাও ভালো বন্ধু হয়ে উঠে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এমনও হয় আমার ও জিয়ার সরাসরি কথা না হলেও স্ত্রীদের মাধ্যমে জেনে যাই আমি করছি, জিয়া কি করছে।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাবা এখনো পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়ার পর্যায় আসেনি। গ্র্যান্ডমাস্টারদের মধ্যেই জিয়াই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ পেশাদার। দাবাই তার জীবন। দাবার প্রতি জিয়ার ভালোবাসা-নিবেদন অন্য অনেকের চেয়ে আমি একটু বেশি জানি। দাবায় যতক্ষণ জিয়া থাকবে সে সেরাটাই দিবে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। দাবা ছাড়া জিয়ার পৃথিবী শূন্য। 

দাবা ছাড়া জিয়ার পৃথিবী যেমন শূন্য, তেমনি জিয়া ছাড়াও বাংলাদেশের দাবা বড় শূন্যতা। এই শূন্যতা আদৌ পূরণ হওয়ার নয়। কাল যখন সন্ধ্যার দিকে শুনলাম জিয়া আর নেই। তখন আমি বাকরুদ্ধ। আমি ঠিক শুনেছি তো ? ৪১ বছরের বন্ধু জিয়া আমাকে রেখে চলে গেল। এ শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আদৌ পারব কিনা তাও জানি না।

বাঁ থেকে রিফাত, শিপলু ‍ও জিয়া 

চার দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের দাবার সঙ্গে রয়েছি। অসংখ্য দেশি-বিদেশি দাবাড়ু, কোচ-সংগঠক দেখেছি। এত লোকের মধ্যে জিয়াকে সহজেই আলাদা করা যেত। আন্তরিকতা,আচার-আচরণ সব কিছুতেই জিয়া ছিল অনন্য। জিয়ার মতো এমন দাবাড়ু তো বটেই ক্রীড়া ব্যক্তিত্বই খুব কম। অদূর ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। জিয়া শুধু খেলোয়াড়ই নন, কোচ হিসেবেও সফল। কারো কাছে দাবাড়ু জিয়া সেরা, কারো কাছে কোচ। আমার কাছে যে বন্ধু জিয়াই সেরা! 

এজেড/জেএ