৫০ বছর বয়সী গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনে। এই ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন। সেখানকার ক্রীড়াকক্ষে তিনি জাতীয়-আন্তর্জাতিক অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছেন। সেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে আজ (শনিবার) সকালে জিয়া এসেছিলেন নিথর দেহে। সব খেলা মিলিয়ে দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই। 

দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম। জিয়ার চলে যাওয়া দাবার অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে দেখছেন তিনি,‌ ‘অনেকেই টুর্নামেন্টের পুরস্কার ও নানা সুযোগ-সুবিধা কম হলে খেলতে চাইতেন না। জিয়া কখনোই এরকম ছিলেন না। সব টুর্নামেন্টেই তিনি অংশগ্রহণ করতেন। যেন অন্যরা তার মাধ্যমে শিখতে পারে।’ তার জীবনটাই ছিল দাবাময়। দাবা খেলতে খেলতেই চলে গেলেন জিয়া। তাই জিয়ার স্মৃতি ধরে রাখার পরিকল্পনা ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদকের, ‘আমাদের আলাদা একটি ফ্লোর পাওয়ার কথা ছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মধ্যেই। সেখানে গ্র্যান্ডমাস্টার কর্নারের পরিকল্পনা ছিল। সেটা যতদিন না হয় আমরা বর্তমান ক্রীড়াকক্ষই জিয়ার নামকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও উন্নয়ন সেক্টরে চাকরি নেননি। দাবা খেলে এবং কোচিং করিয়েই পরিবার চালিয়েছেন। তার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য বিসিএস ক্যাডারে যোগদান করেননি স্বামীর দাবাপ্রেমের জন্যই। একমাত্র ছেলে তাহসিন তাজওয়ারও ফিদে মাস্টার। বাবা-ছেলে অলিম্পিয়াডও খেলেছেন। জিয়াই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জিয়ার জানাজায় এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম অভিভাবক বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা। বিওএ এবং তিনি নিজ থেকেও জিয়ার পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন,‌ ‘জিয়া শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব দাবা অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন আর্থিক ব্যাপারে তার পরিবারের পাশে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও জিয়ার পরিবারের জন্য আর্থিক-অনার্থিক যেকোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসব।’

দাবা ফেডারেশনের অন্যতম সহ-সভাপতি তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘গতকাল মাননীয় মন্ত্রী (নাজমুল হাসান পাপন) এবং আজ আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের আরেকজন অভিভাবক শাহেদ ভাই (বিওএ মহাসচিব) তার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। একটি বড় আর্থিক অঙ্ক স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) করে পরিবারের একটি সাপোর্ট প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দাবা ফেডারেশন ও আমরা ব্যক্তিগতভাবে নেব।’

জিয়া জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ আনসারের হয়ে খেলেছিলেন। আনসারের হয়ে খেলতে খেলতেই দুনিয়া ছাড়লেন তিনি। আজ জানাজায় আনসারের ক্রীড়া কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের বিধি অনুযায়ী জিয়ার সাহায্য পাওয়ার কথা জানান।

জিয়ার জানাজায় এসেছিলেন দেশের দুই সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার আব্দুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব। গতকাল রাজীবের সঙ্গে খেলতে খেলতেই জিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রাজীবের মাথায় এখনও ঘুরেফিরে সেই স্মৃতি, ‘২৫ চাল পর্যন্ত হয়েছিল খেলার। জিয়া ভাইয়ের পজিশন ভালোই ছিল। একবারের জন্যও মনে হয়নি সে অসুস্থ বা একটু অন্যরকম। তার একটি চাল মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ, কিছুক্ষণ পর বুঝলাম খুবই ভালো চাল ছিল।’ জাতীয় দাবার সর্বশেষ আসরের চ্যাম্পিয়ন গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব। অগ্রজ গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানকে বিশ্লেষণ করলেন এভাবে,‌ ‘সে সবচেয়ে বেশিবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এক সময় তার পজিশনিং অবস্থান ছিল বিশ্বের মধ্যে অন্যতম। ডিফেন্সিভ ওপেনিং-অ্যাটাকিং সবই তার সমান দক্ষতা ছিল। জিয়া ভাই অনেকদিন বলতেন কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্স খেলি না কেন আমি। গতকাল সেটাই খেলছিলাম। খেলাটা আর শেষ হলো না।’

দেশের চতুর্থ গ্র্যান্ডমাস্টার আব্দুল্লাহ আল রাকিব। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি দাবা অঙ্গন থেকে দূরে। প্রায় দুই বছর পর আবারও এই আঙিনায় এসেছেন অগ্রজ জিয়াকে শেষবারের মতো দেখতে। রাকিব সরাসরিই বললেন জিয়া দেশের সেরা দাবাড়ু, ‘বাংলাদেশের সেরা দাবাড়ু জিয়া ভাই। তার শূন্যস্থান পূরণ করার মতো নয়। একজন অতি সুশৃঙ্খল খেলোয়াড় ছিলেন। সব সময় খেলা নিয়ে ভাবতেন। অলিম্পিয়াডে অনেক খেলেছি একসঙ্গে। দেখেছি প্রতিপক্ষ নিয়ে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।’

দেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে জিয়াই সবচেয়ে বেশি নিয়মিত খেলতেন। এরপর রাজীব, তার চেয়েও কম নিয়াজ। রিফাত ও রাকিব দাবা থেকেই বিচ্ছিন্ন। চলমান জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তিন গ্র্যান্ডমাস্টার খেলায় ফিদে মাস্টার মনন রেজা নীড়ের আন্তর্জাতিক নর্ম হয়েছে। জিয়া চলে যাওয়ায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দাবায় অনেক কিছুই অপূর্ণ থাকবে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে রাকিব আসবেন কি না এই প্রশ্নের উত্তর খোলাসা করেননি তিনি, ‘আমি কিছুদিন দাবা থেকে দূরে। আপনাদের সামনে এখনই বলতে পারব না আসব কি আসব না। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে, দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়।’

পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে জিয়া এবং রাজীবই কোচিং করান। কোচ জিয়াও খেলোয়াড় জিয়ার চেয়ে কম নন– অকপটেই বললেন রাজীব, ‘তার বাসায় ভারত থেকে দাবাড়ুরা এসে খেলা শিখত। তার অনেক ছাত্র ভারতে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে, আরও অনেক টাইটেল জিতেছে। কোচ হিসেবেও তিনি অনেক সফল।’

সকাল সোয়া এগারোটার দিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিচে জিয়ার লাশবাহী গাড়ি পৌঁছায়। তাকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছিলেন দাবা অঙ্গনের অনেকেই। জিয়ার পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতার গণ্ডি দাবা ছাড়িয়ে সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গনেই ছিল। তার কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা অলিম্পিক এসোসিয়েশন, দাবা ফেডারেশন, বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস এসোসিয়েশন, দাবা, তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না করলেও জিয়ার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও বিভিন্ন ফেডারেশনের খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া ফেডারেশন ফুটবল (বাফুফে) থেকে কাউকে দেখা যায়নি। 

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনের নিচে জিয়ার লাশ আধঘণ্টার একটু বেশি সময় ছিল। এরপর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের উদ্দেশে নেওয়া। সেখানেই আরেক দাবাড়ু বাবা পয়গম আহমেদের পাশে চিরশায়িত হবেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া।

এজেড/এএইচএস