রাজধানীর শাহবাগ ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে একে একে আসছিলেন দাবা অঙ্গনের সবাই। উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, মনন রেজা নীড়ের সঙ্গে খেলা শেষ করে অন্য কাজে গিয়েছিলেন। জিয়া আর নেই শুনে তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে আসেন হাসপাতালে। 

নিয়াজের পর জিয়াই হয়েছিলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার। বয়সের ব্যবধান দশ হলেও সম্পর্কটা ছোট ভাইয়ের মতোই। জিয়ার মৃত্যুতে একেবারে বাকরুদ্ধ নিয়াজ। কোনো কথাই বলতে পারলেন না। জিয়ার দীর্ঘদিনের বন্ধু আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার। আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরির কারণে তিনি এবারের জাতীয় দাবায় খেলছেন না। জিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে বিস্মিত রিফাত, ‘আমার বন্ধু জিয়া নেই, বিশ্বাসই হচ্ছে না। জিয়া আমাদের ছেড়ে আসলেই এভাবে চলে গেল।’

আজ (শুক্রবার) ১২তম রাউন্ডে জিয়া খেলছিলেন আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই জিয়ার প্রয়াণে একেবারে মুষড়ে পড়েছেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ এই গ্র্যান্ডমাস্টার, ‘জিয়া ভাই আমার সঙ্গে খেলছিল। তার পজিশন ভালোই ছিল। খেলা দুই ঘণ্টারও বেশি পার হয়েছে। হঠাৎ দেখি তিনি কাত হয়ে আছেন। মনে করলাম এমনিই হয়তো। এক মিনিট পরই দেখি তিনি পড়ে গেলেন। এরপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।’

দাবা অঙ্গনের লোকজন বলছিলেন, গত তিন হালকা জ্বর ছিল জিয়ার। উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও হৃদরোগের কোনো সমস্যার বিষয় তাদের কেউ জানতেন না। আকস্মিকভাবেই কাউকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন পরপারে। জিয়ার এমন বিদায়ে দাবা অঙ্গন শোকে কাতর। আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমানের বাবা কেঁদে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ এক রত্ন হারাল। আমার ছেলে ফাহাদ দাবাড়ু হওয়ার পেছনে তার অবদান অনেক। তার মতো দাবাড়ু বাংলাদেশে আর আসবে কি না জানি না।’

দাবা ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক বিচারক হারুনুর রশিদ। দীর্ঘদিন থেকে জিয়ার সঙ্গে তার পরিচয়। জিয়ার বিদায়ে শোকাহত হারুন বলেন, ‘দাবার প্রতি জিয়ার ভালোবাসা ও নিবেদন ছিল অন্য পর্যায়ের। সব সময় দাবা নিয়েই ভাবত। এত নিষ্ঠাবান ও শৃঙ্খল ছিল, জিয়া এভাবে চলে যাবে তা কল্পনাতীত।’

জিয়া শুধু খেলতেনই না, কোচিং-ও করাতেন। তার কোচিংয়ে ভারতের অনেকে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন। দাবা খেলা ও কোচিং নিয়েই জিয়ার জীবন। তার ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়াও দাবাড়ু। বাবা-ছেলে একসঙ্গে অলিম্পিয়াডও খেলেছেন। বাবা যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিলেন, তখন তাহসিন তাজওয়ার অন্য বোর্ডে আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিলের সঙ্গে লড়ছিলেন। জাতীয় দাবার ১২তম রাউন্ডের খেলা চলছিল। জিয়া আট পয়েন্ট নিয়ে এককভাবে দ্বিতীয় স্থানে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মৃদু সম্ভাবনাও ছিল। সকল সম্ভাবনা দূরে ঠেলে তিনি চলে গেছেন পরপারে।  

জিয়ার মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল, ‘জিয়া ভাই আমাদের সঙ্গেই আজ খেলছিলেন। খেলতে খেলতে জিয়া ভাই চলে গেলেন। এটা মানা যায় না।’ জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য, যিনি বিসিএস ক্যাডারে যোগ দেননি স্বামী জিয়ার দাবায় ব্যাঘাত ঘটবে দেখে। তিনি এখনও বিশ্বাস করছেন না জিয়া আর নেই, ‘জিয়া আমাকে রেখে যেতে পারে না। জিয়া ঘুমিয়ে আছে। জিয়া না থাকলে আমারও বাঁচার দরকার নাই।’

হাসপাতালে প্রতিদিনই জন্ম-মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অন্যসব দিনের চেয়ে আজ ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের বিকেল ছিল ভিন্ন। দেশের দাবা এক রত্ন এবং ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হারাল এখানে। তাই হাসপাতাল ও আশেপাশের অনেকেই ভিড় করেছিলেন। সবার ভালোবাসা দূরে ঠেলে জিয়া চলছেন পরপারে!

এজেড/এএইচএস