জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল-এনএসসি) অধীনে দেশের সকল ফেডারেশন, সংস্থা ও ক্রীড়া স্থাপনা। খেলাধুলা চলমান রাখা ও উন্নয়নের জন্য প্রায় প্রতি বছরই এনএসসি ক্রীড়া স্থাপনা নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনের জিমনেশিয়াম জিমন্যাস্টিক্স ও তায়কোয়ান্দোর ভেন্যু (পূর্বে ভারত্তোলন, কুস্তি এবং কারাতেও ছিল)। চলমান টানা বৃষ্টিতে সেই জিমনেশিয়ামে পানি ঢুকে জিমন্যাস্টিক্সের কোটি টাকার সরঞ্জাম নষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনের পেছনের অংশ জিমনেশিয়াম। আয়তনে সুবিশাল হলেও অন্য সুযোগ-সুবিধা একেবারেই সীমিত। আলোকস্বল্পতার পাশাপাশি বাতাস চলাচলও কম। ফলে তীব্র গরমেই জিমন্যাস্ট ও তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড়রা অনুশীলন ও টুর্নামেন্ট খেলেন। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে বর্ষা মৌসুমে যোগ হয়েছে বৃষ্টির পানি। কয়েক বছর ধরেই বৃষ্টির পানি জিমনেশিয়ামের ভেতর প্রবেশ করছে। আগে এটা তেমন শঙ্কার কারণ ছিল না। গত দুই বছরে জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন কয়েক কোটি টাকার সরঞ্জাম এনেছে ও ভেন্যু জিমন্যাস্টিক্স উপযোগী করেছে। তবুও বৃষ্টির পানিতে ধীরে ধীরে নষ্টের পথে জিমন্যাস্টিক্সের মূল্যবান সরঞ্জামাদি।

এ নিয়ে জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জামিল বলেন, ‘অনেক কষ্টে আমরা ২০২২ সালে ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করে এখানে জিমন্যাস্টিক্স অনুশীলন উপযোগী করেছি। আমরা উন্নত মানের সরঞ্জাম পেয়েছি আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশনের সহায়তায়। এরপরও ট্যাক্স ও আনুষাঙ্গিক ব্যয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। অনুশীলনের জায়গাই নেই, স্টোরের প্রত্যাশা করা বাহুল্য। তাই কষ্ট করে এখানেই মালামাল রাখি। বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজছে। এভাবে ভিজতে থাকলে অচিরেই কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হবে।’

জিমনেশিয়ামের কোল ঘেষেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নতুন সুরম্য ভবন। সেই ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে ময়লা পড়ে জিমনেশিয়ামের এক প্রান্তের কোণায়। সেই ময়লার স্তূপ জমে বৃষ্টির পানি সহজেই নামতে পারে না। জমে থাকা পানি দীর্ঘক্ষণ দেয়াল চুয়ে প্রবেশ করে ভেতরে। ভিজতে ভিজতে দেয়ালও স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রশাসন শাখার দাবি– জিমনেশিয়ামের ছাদ পরিষ্কার করতে গিয়ে অনেক ক্লিনার আহতও হয়েছেন। ক্রমাগত ময়লা ফেলায় এই সমস্যা থেকেই যায়। এনএসসির নতুন ভবনে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভবনের মালিক এনএসসি ভাড়াটিয়াদের কড়াকড়ি আরোপ করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজেদেরই সম্পদ নষ্টের মুখে। 

জিমনেশিয়ামের ভেতর আলো-বাতাসের জন্য বেশ কয়েকটি পয়েন্টে এডজাস্ট ফ্যান রয়েছে। সেই ফ্যানের কয়েকটি ভেঙে যাওয়ায় শূন্য জায়গা দিয়ে পানি সরাসরিও ঢুকে পড়ে। দুয়েক জায়গায় জিমন্যাস্টিক্স ফেডারশেন বালতিও রেখেছে যেন পানি ছড়িয়ে না যায়। জিমনেশিয়ামের সামনেই পুরাতন ভবনে বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের কার্যালয়। সেখানেও বৃষ্টির দিনে বারান্দায় পানিতে সয়লাব হয়।

ক্রীড়া স্থাপনা–কার্যালয় রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে জিমনেশিয়ামের সমস্যার বিষয়টি অসংখ্যবার বলেও প্রতিকার পায়নি বলে জানান জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহমেদুর রহমান বাবলু, ‘এই জিমনেশিয়ামে অনেক সমস্যা। আলো, বাতাস, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ সব কিছুই মৌখিক ও লিখিতভাবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে অবহিত করা হয়েছে। তেমন কোনো প্রতিকারই নেই।’

১৯৬২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবন ও জিমনেশিয়াম একসঙ্গে সৃষ্টি। ১৯৬৪ সাল থেকে অদ্যাবধি এই ভবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ভারত্তোলন ফেডারেশনের বর্তমান সহ-সভাপতি ও এক সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদের। জিমনেশিয়ামের দুরবস্থা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, ‘১৯৬৪ সালে এখানে আমি জিমন্যাস্টিক্স ও ভারত্তোলন করেছি নিজেই। খেলোয়াড়, রেফারি, কর্মকর্তা, প্রশাসক নানা ভূমিকায় এই ভবন ও জিমনেশিয়ামের সঙ্গে এখনও জড়িত আছি। এই জিমনেশিয়াম পাকিস্তান আমলের। এটার ভিত্তি খুবই সুদৃঢ়। তাই সংস্কারের চেয়ে প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা।’

ক্রীড়া স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের দেখভালের দায়িত্ব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক ও প্রশাসনের। এই পদ ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে শূন্য। ফলে ক্রীড়া পরিষদের সচিব আমিনুল ইসলামকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়ামে পানি প্রবেশ ও জিমন্যাস্টিক্সের ক্ষতির শঙ্কাকে অত্যন্ত পীড়াদায়ক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসলে বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমরা দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে সচিব ও চার পরিচালক স্বল্প মেয়াদে এখানে পদায়ন হন। প্রশাসনিক, ক্রীড়া, পরিকল্পনা ও সাধারণ নানা শাখায় স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা শতাধিক। তাদের অনেকেই নিজ কাজের চেয়ে বিভিন্ন টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্য ও অন্যদিকে বেশি মনোযোগী।

এনএসসি ক্রীড়ার প্রতিষ্ঠান হলেও গত দুই দশকের কর্মকাণ্ড অনেকটা নির্মাণমুখী। প্রতি বছরই রাজধানীতে/জেলায় জেলায় স্টেডিয়াম-স্থাপনা নির্মাণ ও সংস্কারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। অথচ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদেই ঐতিহাসিক এক ক্রীড়া স্থাপনা নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকারের প্রকৃত উদাহরণ! মাঝেমধ্যে আধুনিকায়ন ও জিমনেশিয়ামের নামকরণের আলোচনা শোনা গেলেও সেটা ফাইলবন্দিই থাকে। আর নিদারুণ কষ্টে দিন পার করেন জিমন্যাস্ট-তায়কোয়ান্দোকরা। এরপর তাদের থেকে আন্তর্জাতিক পদক প্রত্যাশা অনাধিকার চর্চাই!

এজেড/এএইচএস