দেশের সবচেয়ে দুই জনপ্রিয় খেলা ফুটবল ও ক্রিকেট। এই দুই খেলার নারী ও পুরুষ উভয় দলের অধিনায়করাই বেশ কঠিন সময় পার করছেন। শীর্ষ দুই খেলায় অধিনায়কদের একইসঙ্গে বাজে মুহূর্ত খুব কম সময়ই এসেছে ক্রীড়াঙ্গনে।

দলীয় খেলায় দিন শেষে সাফল্য-ব্যর্থতার কৃতিত্ব ও দায়ভার অধিনায়কের কাঁধেই বর্তায়। অধিনায়ককে দলের সকল দিক খেয়াল রাখার পাশাপাশি নিজের পারফরম্যান্সও রাখতে হয় সবার ওপরে। যেন অন্যরা অধিনায়ককে দেখে অনুপ্রাণিত হন। ফুটবল ও ক্রিকেট পুরুষ দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ও নাজমুল হোসেন শান্তর পারফরম্যান্স একেবারেই গড়পড়তা। যার কারণে তাদের দলে থাকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। 

নিজের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই শান্তর ব্যাটও যেন এখন শান্ত-রূপে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে তিন ম্যাচে তার রান ৭ গড়ে মাত্র ২২। টি-টোয়েন্টি যেখানে স্ট্রাইক রোটেট করার খেলা, সেখানে বাংলাদেশ অধিনায়কের বিশ্বকাপের তিন ম্যাচের স্ট্রাইকরেট গড়ে মাত্র ৪৮। বিশ্বকাপের আগে অধিনায়কদের স্ট্রাইকরেট নিয়ে করা এক তালিকায় শান্ত ছিলেন আমেরিকান দলের অধিনায়কেরও নিচে। তার পরে ছিলেন কেবল উগান্ডার দলপতি।

বিশ্বকাপের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিন ম্যাচের সিরিজেও উজ্জ্বল ছিল না শান্তর ব্যাট। দুই ম্যাচের একটিতে করেছিলেন ৩৬, আরেকটিতে ৩ রান। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সর্বশেষ দশ ম্যাচে তার রান ১০৭, গড় মাত্র ১০.৭। গড়ের মতো স্ট্রাইকরেটও খুবই নাজুক, ৬৭.৩১।  বিশ্বকাপের আগে অধিকাংশ ম্যাচে শান্ত তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করেছেন। বিশ্বকাপে পজিশন পরিবর্তন করেও অধিনায়কের ব্যাটের চিত্র পরিবর্তন হয়নি। শ্রীলঙ্কা ম্যাচে খেলেছিলেন চার নম্বরে। এরপর দুই ম্যাচে ওপেনিং করেও একই অবস্থা।

অধিনায়ক নিজে ছাড়াও বাংলাদেশের টপ অর্ডার অন্য ব্যাটসম্যানরাও ফর্মে নেই। তাই শান্তকেই বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে ক্রিজে থাকার কথা ছিল, সেখানে তিনি উল্টো বিলাসী শট খেলে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসছেন প্রতি ম্যাচেই। গতকাল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওভারে অযথা রিভার সুইপ করে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে দলকে বিপদে ফেলে ড্রেসিংরুমে ফিরেন বাঁ–হাতি এই ব্যাটার। আগের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হওয়া আউটটিও তেমন উইকেট টেকিং ডেলিভারি ছিল না। 

ক্রিকেটে অধিনায়কদের ফিল্ডিং সাজানো, বোলার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ও ব্যবহার অনেক সময় ম্যাচের ফল বদলে দেয়। ব্যাট হাতে শান্ত ব্যর্থ হলেও অধিনায়ক হিসেবে এখনও সেভাবে প্রশ্নের মধ্যে পড়েননি। তবে ফুটবলে অধিনায়কের সেই সুযোগ নেই। কারণ খেলোয়াড় পরিবর্তন, কৌশল রূপান্তর সব কিছুই কোচের হাতে। মাঠে অধিনায়ককে অন্য দশ জনের মতো পারফর্ম করেই দলে থাকতে হয়। বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন বেশ কিছুদিন ধরেই। 

জামাল ভূঁইয়া বাংলাদেশ ফুটবল দলের নিয়মিত সদস্য ও দীর্ঘদিনের অধিনায়ক। ৬ জুন কিংস অ্যারেনায় অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে কোচ তাকে একাদশেই রাখেননি। ফলে হোম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের সঙ্গে টস করা হয়নি জামালের। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য তাকে নামিয়েছিলেন কোচ। ১১ জুন পরের ম্যাচে আবার জামাল অধিনায়কত্ব ফিরে পেলেও পূর্ণ সময় খেলতে পারেননি। দ্বিতীয়ার্ধে উঠে যেতে হয়েছে। ফলে আবার বদল করতে হয়েছে আর্মব্যান্ডের। গত এক বছরে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাচে আমর্ব্যান্ড বদল হচ্ছে প্রায় প্রতি ম্যাচেই। জামাল হাতে গোণা ম্যাচেই পুরো সময় মাঠে থাকতে পেরেছিলেন।

বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ দুই পর্ব মিলিয়ে ৮ ম্যাচ খেলেছে। অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ৮ ম্যাচেই মাঠে নামলেও পুরো সময় খেলেছেন শুধুমাত্র একটি ম্যাচে। ২১ মার্চ কুয়েতে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে পুরো সময় কোচ তাকে মাঠে রেখেছিলেন। বাকি সাত ম্যাচেই তাকে ওঠা-নামার মধ্যে থাকতে হয়েছে। ৮ ম্যাচে মোট ৭২০ মিনিট গেম টাইমের মধ্যে জামাল মাঠে ছিলেন ৫২৭ মিনিট। যা গড়ে ৬৫ মিনিট। এমন একজন ফুটবলারের হাতে আর্মব্যান্ড থাকলে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিকই। 

ক্রিকেটে জাতীয় দলের খেলাই বেশি হয় বছরজুড়ে, সেখানে ফুটবল মূলত ক্লাব নির্ভর। জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ক্লাবে আরও চরম বিড়ম্বনার শিকার। দেশীয় ক্লাব শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি করে আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিভাগ লিগের দল সোল দা মায়োতে খেলেছিলেন কিছুদিন। সেখানে কয়েকটি ম্যাচ খেললেও কোনো পারিশ্রমিকই পাননি। এজন্য ফিফার দ্বারস্থ হয়েছেন। দুই বছরের চুক্তি ভেঙে ঘরোয়া ফুটবলের মাঝপথে নাম লিখিয়েছিলেন ঢাকা আবাহনীতে। সেখানেও তিনি নিয়মিত একাদশে সুযোগ পাননি। দ্বিতীয় লেগে নয় ম্যাচের মধ্যে জামাল পাঁচ ম্যাচেই একাদশে ছিলেন না। আবার যে ম্যাচগুলোতে একাদশে ছিলেন সেই ম্যাচগুলোতে ওঠে যেতে হয়েছে মাঝপথে। ঘরোয়া ফুটবলের চলমান দলবদলে ফুটবলারদের নিয়ে ক্লাবগুলোর টানাটানি ও ফুটবলাররা দর-কষাকষি করলেও জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল সেই অবস্থানে নেই। 

পুরুষ ফুটবল ও ক্রিকেট অধিনায়কের মতোই অবস্থা নারী দলের দুই অধিনায়কেরও। বাংলাদেশের নারী ফুটবলের কিংবদন্তি সাবিনা খাতুন। ২০১০ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার পর কখনও একাদশের বাইরে ছিলেন না। ৩ জুন চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে অনুষ্ঠেয় প্রীতি ম্যাচে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো একাদশের বাইরে ছিলেন এবং সহকারী অধিনায়ক শিউলি আজিম প্রতিপক্ষ অধিনায়কের সঙ্গে টস করেছেন। জামাল ভূঁইয়ার মতো তারও ক্লাব ফুটবলে সময়টা সেভাবে ভালো যায়নি। ভারতের নারী ফুটবল লিগে খেলতে গেলেও মাঝপথে দেশে ফিরে এসেছেন। বসুন্ধরা কিংস নারী ফুটবল লিগে দল না গড়ায় বাফুফে নারী লিগে খেলাটাও শঙ্কার মধ্যে ছিল সাবিনার। পরবর্তীতে নাসরিন স্পোর্টস একাডেমিতে তার নেতৃত্বে জাতীয় দলের অনেকে খেললেও পারিশ্রমিক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত তার দল চ্যাম্পিয়ন হলেও মাঠে দলীয় পারফরম্যান্সও ছিল না সেভাবে। 

নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির অবশ্য নিজের পারফরম্যান্সের চেয়ে দলীয় ব্যর্থতা–ই বেশি আলোচনায়। মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশ নারী দল ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮ টি-টোয়েন্টি এবং ভারতের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে। দুই ফরম্যাট মিলিয়ে ১১ ম্যাচই বাংলাদেশ হেরেছে। অস্ট্রেলিয়া ও ভারত নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। হোম সিরিজে সেই অর্থে নিগারের দল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি। বিশেষ করে ব্যাটিং ছিল অত্যন্ত বাজে। ব্যাট হাতে নিগারের পারফরম্যান্সও ছিল মাঝারি মানের। যদিও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের সঙ্গে টি-টোয়েন্টিতে ৬৩ রান প্রশংসনীয় ইনিংস। পরবর্তীতে অবশ্য অধিনায়ক সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। পরের সাত ইনিংসে একটি মাত্র ফিফটি ও ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস। তিন ইনিংসে দুই অঙ্কের কোটাতেই পৌঁছাতে পারেননি।

অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, টিটি, ব্যাডমিন্টন, শ্যুটিং, আরচ্যারি ব্যক্তিগত-দ্বৈত ও মিশ্র খেলা। সেখানে নেতৃত্বের তেমন কিছু নেই। হ্যান্ডবল, ভলিবল ও কাবাডি দলীয় খেলায় অধিনায়কত্ব রয়েছে। জাতীয় খেলা কাবাডির অধিনায়কের গল্পটা আবার ভিন্ন। সদ্য সমাপ্ত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কাবাডিতে অধিনায়ক ছিলেন আরদুজ্জামান। তিনি বাংলাদেশকে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন করে অবসরে গেছেন। আগের তিন আসরের অধিনায়ক ছিলেন তুহিন তরফদার। তিনিও হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন দলকে। দেশে আয়োজিত নিজেদের টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলেও এশিয়ান গেমসের ব্যর্থতায় অবশ্য সেই সাফল্য নিয়ে আবার প্রশ্ন ওঠে। ভলিবলে এশিয়ান পর্যায়ে তেমন বড় সাফল্য নেই। আর হ্যান্ডবলে তো সাফ গেমস ছাড়া সিনিয়র দলের সেই অর্থে খেলাই হয় না।

শান্তর সর্বশেষ ১০ টি টোয়েন্টি

রান     স্ট্রাইকরেট
১         ৩৩.৩৩
১৪       ৬০.৬৬
৭         ৫৩.৮৪
৩৬      ১০৫.৮৮
৩        ২৭.২৭
২        ২৮.৫৭
৬        ১৫০
১৬      ১০৬.৬৬
২১      ৮৭.৫০
১        ১৬.৬৬

১০৭    ৬৭.৩১ (গড়)

নিগার সুলতানার সর্বশেষ পাঁচ ওয়ানডে

রান     স্ট্রাইকরেট
২৭       ৪২.১৮
১         ২০
১৬       ৪১
৩         ২১
১৩       ৩৯

১২     ৩২.৬৭ (গড়)

সর্বশেষ দশ টি-টোয়েন্টি

রান      স্ট্রাইকরেট
৭           ৫০
১           ৫০
২৮        ৭৭.৭৭
৬          ৫৪.৪৪
৫১        ১০৬.২৫
৩২        ১০৩.২২
১           ১০
৬৩*      ৯৮.৪৩

২৭      ৬৮.৭৬ (গড়)

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ৮ ম্যাচে জামাল

তারিখ           প্রতিপক্ষ        স্থায়ীত্ব 
১১ জুন          লেবানন        ৬৯ মিনিট
৬ জুন           অস্ট্রেলিয়া     ৪০ মিনিট
২৬ মার্চ         ফিলিস্তিন      ৭০ মিনিট
২১ মার্চ         ফিলিস্তিন      ৯০ মিনিট
১৬ নভেম্বর    অস্ট্রেলিয়া    ৫৮ মিনিট
২১ নভেম্বর    লেবানন        ৬১ মিনিট
১৭ অক্টোবর   মালদ্বীপ       ৬৭ মিনিট
১২ অক্টোবর   মালদ্বীপ       ৭২ মিনিট

৮ ম্যাচ      ৫২৭ মিনিট  (মোট)

লিগের দ্বিতীয় লেগে ঢাকা আবাহনীতে জামাল

প্রতিপক্ষ                একাদশ
চট্টগ্রাম আবাহনী     অনুপস্থিত
ব্রাদার্স                  উপস্থিত 
পুলিশ                  অনুপস্থিত 
বসুন্ধরা কিংস        অনুপস্থিত
শেখ রাসেল          উপস্থিত 
শেখ জামাল          অনুপস্থিত
ফর্টিজ                  অনুপস্থিত
রহমতগঞ্জ             উপস্থিত
মোহামেডান           উপস্থিত

সাবিনা খাতুন

১৪ বছর পর একাদশের বাইরে। চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে ম্যাচের ৭৮ মিনিটে নেমেছিলেন। 

ভারতের নারী লিগের মাঝপথে ফিরে এসেছিলেন দেশে।

এজেড/এএইচএস