ক্রীড়াঙ্গনের ‘আড়ালের’ সেবকরা
ফুটবলার সাবিনা-স্প্রিন্টার শিরিন-ক্রিকেটার জ্যোতিরা দেশের জন্য লড়েন। খেলোয়াড়রা সবার সামনে লড়েন মাঠে, তাদের পেছনে থাকেন কোচ, ট্রেইনাররা। তাদেরও পেছনে থেকে খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করেন ফিজিও। আড়ালে কাজ করা নারী ফিজিওরা ক্রীড়াঙ্গনে রাখছেন অবদান।
নারী খেলোয়াড়, কোচ, আম্পায়ার, সংগঠকের সংখ্যা সাধারণ মাত্রার কাছাকাছি। সেখানে গোটা ক্রীড়াঙ্গনে নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য সক্রিয় ফিজিওর সংখ্যা বর্তমানে মাত্র পাঁচ জন। সুরাইয়া আক্তার নয়না ও ফারজানা আমিন লিজা ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে কাজ করেন নারী উইংয়ে। লাইজু ইয়াসমিন লিপা বাফুফেতে নারী ফুটবল দলে, রেবেকা সুলতানা বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের অধীনে বিভিন্ন গেমসে ও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অবস্থিত ফেডারেশনগুলোতে ও লুতফা আক্তার বিকেএসপিতে ফিজিও হিসেবে কাজ করেন।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
২০০১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক চাকরি শুরু করেন লুতফা। ক্রীড়াঙ্গনে তিনিই প্রথম নারী ফিজিও এমনটাই দাবি তার, 'বিকেএসপিতে আমি প্রথম নারী ফিজিও। এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী হিসেবে কাজ করছি। ফুটবল, ক্রিকেট ফেডারেশন ফিজিও নিয়োগ দিয়েছে বিকেএসপির পর। অন্য ফেডারেশনে নারী ফিজিও নেই। সেই হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনে আমিই প্রথম নারী ফিজিও।'
১৯৮৬ সালে বিকেএসপি প্রতিষ্ঠা হলেও নারী ক্রীড়াবিদদ ভর্তি শুরু ১৯৯৭ থেকে। নারী ক্রীড়াবিদ ভর্তির কয়েক বছর পর থেকে নারী ফিজিওর যাত্রা শুরু। শুরুর দিকে নারী ক্রীড়াবিদের সংখ্যা কম থাকলেও এখন তিন শতাধিকের বেশি। তিনশ'র বেশি নারীদের লুতফার একার পক্ষে দেখভাল করা খানিকটা কষ্টসাধ্যই, 'শিক্ষার্থীদের আঘাত-ইনজুরি নিয়ে আমার কাজ। একসঙ্গে কয়েকজনের ইনজুরি হওয়ার ঘটনা কম। এরপরও মাঝে-মধ্যে চাপ পড়ে। আবার অনেক সময় ছেলে শিক্ষার্থীদের দেখতে হয়।'
লুতফা বিকেএসপির ক্যাম্পাসেই থাকলেও ফুটবলে কাজ করা লিপা ও ক্রিকেটের সুরাইয়া-লিজার পরিধি একটু ভিন্ন । নারী ফুটবল-ক্রিকেট দল যেখানে, তাদের সেখানেই দৌড়াতে হয়। ২০০৮ সাল থেকে ক্রিকেট বোর্ডে ফিজিও হিসেবে কাজ করছেন সুরাইয়া। ফিজিওথেরাপিতে পড়াশোনা করে ক্রীড়াঙ্গনে আসার কারণ সম্পর্কে বলেন, 'বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে ভিন্ন কিছু করবে। আমার স্বপ্ন ছিল দুনিয়াকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখার। বিসিবিতে আমিই প্রথম নারী ফিজিও ফলে এখানে আমার পথিকৃৎ হওয়ার সুযোগ ছিল। তাই সে চ্যালেঞ্জ নেয়া৷'
নারী হিসেবে ফিজিও কাজের চ্যালেঞ্জটা ঘরে-বাইরে দুই জায়গায়ই। এক দশকের অভিজ্ঞতায় সুরাইয়া বলেন, 'এমনও হয়েছে বছরে ৬-৭ মাস পরিবারের বাইরে থাকতে হয়েছে। এটা নারী হিসেবে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ। আবার পেশাদার জগত পারফরম্যান্স-ভিত্তিক। খেলোয়াড়দের দ্রুত সময়ে ফিট করে তোলাই ফিজিওর সাফল্য হিসেবে গণ্য।'
এক যুগের বেশি সময় নারী ক্রিকেট দলের সঙ্গে কাজ করছেন সুরাইয়া। অনেক ক্রিকেটারের দুঃসময়ের সঙ্গী ছিলেন। এমন একটি উদাহরণও দিলেন সুরাইয়া, '২০১০ সালের দিকে শামীমা সুলতানা হাটুর ইনজুরিতে পড়েছিল। তখন তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখছিল অনেকে। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে এখনো সে খেলছে, এটিই আমার ফিজিও হিসেবে স্বার্থকতা।'
ক্রীড়াঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সাফল্য সাফে নারীদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সেই ফাইনালে দলের মূল ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্নার খেলা ছিল অনিশ্চিত। ফিজিও লিপার প্রচেষ্টায় ফাইনালে খেলেছিলেন স্বপ্না ৷ এটাই লিপার সন্তুষ্টি, 'আমার চ্যালেঞ্জ ছিল তাকে ফিট করে তোলা। সে ফিট হয়ে খেলেছে এটাই আমার প্রাপ্তি।'
২০১৬ সাল থেকে নারী ফুটবল দল আবাসিক ক্যাম্প শুরু করেছে। দুই-তিন বছর চুক্তিভিত্তিক নারী ফিজিও কাজ করেছে। ২০২০ সাল থেকে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন লিপা। সিনিয়র-জুনিয়র মিলে বেশ কয়েকটি নারী দল। তাই কাজের চাপও অনেক লিপার, 'ফুটবলাররা ইনজুরিতে পড়লে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। রিপোর্ট আলাদা আলাদা সংরক্ষণ করতে হয়। কাছাকাছি সময় একাধিক টুর্নামেন্ট থাকলে ডাটা সংরক্ষণও আলাদা করতে হয়।'
ফুটবলে লিপার এক হাতে সব সামলাতে হলেও ক্রিকেটে সুরাইয়ার সঙ্গে আছেন লিজা। ফিজিওথেরাপির অন্য সেক্টরের চেয়ে স্পোর্টসকে আলাদা করলেন তিনি, 'অন্য ফিজিওথেরাপির চেয়ে স্পোর্টসের থেরাপিতে স্টাডি, সময় ও এনার্জি তিনটাই বেশি প্রয়োজন।' এত পরিশ্রমের পরেও নানা সাফল্যের আলোচনায় থেকে যান আড়ালেই। এ নিয়ে অবশ্য আফসোস নেই লিপার, 'ফিজিও আমার পেশা। স্পোর্টস আমার প্যাশন।' বিকেএসপির নারী ফিজিও লুতফার প্রাপ্তি, '১৫ বারের দ্রুততম মানবী যখন বলে ম্যাডাম এই সাফল্য আপনারও সেটাই আমার বড় পাওয়া।'
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায় খুব পরিচিত মুখ রেবেকা। কখনো হ্যান্ডবল, কখনো হকি, কখনো ব্যাডমিন্টনে পাওয়া যায় তাকে। লিপা, লিজারা স্থায়ীভাবে বিসিবি, বাফুফে ও বিকেএসপিতে থাকলেও রেবেকা সেভাবে নেই। মুক্ত থাকাতেই তার যেন আনন্দ, 'আমি নির্দিষ্ট কোনো খেলায় সীমাবদ্ধ নই। যখন যেখানে প্রয়োজন ও ভালো লাগে যাই। নিজে আলাদা কাজও করতে পারি। স্বাধীনভাবে ভালোই আছি।'
বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের অধীনে গেমসের সময় বিভিন্ন খেলার ক্যাম্প পরিদর্শক করেন রেবেকা। ১-২ বছর পরপর গেমস হওয়ায় রেবেকাকে কাজ করতে হয় একেক মাসে একেক ফেডারেশনের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। তাই তার নারীদের পাশাপাশি পুরুষ ক্রীড়াবিদ নিয়েও কাজ করতে হয়।
ঘরোয়া হকিতে বড় দুই দলের খেলা মানেই তুমুল উত্তেজনা। সেটা অনেক সময় গড়ায় হাতাহাতিতেও। তুমুল হট্টগোলের মধ্যেও প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স নিয়ে দৌড়ান রেবেকা। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে সব পুরুষের ভিড়ে একমাত্র নারী রেবেকা শ্রুশুষার কাজ করছেন অবলীলায়, '২০১০ সালে উশু থেকে আমার পথচলা শুরু। অনেক খেলায় কাজ করি। ক্রীড়াঙ্গনকে একেবারে আপন মনে হয়৷ নারী হলেও পুরুষদের আলাদাভাবে দেখি না, আমাকেও তারা সেভাবে দেখে না।'
অন্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও নারী-পুরুষ বৈষম্য কিছুটা হলেও আছে। এক যুগের বেশি সময় কাজ করা সুরাইয়া খানিকটা আক্ষেপের কন্ঠে বলেন, 'পুরুষ দলে পুরুষ ফিজিও আমার চেয়ে অভিজ্ঞতায় কম হলেও পারিশ্রমিকের অঙ্কে বেশি।' দক্ষিণ আফ্রিকার পুরুষ ক্রিকেটে ও অনেক পুরুষ ফুটবল দলেও নারী ফিজিও কাজ করেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি খানিকটা অসম্ভব হলেও নিজেকে এমন অবস্থানে নিতে চান সুরাইয়া, 'আমি পেশাদার। কাজটি সঠিকভাবে করতে পারলে আমি পুরুষ না মহিলা সেটা বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়।'
ফিজিও বিষয়টি চিকিৎসা সম্পর্কিত। চিকিসক-ফিজিও অনেক সময় দ্বন্দ্বে জড়ায়। এ সম্পর্কে ফুটবল নিয়ে কাজ করা লিপা বলেন, 'আমার জ্ঞান থাকলে সম্মান দিতে বাধ্য। উনি যখন কথা বলবেন আমার কথায় বুঝতে পারবেন যে নলেজ দিয়ে এগোচ্ছি।' ক্রিকেটের সিনিয়র ফিজিও লিজা বলেন, 'আমাদের ক্রিকেটে চিকিৎসক ফিজিও দারুণ সম্পর্ক৷ মাঝে মধ্যে কোচের সঙ্গে খেলোয়াড়দের লোড দেয়া নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলাপ হয়।' একাডেমিক বিষয়ে সুরাইয়া আরো বলেন, 'ব্যাচেলর অফ ফিজিও থেরাপি পড়ায় দেশে সরকারি একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান। এটি যেমন বাড়ানো দরকার তেমনি স্পোর্টসে যারা কাজ করছে তাদের বিদেশে ট্রেনিংয়ে পাঠানো উচিত।'
ক্রীড়ার নানা খাত প্রসারিত হচ্ছে। গত দুই দশকে মাত্র চার-পাঁচ জন নারী এই পেশায় এসেছেন। ক্রীড়ার এই সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে বিসিবির ফিজিও লিজা বলেন, 'আগে নারী খেলাধুলা বিকশিত হতে হবে৷ নারী ক্রিকেট পরিধি বাড়ায় এখন একজন বিদেশি নারী ফিজিও ও দুই জন দেশি কাজ করছি৷ সামনে হয়তো বাড়তে পারে ক্রিকেট ও অন্য খেলাতেও।'
ঘরোয়া ক্রিকেটে ক্লাবগুলো ফিজিও সেভাবে নেয় না। বিসিবির ফিজিওরাই তত্ত্বাবধান করে প্রয়োজনে। অতিমাত্রায় ফিটনেস নির্ভর খেলা ফুটবল লিগে আতাউর রহমান ভুইয়া কলেজ স্পোর্টিং ক্লাবে ফাতেমা-তুজ-জোহরা দুই মৌসুম ফিজিও হিসেবে কাজ করেছেন৷ সার্ভিসেস সংস্থাতেও নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য ফিজিও আছে৷
পাঁচ নারী ফিজিওর মধ্যে সুরাইয়া, লুতফা ও রেবেকা তিনজনেরই স্বামী ক্রীড়াঙ্গনেই ফিজিও হিসেবে কাজ করেন। সুরাইয়ার স্বামী মোফাজ্জল হোসেন জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে কাজ করতেন। স্ত্রী বিসিবিতে কাজ করায় তিনি স্পেশাল অলিম্পিকে যোগ দেন। লুতফার স্বামী লিংকনও বিকেএসপির ফিজিও। রেবেকার স্বামী আরিফ জোবায়েরও বিওএ এবং বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায় বিভিন্ন ফেডারেশনের প্রতিযোগিতায় কাজের পাশাপাশি মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের ফিজিও সেন্টারে বসেন।
লিপা ও লিজার স্বামী অন্য পেশার। এরপরও তারা স্বামীর কাছ থেকে সহায়তা পান বলেই কাজ করতে পারছেন। তারা জানান, স্বামী ও পরিবারের কাছ থেকে সহায়তা না পেলে এই পেশা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো। সংসার, বাচ্চা সব কিছু সামলে মাঠে দৌড়ানো সম্ভব হয় তাদের আন্তরিক সহযোগিতায়।
নারী ক্রীড়াবিদ, কোচ, সংগঠক, রেফারি-আম্পায়ারারা থাকেন আলোচনায়। অনেকটা নিরবে-নিভৃতে কাজ করেন ফিজিওরা। সাবিনা-জ্যোতি-শিরিনদের পেছনে অনেক অবদান সুরাইয়া-লিপাদের। ক্রীড়াঙ্গনে স্বীকৃতি প্রয়োজন তাদেরও।
এজেড/এইচজেএস