বাংলাদেশে বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রয়েছে অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে তাদের বিচরণ। ক্রীড়াক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে তুলে এনেছেন জাতীয় ফেডারেশন ও স্থানীয় ক্রীড়া সংস্থায় সংগঠকদের পাশাপাশি কোচ-বিচারক হিসেবে তাদের অবস্থান।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন-অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যাটা সবমিলিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক। একেক ফেডারেশনে নির্বাহী কমিটির আকার একেক রকম। সব ফেডারেশন মিলিয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এত সংখ্যক সংগঠকের মাঝে বর্তমানে চার ফেডারেশনে মাত্র একজন করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যা শতাংশের হিসেবে প্রায় শূন্য।

ক্রিকেট-হকিতে নেই, ফুটবলে ছিলেন ১ জন

দেশের তিন শীর্ষ জনপ্রিয় ও বড় ফেডারেশন যথাক্রমে ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি। এই তিন ফেডারেশনের মধ্যে একমাত্র ফুটবল ফেডারেশনেই ছিল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব। সাবেক রেফারি বীর বাহাদুর বাফুফের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনিই এখন পর্যন্ত একমাত্র। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ ক্রিকেট ও হকি ফেডারেশনের কমিটিতে এখন পর্যন্ত জায়গা করে নিতে পারেনি।

ক্রীড়ার বিভিন্ন ফেডারেশন ও বোর্ডের নির্বাহী কমিটিতে কেউ আসতে না পারার কারণ হিসেবে রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক বরুন বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘আসলে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর নির্বাচন করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন, যা আমার নেই। তাছাড়া নানা মেরুকরণও থাকে। গতবার বাফুফেতে সদস্য নির্বাচন করার সম্ভাবনা থাকলেও করতে পারিনি। এবারও ইচ্ছে রয়েছে।’

১৯৯৮ সাল থেকে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থা। ফেডারেশনগুলোর কমিটিতে আসতে হলে আগে বিভিন্ন ক্লাব, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর মনোনীত হতে হয়। এরপর বিভিন্ন প্যানেল, মেরুকরণ ও ভোটাভুটি। এই তিন শীর্ষ খেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেকেই ধারাবাহিকভাবে কাউন্সিলর হলেও কমিটিতে আসতে পারছেন না। 

নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন বরুন বিকাশ দেওয়ান। খেলা ছাড়ার পর তিনি নিজ জেলা রাঙামাটিতে কাজ করছেন। রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থায় দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন বরুন। ফুটবল ফেডারেশন ও ক্রিকেট বোর্ডের কাউন্সিলর থাকলেও নির্বাহী কমিটিতে আসতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আসলে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর নির্বাচন করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন, যা আমার নেই। তাছাড়া নানা মেরুকরণও থাকে। গতবার বাফুফেতে সদস্য নির্বাচন করার সম্ভাবনা থাকলেও করতে পারিনি। এবারও ইচ্ছে রয়েছে।’

তিনি ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্য কারও শীর্ষ তিন খেলার নির্বাহী কমিটিতে থাকার সম্ভাবনা দেখছেন না বরুন, ‘আমি জাতীয় পর্যায়ে খেলেছি, তৃণমূলে সংগঠক এবং প্রায় সবার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। অন্য কেউ সেভাবে এই দৌড়ে নেই। তাই কেউ হুট করে নির্বাচনে দাঁড়ালেও জিততে পারবে না। আমার খেলোয়াড় এবং সংগঠক মহলে একটা পরিচিতি রয়েছে। আমিই যখন আসতে পারছি না কমিটিতে, তখন এই বড় ফেডারেশনগুলোতে অন্য কেউ (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর) সহজে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।’

বীর বাহাদুর এক সময় ফুটবল ফেডারেশনের অন্যতম নীতি নির্ধারকও ছিলেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে ফেডারেশনে বীর বাহাদুরের প্রতিনিধিত্ব করা নিয়ে বরুনের পর্যবেক্ষণ, ‘বীর বাহাদুর দা ফুটবলাঙ্গনে অনেকদিন থেকেই জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি। ফেডারেশনের কমিটিতে থাকার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ ছিল।’ বীর বাহাদুর পার্বত্য অঞ্চলে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, এছাড়া বান্দরবানের বেশ কয়েকবারের এমপিও তিনি।

 বাফুফের সাবেক সহ-সভাপতি বীর বাহাদুর

অন্যদিকে, বাংলাদেশ হকির অন্যতম কিংবদন্তি জুম্মন লুসাই অবসর নেওয়ার পর আবাহনীর সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অনেক ইচ্ছে ছিল ফেডারেশনের কমিটিতে যাওয়ার। একবার তিনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কোটায় কাউন্সিলর হলেও কমিটিতে জায়গা পাননি। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিকেটের প্রচলন হয়নি সেভাবে, ফলে এদের মধ্যে থেকে বোর্ডে প্রতিনিধিও আসেনি।

একমাত্র সাধারণ সম্পাদক

ফুটবল ও ক্রিকেট ছাড়া বাকি সব ফেডারেশন মূলত সাধারণ সম্পাদক নির্ভর। ২০১৮ সালে কারাতে ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্য শৈ হ্ল। সাধারণ সম্পাদক পদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম। নির্বাচিত হওয়ার পরের বছরই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে দুর্দান্ত ফলাফল করে। কাঠমান্ডু এসএ গেমসে ৩টি স্বর্ণ অর্জন করে কারাতে ডিসিপ্লিনে। পরে ২০২২ সালে চার বছর মেয়াদী কমিটির নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ক্য শৈ হ্ল’কে আর ভোটাভুটিতে পড়তে হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি।

কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ক্য শৈ হ্লাই

কারাতে ফেডারেশনের ২৪ জনের কমিটিতে ক্য শৈ হ্ল একমাত্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে টানা দুই মেয়াদে একটি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক থাকার পেছনেও রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়। ক্য শৈ হ্ল বান্দরবান জেলা পরিষদেরও চেয়াম্যান। বিভিন্ন ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক কর্তৃত্ব করলেও কারাতে ফেডারেশনের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। সহ-সভাপতি এবং আরও দুয়েকজন কর্মকর্তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ক্য শৈ হ্ল।

অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন ও হ্যান্ডবলে একজন করে সদস্য

মাদার অব অল ডিসিপ্লিন বলা হয় অ্যাথলেটিক্সকে। সেই অ্যাথলেটিক্সে এক সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের যথেষ্ট বিচরণ ছিল। সেই বিচরণ এখন কমতে কমতে নেই বললেই চলে। মাঠে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও ফেডারেশনের বর্তমান কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন একজন। সাবেক অ্যাথলেট শর্মিষ্ঠা রায় এবার অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচন হয়েছেন। 

ফেডারেশনগুলোর কমিটিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকার কারণ সম্পর্কে শর্মিষ্ঠার ভাষ্য, ‘আসলে খেলাটা নিজের ওপর, কিন্তু ফেডারেশনের কমিটিতে আসাটা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ফোরাম, বিভিন্ন মেরুকরণের পর আর্থিক বিষয়াদি তো থাকেই। আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাই এই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে অনেকেই দূরে থাকে।’ এবারের অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের নির্বাচনে একক প্যানেল এবং ফোরাম নেতৃবৃন্দের সমর্থন পাওয়ায় শর্মিষ্ঠার কমিটিতে আসার সুযোগ হয়েছে।

হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সদস্য থুইসিং প্রু (লুবু)

অ্যাথলেটিক্সের প্রবীণ সংগঠক ফারুকুল ইসলাম অ্যাডহক কমিটির আমলে (১৯৯৮ পূর্ববর্তী সময়) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি খানিকটা স্মরণ করতে পারলেও সুনির্দিষ্ট নাম বলতে পারেননি,‌ ‘অ্যাথলেটিক্সে শর্মিষ্ঠার আগে আরও দুয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে অ্যাডহক কমিটিতে ছিল। নামটি অবশ্য স্মরণে আসছে না।’

জেলা ক্রীড়া সংস্থায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে বরুন বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘রাঙামাটির কমিটিতে ৫-৬ জন রয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। খাগড়াছড়ি-বান্দরবানেও হয়তো একই রকম। সংগঠকদের নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াতে হয়। যা আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অনেকেই রুটি-রুজির সন্ধানেই ব্যস্ত থাকে।’

অ্যাথলেটিক্সে আগে থাকলেও ব্যাডমিন্টন ও হ্যান্ডবলের কমিটিতে এবারই প্রথম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ জায়গা পেয়েছেন। ব্যাডমিন্টনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলর উথোয়াইচিং রোয়াজা এবং হ্যান্ডবল ফেডারেশনে বান্দরবান জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর থুইসিং প্রু (লুবু) নির্বাহী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। এই দুজন কমিটিতে জায়গা পাওয়ায় সব ফেডারেশন মিলিয়ে বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন সর্বোচ্চ ৪ জন। যা বিগত সময়ে কেবল ১-২ জনে সীমাবদ্ধ ছিল।

ফেডারেশনে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ কোটা চালুর দাবি

কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ জুম্মন লুসাইয়ের বড় বোন মারিয়াম চৌধুরি। তিনি নিজেও ছিলেন অ্যাথলেট, তবে সংগঠক হিসেবে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রীড়া কাঠামোতে ফেডারেশনের পরের স্থানেই বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা। সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার একমাত্র নারী সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালনের কৃতিত্ব একমাত্র তারই। সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা প্রায় এক দশক ধরে সিলেট জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্বে আছেন। 

অ্যাথলেটিক্স, আরচ্যারি ও ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের কাউন্সিলর ছিলেন মারিয়াম চৌধুরি। কাউন্সিলর থাকলেও তিনি কোনো ফেডারেশনের সদস্যই হতে পারেননি। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ফেডারেশনের নেতৃস্থানীয় প্যানেলে যখন তারই জায়গা হয় না, তাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য ফেডারেশনে একটি সংরক্ষিত কোটা রাখার দাবি মারিয়ামের, ‘একটি ফেডারেশনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একজন থাকলে, ওই জনগোষ্ঠীর অন্যরাও ফেডারেশনে আসার স্বপ্ন দেখবে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি ফেডারেশনের কমিটিতে থাকবে সে ওই খেলাটি প্রচারের সর্বাত্মক চেষ্টাও করবে নিজ অঞ্চলে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ না থাকায় অনেক খেলাতেই পিছিয়ে পড়ছে তারা। তাই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে একটি সংরক্ষিত বা মনোনীত কোটা চালু করতে পারে।’ 

জাতীয় সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন ৫০টি। ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্যও সংরক্ষিত আসন থাকা উচিৎ বলে মনে করেন অনেকে। ফুটবল ফেডারেশন বাদে দেশের বাকি সকল সংস্থায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দুই জন সদস্য মনোনীত করতে পারে। ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেকের মন্তব্য— জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ যোগ্যতা ও প্রয়োজন অনুসারে অনেক ফেডারেশনে মনোনীত দুই জনের মধ্যে একজনকে নিতে পারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে।

জেলা পর্যায়েও প্রতিনিধিত্ব কম

প্রতিটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটি ৩১ সদস্য বিশিষ্ট। যেখানে সব জেলা মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার ব্যক্তির সমষ্টি। এত বড় সংখ্যক ক্রীড়া সংগঠকের মধ্যে ২০ জনেরও কম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা। শতাংশের হিসেবে যা মাত্র একেরও কম।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অনেকের আবাস মূলত তিন পার্বত্য অঞ্চলে। সেই তিন পার্বত্য অঞ্চলের জেলা ক্রীড়া সংস্থার মধ্যে একমাত্র খাগড়াছড়ির সাধারণ সম্পাদক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। বাকি দুই জেলায় বাঙালিদের হাতেই জেলা ক্রীড়া সংস্থার চাবিকাঠি। ফেডারেশনগুলোর মতো জেলা ক্রীড়া সংস্থায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে বরুন বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘রাঙামাটির কমিটিতে ৫-৬ জন রয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। খাগড়াছড়ি-বান্দরবানেও হয়তো একই রকম। সংগঠকদের নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াতে হয়। যা আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অনেকেই রুটি-রুজির সন্ধানেই ব্যস্ত থাকে।’

কোচ আছেন শুধু ফুটবলে

অনেক খেলাতেই খেলোয়াড় হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কোচ হিসেবে ফুটবল ছাড়া অন্য খেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তেমন প্রতিনিধিত্ব নেই। নারী ফুটবলে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করছেন তৃষ্ণা চাকমা। বিকেএসপিতে ফুটবল কোচ হিসেবে কাজ করছেন পরিতোষ দেওয়ান, কনক জুমো, চিং ও জয়া চাকমা। বাংলাদেশ আনসারে ফুটবল কোচ হিসেবে আছেন সুহেলা মং। 

২০০৫ সালে আনসারে ফুটবল কোচ হিসেবে কাজ শুরুর পর মং ফুটবল কোচ হিসেবে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন। তার হাত ধরে অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ফুটবল কোচ এসেছে। যা নিয়ে বেশ তৃপ্ত মং, ‘আমার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের ফুটবলার হওয়া। যখন জাতীয় ফুটবলার হতে পারিনি, তখনই কোচ হওয়ার চেষ্টা করি। এখন আমি প্রতিষ্ঠিত কোচ। আমার উদ্যোগে আরও অনেকে কোচ হয়েছে।’ সাবেক নারী জাতীয় ফুটবলার অম্রা, নুবাই, সুইনু-সহ অনেকের কোচিংয়ের হাতেখড়ি মংয়ের হাত ধরে।

কোচিংয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অনেকেই না আসার কারণ সম্পর্কে মংয়ের মন্তব্য, ‘কোচিং একটা কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। আবার অনেক জায়গায় আমাদের (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের) ওপর সেভাবে আস্থাও রাখে না। তাই কোচিংয়ে সংখ্যাটা কম।’ 

ফুটবলে এএফসির লাইসেন্স করা কোচ রয়েছেন বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। বাফুফের তত্ত্বাবধানে লাইসেন্স করলেও সক্রিয় কোচের সংখ্যা দশের নিচেই। ফুটবলে যখন এই অবস্থা, অন্য খেলার চিত্র সহজেই অনুমেয়। ক্রিকেটে জাতীয় পর্যায়ে কোচ একজনই। বরুন বিকাশ দেওয়ানের ভাই মহীতোষ দেওয়ান বিসিবির রাঙামাটি জেলার কোচ। ক্রিকেটে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোচ কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে মহীতোষের ব্যাখ্যা, ‘আমিই একমাত্র এখন পর্যন্ত ঢাকা লিগে খেলেছি। শীর্ষ পর্যায়ে ক্রিকেট না খেলায় আমাদের মধ্যে কোচের সংখ্যাও কম। তবে এখন বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে কোচ বাড়ানোর।’

সাবেক হকি খেলোয়াড় জুবেল লুসাই ছিলেন আরচ্যারি কোচ। তিনি গত বছর মৃত্যুবরণ করেন। হকি, কাবাডি, হ্যান্ডবল, বক্সিংসহ অন্য কোনো খেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাউকে কোচ হিসেবে দেখা যায়নি।

‘একমাত্র’ আম্পায়ার চম্পা, রেফারির আইকন জয়া

সংগঠক ও কোচের মতো আম্পায়ার-রেফারি বিচারকেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব কম। শীর্ষ বা জাতীয় পর্যায়ে পুরুষদের মধ্যে আম্পায়ারিং-স্কোরিংয়ে নেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ। চম্পা চাকমাই একমাত্র নারী আম্পায়ার। তিনি সবে শুরু করেছেন আম্পায়ারিং। স্বপ্ন দেখছেন শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পাওয়ার, আশাবাদী কণ্ঠে চম্পা চাকমা বলেন, ‘এখন আম্পায়ারিং ঘিরেই আমার আশা। চেষ্টা করছি নিজেকে ধীরে ধীরে আম্পায়ারিংয়ের আরও ওপরে নিয়ে যাওয়ার।’

বাংলাদেশ আম্পায়ার্স এন্ড স্কোরার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সয়লাব হোসেন টুটুল দীর্ঘদিন আম্পায়ারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আম্পায়ারিং সম্পর্কে বলেন, ‘অনেক আগে একজন আম্পায়ারিং করতেন, তবে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে আসতে পারেননি। এরপর থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাউকে সেভাবে দেখা যায়নি। বর্তমানে শুধু চম্পাই আম্পায়ারিং করছে।’

ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ের বিপরীত চিত্র ফুটবল রেফারিংয়ে। বাংলাদেশের নারী রেফারিংয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন জয়া চাকমা। নারী রেফারিদের মধ্যে তিনি প্রথম ফিফা ব্যাজ পেয়েছেন। জয়া ছাড়াও রেফারিংয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেকে রয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। ফুটবল রেফারিংয়ে ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ের চেয়ে বেশি থাকার কারণ সম্পর্কে সয়লাব হোসেন টুটুল বলেন, ‘ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটের আইন অনেক বেশি এবং সময় নির্ভর খেলা। এ কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেকেই খুব একটা আগ্রহী হয় না। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি পাবর্ত্য অঞ্চলে আমাদের এসোসিয়েশনের মাধ্যমে তাদের সম্পৃক্ত করার।’

দেশের আরেক শীর্ষ দলীয় খেলা হকিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোনো আম্পায়ার নেই। টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবা, শ্যুটিংসহ আরও অনেক ডিসিপ্লিনে জাজ হিসেবে দেখা যায় না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাউকে। 

* ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ ও শেষ পর্বে থাকবে ক্রীড়াঙ্গনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবদানের মর্যাদা-স্বীকৃতি ও কোয়ান্টাম স্কুলের বিশেষ ভূমিকা।

এজেড/এএইচএস