'বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কাজী নজরুল ইসলামের অমর বাণী। এই বাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও। নারী-পুরুষ উভয়ই সাফল্য-অর্জনে দেশের সম্মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো বাড়িয়ে তুলছেন প্রতিনিয়ত। নারী-পুরুষ উভয়ে দেশের জন্য সমানভাবে লড়লেও সুযোগ-সুবিধা, দৃষ্টিভঙ্গি আরো নানা বিষয়ে রয়েছে তারতম্য।

ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের সুদীর্ঘ প্রতিবেদনে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের ক্ষমতায়ন, সমাজ পরিবর্তনে (বাল্যবিবাহ) খেলাধূলার ভূমিকা,নারীদের বঞ্চনার পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন। 

সমাজ পরিবর্তন ও বাল্যবিবাহ রোধে ক্রীড়াঙ্গন

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম এক উজ্জ্বল উদাহরণ। নারী ফুটবল দলের অনেকেরই ছিল না ঘর-বাড়ি। তাদের পরিবার তিন বেলা খাবার জোগাতেই হিমশিম খেত। দারিদ্র্যের কষাঘাতে সেই সমাজে বাল্যবিবাহ ছিল নিয়মিত ঘটনা। 

ফুটবলের মাধ্যমে নারীরা সেই চিত্র পরিবর্তন করেছেন। তারা ফুটবলের মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেছেন। পাশাপাশি আর্থিকভাবে পরিবারকে কিছুটা স্বচ্ছলতা এনে দিতে পেরেছেন। নারী ফুটবলাররা আঞ্চলিক পর্যায়ে কয়েক বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিশেষত অ-১৬ নারী ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়ার গন্ডি পেরিয়ে দুইবার এশিয়ার শীর্ষ আটের লড়াইয়ে ছিল। সাফ অঞ্চলে বাংলাদেশ অ-১৫, ১৮, ১৭ কয়েকবারের চ্যাম্পিয়ন। নারীদের এই সাফল্যে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কৃত করেছেন বেশ কয়েকবারই৷ এর মাধ্যমে গৃহহীণ পরিবারের গৃহ বা দিনমজুর বাবার পেশাও বদল হয়েছে।

শুধু নিজের পরিবারই নয়, তাদের মাধ্যমে এলাকার উন্নয়নও ঘটছে। অনেক এলাকা ছিল বিদ্যুৎহীন, নারী ফুটবলারও সাফল্যে খোঁজ মিলেছে সেসব এলাকার। তখন প্রশাসন সেই এলাকায় বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করেছে। নারী ফুটবল দলের অনেকের বাড়িই পাহাড়ি। নারী ফুটবলারদের সামাজিক অবস্থানের ফলে পাহাড়ি অনেক দুর্গম জেলাতেও সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। 

নারী ফুটবলাররা সাবলম্বী হওয়ায় এখন তারা আর বাল্যবিবাহের চাপে নেই। তারা এখন তাদের গ্রামে ও নিজস্ব এলাকায় অন্য সবার কাছে আইকন। মারিয়া-সাবিনাদের অনুসরণ করে অন্য নারীরা ক্রীড়াঙ্গনে আসছে। গত এক যুগের বেশি সময় বাংলাদেশ নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করছেন মাহফুজা আক্তার কিরণ। খেলাধূলা বিশেষ করে ফুটবলের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের প্রবণতা কমেছে বলে মনে করেন এই সংগঠক, ‘নারী ফুটবল নিয়ে যখন আমরা কাজ শুরু করেছিলাম তখন অনেক নারী ফুটবলারই ঝরে যেত। ঝরে পড়ার নানা কারণের মধ্যে পারিবারিক বাল্যবিবাহের চাপও ছিল। এখন মেয়েরা ফুটবলে আসছে এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পরিবারও তাদের প্রতি আস্থা রাখছে। যার ফলে খেলাধূলায় আসা নারীদের বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেশ কমছে।’

নারী ফুটবলারদের বাফুফে শুধু ফুটবল-ই শেখায়নি একাডেমিক শিক্ষারও ব্যবস্থা করেছে। খেলা ও পড়া উভয় এক সাথে হওয়ায় আর্থিক নিশ্চয়তা ও সামাজিক মূল্যবোধ দুটোই হয়েছে নারীদের। যার ফলে মেয়েরা এখন নিজেরাই অনেক সচেতন এবং বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছে। বাল্যবিবাহের চাপ এড়াতে অনেক ক্রীড়াবিদ খেলাধূলার ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে। তারা পরবর্তীতে অনেক খেলায় দেশের হয়ে পদকও এনেছে। 

সাবেক ভারত্তোলক ও বর্তমান কোচ শাহরিয়া সুলতানা সূচি গত এক থেকে দুই দশকের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেন এভাবে, ‘বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীররা বিশেষ অবস্থান অর্জন করেছে। ক্রিকেটে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন, ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়ন, আমাদের ভারত্তোলনে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছে। সাতারে শিলা রেকর্ড গড়ে এসএ গেমসে স্বর্ণ জিতেছে। এই সাফল্য যাত্রা সমাজ পরিবর্তনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। আগের চেয়ে মেয়েরা খেলাধূলায় আসছে এবং খেলাধূলার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা রাখা যায় সেটাও প্রমাণ হচ্ছে। সামগ্রিক বিষয়ে সচেতনার বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক বাল্যবিবাহ রোধে ক্রীড়া বড় ভূমিকা রাখতে সাহায্য করছে।’

বাল্যবিবাহ রোধে শুধু নারীরাই নন, পুরুষরাও ভূমিকা রাখেন। অনেক পুরুষ ক্রীড়াবিদ সচেতনতার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীদের বিয়ে করেন না। সমাজে বাল্যবিবাহ রোধে ভূমিকা রাখেন। তাই বাল্যবিবাহ কমার পেছনে পুরুষ ক্রীড়াবিদদেরও অবদান দিলেন সাবেক ভারত্তোলক শাহরিয়া সুলতানা, ‘নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও বাল্যবিবাহ রোধে ভূমিকা রাখছে। নিজেরা বাল্যবিবাহ করছে না আবার সমাজে অন্য কেউ বাল্যবিবাহ করলেও বাধাও দিচ্ছে।’ 

পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

খেলাধূলায় নারীদের বিভিন্ন পোষাক পরে খেলতে হয়। কিছুদিন আগেও স্পোর্টস কস্টিউমে নারীদের অনেক কটু কথা শুনতে হতো। কট্যুক্তিকারীদের বড় অংশই ছিলেন পুরুষ। এখন সেই হার অনেকটাই কমে এসেছে। সাধারণ পুরুষ ছাড়াও ঘরের স্বামী, ভাইরাও ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে আসতে নারীদের সহায়তা করছে। সাবেক ভারত্তোলক ও জাতীয় ভারত্তোলন দলের কোচ শাহরিয়া সুলতানা সূচি বলেন, ‘আগে মেয়েরা স্টেডিয়াম এলাকায় চলাচল করলে অনেক কথা কানে আসত। মনে হতো কোনো ‘চিড়িয়া’ যেন নারী ক্রীড়াবিদরা। এখন সেই অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। পুরুষরা এখন নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে অংশগ্রহণ খুব ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। বাইরে যেমন নারীরা সাপোর্ট পাচ্ছে, ঘরেও তেমন। একজন বাবা, স্বামী বা ভাই সমর্থন না করলে নারীর পক্ষে মাঠে এসে খেলা সম্ভব নয়।’

সাফল্যে নারীরা অগ্রগণ্য। ছেলেরা ক্রিকেটে এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, মেয়েরা পেরেছে। এরপরও মেয়েদের বেতন সামান্য এবং বকেয়া থাকে।

ক্রীড়াঙ্গনে এসে অনেক নারীই জীবনের জুটি গড়েছেন সতীর্থ খেলোয়াড়ের সঙ্গে। এমনই একজন সাতারু মাহফুজা খাতুন শিলা। তার স্পোর্টস ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে স্বামী শাহজাহান আলী রনির অবদান দিলেন অনেক, ‘আমার ভালো পারফরম্যান্স এবং খেলার পরবর্তীতে কোচিং ক্যারিয়ার সব কিছুতেই রনির অবদান অনেক। আমার সফলতায় অবদান রয়েছে তারও।’ ব্যাডমিন্টনেও রয়েছে এমন জুটি। এলিনা ও এনায়েত দুই জনই সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এখন তারা জীবনসঙ্গী। এনায়েত ছিলেন এলিনার কোচও।

এক নারী ফিফায়, আরেক নারী ফেডারেশন সেক্রেটারি

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ক্ষমতায়ন সেভাবে হয়নি। ক্রিকেট,ফুটবল বাদে ফেডারেশনগুলো মূলত পরিচালিত হয় সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জুডো ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার হিরুই একমাত্র নারী। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র নির্বাচিত নারী সম্পাদক। এর আগে টেবিল টেনিস ফেডারেশনে জোবেরা রহমান লিনু অ্যাডহক কমিটি এবং ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনে ডানা ও মরিয়ম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। 

বর্তমানে জুডো বাদে বাকি সব ফেডারেশনেই সাধারণ সম্পাদক পুরুষ। শুধু সাধারণ সম্পাদকই নয় অনেক ফেডারেশনের প্রায় ৯৫ ভাগ সদস্যই পুরুষ। দেশের সবচেয়ে বড় খেলা এবং শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা ক্রিকেট বোর্ড। সেই বোর্ডের নির্বাহী কমিটিতে নেই নারী প্রতিনিধিত্ব। 

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। সেই ফুটবল ফেডারেশনে প্রথম নির্বাচিত নারী সদস্য এসেছে ২০১৬ সালের নির্বাচনে। মাহফুজা আক্তার কিরণ ফুটবল ফেডারেশনের প্রথম নির্বাচিত নারী সদস্য। মাহফুজা আক্তার কিরণ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নেন। 

বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে সর্বোচ্চ বড় সংস্থা হিসেবে স্বীকৃত ফিফা। কিরণ দুই মেয়াদে ফিফার নির্বাহী কমিটিতে সদস্য হিসেবে নির্বাচনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নারী ফুটবল কমিটির প্রধানও তিনি। 

আর্থিক বৈষম্য বিদ্যমান

বাংলাদেশের শীর্ষ দুই জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এবং ক্রিকেট। এই দুই খেলায় বাংলাদেশ পুরুষ দল এখনো মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। তবে নারী ক্রিকেট দল ইতোমধ্যে এশিয়ার সেরা হয়েছে। নারী অনুর্ধ্ব ফুটবল দল এশিয়ার শীর্ষ আটে খেলেছে।

সাফল্যের বিচারে এগিয়ে থাকলেও আর্থিক সুবিধায় পিছিয়ে নারীরা। ২০২২ সালে নারীরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম অর্জন। সেই অর্জনের পর সাবিনাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করতে হয়। নানা আন্দোলনের পর ফুটবল ফেডারেশন বেতন বাড়ায়। বেতন বৃদ্ধির পর নারী ফুটবলারদের সর্বোচ্চ ক্যাটাগরির বেতন এখন মাসে ৫০ হাজার। 

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফেডারেশনের সেক্রেটারি হয়েছে মাত্র ১ জন, বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় পর্যায়ের কমিটিতে একজন৷  অনেক ফেডারেশনের কমিটিতে নেই নারী প্রতিনিধিত্ব

ফুটবল ফেডারেশনের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দেশের আরেক শীর্ষ বোর্ড ক্রিকেটে কয়েকশ’ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত। সেই বোর্ডেও নারী ক্রিকেটাররা সম্মানী পান যৎসামান্য। গত বছর এ গ্রেডভুক্ত নারী ক্রিকেটাররা পেতেন ৮০ হাজার টাকা। সর্বশেষ ডি গ্রেডে ছিল ৩০ হাজার টাকা। এই বছর মাঝামাঝিতে ২০ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি হয়েছে লাখ টাকা আর সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা। 

অন্য দিকে পুরুষদের চিত্র ভিন্ন। পুরুষদের সর্বনিম্ম ক্যাটাগরি নারীদের সর্বোচ্চ ক্যাটাগরির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ প্লাস গ্রেডে একজন ক্রিকেটার টেস্ট ও ওয়ানডে খেলে মাসে পান সাড়ে ৮ লাখ টাকা। সবশেষ ডি-গ্রেডে তিন সংস্করণে পান তিন লাখ টাকা। 

সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, নারীদের সামান্য অর্থও আবার বকেয়া থাকে। সম্প্রতি নারীদের কয়েক মাসের আর্থিক সম্মানী বকেয়া পড়েছিল। বিসিবি নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান এই দায় অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন। সাবিনাদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির আন্দোলন আর নিগার সুলতানা জ্যোতিদের কয়েক মাসের বকেয়া এটাই প্রমাণ করে সাফল্যের পরেও নারীরা অবহেলিত।

প্রায় পুরো বিশ্ব জুড়েই পুরুষ ও নারী খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতায় বড় ফারাক লক্ষ্য করা যায়। তবে ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ড ও ভারত অবশ্য দারুণ এক কাজ করেছে। নিউজিল্যান্ড প্রথম পুরুষ ও নারীদের সমান ম্যাচ ফি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। নারী-পুরুষের পারিশ্রমিকে সাম্য এনেছে।

ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি’র সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন নিয়ে নারীদের আর্থিক বরাদ্দ নিয়ে। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার অবশ্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ফিফা সদস্যভুক্ত দেশগুলো যে অনুদান পায় সেই অনুদানের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী ফুটবল খাতে ব্যয় করতে হবে। ফিফার নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন বাফুফের মহিলা উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ। ফিফার সাবেক সদস্যের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সমতা বা সামঞ্জস্যতা আনতে হলে অনুদান বন্টন নির্দেশনাতে পরিবর্তন আনা উচিত। 

ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোতেও বৈষম্য কম নয়। টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন দুই খেলা বেশ জনপ্রিয়। সেই খেলায় অনেক সময় দেখা যায় পুরুষরা যা পান, নারীরা তার চেয়ে বেশ কম। ক্লাব বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তির সঙ্গে যেমন তারতম্য থাকে তেমনি তারতম্য থাকে প্রাইজমানিতেও। টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন উভয় খেলার কয়েকজন সাবেক নারী চ্যাম্পিয়ন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরা বেশি অর্থ পায়, আমরা কম পাই। অথচ আমরা কিন্তু তাদের তুলনায় ম্যাচ কম খেলি না। দিন শেষে আমরা সবাই। আমরা তো পুরুষদের তুলনায় কম পরিশ্রম করি না।’

টেনিসের মতো জনপ্রিয় খেলায় নারীরা খেলেন তিন সেট আর পুরুষরা পাচ সেট। এ রকম অনেক খেলায় নারী-পুরুষ ভেদে দৈর্ঘ্য, পরিধির পার্থক্য রয়েছে। এর মাধ্যমে অনেক ঘরোয়া খেলায় নারীদের পারিশ্রমিক বঞ্চিতের কথা উঠেছে নানা আলোচনায়, ‘আমরা যদি কর্মকর্তাদের বৈষম্য কমাতে বলি, তাহলে বলবে মেয়ে খেলোয়াড় তো কম। আরো বলে থাকে কজন মেয়ে ভালো খেলে? আমরা কিছু বললে তা ততটা আমলে নেওয়া হয় না।’

কোচ-আম্পায়ার-রেফারির সংখ্যায় পিছিয়ে নারীরা 

খেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোচ, আম্পায়ার-রেফারি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা এই ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষদের চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক খেলায় নারী কোচ, জাজই নেই। আবার কোনো খেলায় থাকলেও সেটাও খুব স্বল্প সংখ্যক।

দেশের প্রায় সকল খেলায় নারী দল রয়েছে। নারী দল পৃথক থাকলেও নারী কোচ সব খেলায় গড়ে উঠেনি। ফলে নারী দলে বাধ্য হয়েই পুরুষ কোচ কোচিং করাতে হয়।  জাতীয় পর্যায়ে যখন এই অবস্থা জেলা পর্যায়ের চিত্র সহজেই অনুমেয়। প্রায় সব জেলা দল যখন ঢাকায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার খেলা অথবা ফেডারেশনের অধীনে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন খেলতে আসে তখন পুরুষ কোচ নিয়েই আসে। 

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে নারী কোচের সংখ্যা ১২, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ১ জন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে ৩ জন, এছাড়া সার্ভিসেস বাহিনী ও এর বাইরে হাতে গোণা কোচ রয়েছেন। সকল খেলা মিলিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে সক্রিয় কোচের সংখ্যাটা ৩০-৩৫ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

কোচের মতো খেলার বিচারকেও রয়েছে নারীর ঘাটতি। ফুটবল, ক্রিকেটসহ কিছু খেলায় অনেক নারী কোচ আবার খেলার বিচারকও। কিছু খেলায় একদম নেই। সাম্পতিক সময়ে সাবেক জাতীয় নারী ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জেসি অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবার ফুটবলে জয়া চাকমা শত প্রতিবন্ধকতা দূর করে ফিফা রেফারি হয়েছেন। সালমা সহকারী রেফারি হিসেবে এশিয়ার শীর্ষ তালিকায় আছেন।

শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকটি খেলায় সক্রিয় নারী কোচের সংখ্যা:

ফুটবল : ৭ (অনন্যা, জয়া চাকমা, আছিয়া খাতুন বিথী , লীনা চাকমা,সুইনু মারমা, মিরোনা, তৃষ্ণা চাকমা) 

ক্রিকেট : ৪ (সাথিরা জাকির জেসী, ডলি রানী সরকার, ফাতেমা-তুজ-জোহরা,রেশমা আক্তার )

হকি : ১ 

হ্যান্ডবল :১ (ডালিয়া আক্তার )

অ্যাথলেটিক্স : ৬ (সুফিয়া খাতুন, রাজিয়া সুলতানা অনু,মাহবুব আরা বেলি, খুরশিদা খুশি, ফৌজিয়া হুদা জুই ও কানিজ সুলতানা)।

সাঁতার : ৩ (লায়লা নূর, অ্যানি, তানিয়া আফ্রিন)

কাবাডি : ১ (শাহনাজ মালেকা )। 

ভারত্তোলন : ১ (শাহরিয়া সুলতানা)  

টিটি;ব্যাডমিন্টন;বাস্কেটবল;দাবা: নেই

ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে নিপীড়ন

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারী নির্যাতনের ঘটনা নীরবে-নিভৃতে ঘটে। কয়েক বছর পরপর দু’একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। গত বিশ বছরের মধ্যেই কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। ক্রীড়াঙ্গন নিপীড়নমুক্ত হোক চান দুই বার সাফে স্বর্ণ জেতা ভারোত্তলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত , ‘আমরা নিপীড়নমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন চাই। অবশ্যই ক্রীড়াঙ্গনে নিপীড়ন বিরোধী একটি সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। মাঝে মধ্যে ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সাধারণ শাস্তি বহিষ্কার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটি সুনির্দিষ্ট সেল ও আইন থাকলে অনেকে অনৈতিক কাজ করার সাহস দেখাবে না। এই বিষয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।’

সমাজের অন্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও নারীরা নিপীড়নের শিকার হন। ক্রীড়াঙ্গনে নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা সাঁতারে। নির্যাতনের শিকার হয়ে এক নারী সাঁতারু অল্প বয়সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। ক্রীড়াঙ্গনে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, রয়েছে মানসিক নিপীড়নও। নারী ক্রীড়াবিদদের পোশাক, চাল-চলন, বিয়ে, পরিবার নিয়ে কটু মন্তব্য করেন ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেকেই। নারীদের ক্ষেত্রে মাঠে ভালো পারফরম্যান্স করার পরও অনেক সময় শুনতে হয় বাজে মন্তব্য। এই মানসিক পীড়নের ফলে অনেক সময় নারী ক্রীড়াবিদরা অনুশীলন ও খেলায় স্বাভাবিক পারফরম্যান্স করতে পারেন না। এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জেন্ডার শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি। 

জেলা পর্যায়ে মানসিক নিপীড়নের সংখ্যা বহুগুণ। তিন দশক ধরে সিলেট জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে কাজ করা মারিয়াম চৌধুরী বলেন, ‘মেয়েরা খেলতে আসলে বাজে কথা শুনত। এতে অনেক মেয়ে খেলা থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে অভিভাবকদের বোঝাই। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে যদি জেলায় জেলায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সচেতনতা ও মানসিক নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকত তখন এটা আরো কার্যকরী হতো।’ 

সাবেক তারকা সাঁতারু নিবেদিতা দাস মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। নারী নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা এই অধিদপ্তর দেখভাল করে। তার সেই দায়িত্ব থেকে উপলব্ধি, ‘একজন নারী ক্রীড়াবিদ ভুক্তভোগী হলে সে মহিলা অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারে। অনেক সময় অভিযোগ করার মতো মানসিক-শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য এমনকি ইচ্ছেও থাকে না। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকলে তখন নারী ক্রীড়াবিদটি সেই সেলকে জানালে তারা পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সহায়তার সুযোগ করে দিতে পারে।’ 

গত দুই দশকে আলোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনা ও অভিযোগ 

১। কোচের উপর তরুণী অ্যাথলেটের অভিযোগ 

২। ব্যাডমিন্টনে নারী ক্রীড়াবিদের অভিযোগ 

৩। সাঁতারে এক নারীর আত্মহত্যা 

৪। সাঁতারে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বহিষ্কার 

৫৷ টেনিসে সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক লাঞ্ছনার ঘটনা 

৬। ভারত্তোলনে নিপীড়নের অভিযোগ

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের খেলায় আনা, নারীদের প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। ধানমন্ডিতে কয়েক একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। ৫০ বছর পার করলেও ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই প্রতিষ্ঠান খুব বেশি কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারেনি।

৫০ বছরে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা বিভিন্ন খেলা নানা পর্যায়ে আয়োজন করেছে। এই পাঁচ দশকে খেলা আয়োজনের সংখ্যায় হাজার, প্রতিযোগীর সংখ্যা লাখ স্পর্শ করলেও মানোন্নয়ন করে জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন এমন নারী ক্রীড়াবিদের সংখ্যা সব খেলা মিলিয়ে হাজারের অঙ্ক ছোঁয়াই কষ্টসাধ্য। আনুমানিক এই হিসেবে যেটা প্রতিযোগি সংখ্যার অনুপাতের এক শতাংশেরও নিচে!

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার খেলায় অংশ নেওয়া নারীদের বাছাই ও মান্নোয়ন করে ফেডারেশনের কাছে সরবরাহ হলে জাতীয় খেলোয়াড় তৈরিতে থাকত বড় ভূমিকা। নানা সীমাবদ্ধতা ও সংকটে সেটা না হওয়ায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা জাতীয়ভাবে ৫০ বছরে তেমন অবদান রাখতে পারছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে পাঁচ দশকের উত্থান-পতন ও নানা ঘটনার সাক্ষী ক্রীড়া সাংবাদিকতার প্রথিকৃৎ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি। জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় সরবরাহে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখার তুলনায় জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টের সময় আবাসিক স্থল হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য এই সংস্থা এককভাবে দায়ী নয়, এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সংকট রয়েছে নেতৃত্ব সংকটসহ নানা বিষয়।’

বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে রয়েছে বিভাগীয় ও জেলা ক্রীড়া মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছর হলেও এর অধিভূক্ত সংস্থাগুলো এখনো রীতিমতো ধুঁকছে। নেই নিজস্ব অফিস কক্ষ, আবার কক্ষ থাকলেও নানা সমস্যায় জর্জরিত। সঙ্গে রয়েছে আর্থিক সীমাবদ্ধতাও।

দুই দশক আগেও জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে সরাসরি অর্থ বরাদ্দ পেত না। জেলা ক্রীড়া সংস্থার বরাদ্দের ২০ শতাংশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে প্রদানের নির্দেশনা ছিল। অনেক জেলা এটা দিত না। পরবর্তীতে এনএসসি সরাসরি জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে অনুদান দিচ্ছে। ৬৪ জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ও ৮ বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা মিলে চলমান অর্থ বছরে সর্বমোট এক কোটি টাকার একটু বেশি বাজেট বরাদ্দ পেয়েছে। যা গড়ে এক লাখ টাকার একটু বেশি (অনেক জেলা এক লাখের কমও পায়)। এত স্বল্প টাকা দিয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা খেলা পরিচালনা করা অসম্ভব। কিছু জেলা এত স্বল্প বাজেটে অনাগ্রহী হয়ে তেমন কিছুই করে না। ফলে এই অর্থ কিছু ক্ষেত্রে অনর্থক ব্যয়ও ঘটে। কিছু জেলা অবশ্য নিজেদের উদ্যোগে বেশ কিছু খেলাও আয়োজন করে। 

ক্রীড়াঙ্গনে প্রায়ই নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। এই সকল ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে। সাবেক তারকা সাঁতারু মহিলা ক্রীড়া সংস্থার প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে আইন ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও দেখছেন, ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থা একটি নিপীড়ন বিরোধী সেল করতে পারে। সেই সেলের সুপারিশ, পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকবে না। ফেডারেশনের কোনো ঘটনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার নেই মহিলা ক্রীড়া সংস্থার। কারণ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ফেডারেশনের একটি অধিভুক্ত সংস্থা। ফলে আইনত ও গঠনতান্ত্রিকভাবে ফেডারেশনের বিষয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারে না।’

এজেড/জেএ