বাংলাদেশ সাঁতারের জাপানি বন্ধু
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সুইমিং কমপ্লেক্সে চলছে ম্যাক্স গ্রুপ ৩২ তম জাতীয় সাঁতার। এক জাপানিজ কিছুক্ষণ পর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরছেন। কাউকে পরামর্শ দিচ্ছেন, আবার কেউ এসে নিজের ভুল ত্রুটি জানতে চাইছেন। অথচ তিনি এই জাতীয় সাঁতারে কোনো সংস্থার বা ফেডারেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কেউ নন। স্বেচ্ছায় জাপান থেকে এসে বাংলাদেশের সাঁতারের টানেই এমনটা করছেন তাকাহিরো তাগুচি।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক খেলায় অনেক বিদেশি কোচ এসেছেন। কেউ সাঁতারের তাকাহিরো তাগুচির মতো নন। দায়িত্ব ছাড়ার পর কেউ গাটের পয়সা খরচ করে বাংলাদেশের খোঁজ নিতে আসেন না। তাগুচি নিজের পয়সা খরচ করে বাংলাদেশের সাঁতার দেখতে আসেন, আবার বাংলাদেশ সাঁতার দল তার নিজ দেশ জাপানে গেলে স্বেচ্ছায় সময় দেন। এমন নজির বাংলাদেশের অন্য কোনো খেলার অন্য কোনো কোচের নেই। তাই তাগুচি বাংলাদেশ সাঁতারের অকৃত্রিম বন্ধু।
বিজ্ঞাপন
১৯৮৭ সালে জাপান-বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসেন। সাতার ফেডারেশনের কোচ ছিলেন বছর দু’য়েক। এরপর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কোচিং করিয়েছেন তিন বছরের মতো। তাঁর কোচিংয়েই কারার মিজান ১৯৯৩ সাফ গেমসে এই মিরপুর পুলে এসএ গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন। এরপর বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও বিভিন্ন সময় সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের সাঁতারের টানে ছুটে এসেছেন। কখনো বাংলাদেশে এসেছেন আবার কখনো নিজ দেশ জাপানেও বাংলাদেশের সাঁতারের জন্য কাজ করেছেন।
২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ সাঁতার দলের উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন। গত দুই মাস আগে জাপানের ফুকুওয়ায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে নিজ খরচে টোকিও থেকে ফুকুওয়ায় গিয়ে বাংলাদেশ সাঁতারুদের সময় দিয়েছেন। এজন্য বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক বা সম্মানী কিছুই নেন না।
জাইকায় কাজ করায় বাংলা অবলীলায় বুঝতে ও বলতে পারেন তাগুচি। অনেক সময় জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় কাজে দোভাষী হিসেবেও বাংলাদেশে আসা হয় তার । তবে এবার চলমান জাতীয় সাঁতার দেখতেই জাপান থেকে এসেছেন। করোনা পরবর্তী সময়ে ফ্লাইটের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক। এক সপ্তাহ ঢাকায় থাকা এবং আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রায় হাজার দুই ডলার ব্যয় হবে তার।
তবে বাংলাদেশের সাঁতারুদের কাছ থেকে দেখাতেই তার প্রশান্তি, ‘আমার ছাত্রদের কাছ থেকে দেখতে পারছি এটাই আমার শান্তি। তারা কেউ এখন কোচ, কেউ কর্মকর্তা। তারা কেমন করছে সেটা নিজ চোখে দেখছি। মোবাইলে যোগাযোগ আছে, তবে কাছ থেকে দেখার আনন্দই আলাদা। তাই আমি চলে আসি। ’
তাগুচির অধীনে অনুশীলন করেছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁতারু সেলিম মিয়া। ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক সেলিম গুরু তাগুচি সম্পর্কে বলেন, ' তার কোচিংয়ে বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে। তবে পদক সংখ্যায় তাকে বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশ সাঁতারের প্রতি তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। আমাদের যে কোনো প্রয়োজনে তাকে পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে অনেক কিছু বলা যায় তবে এক কথায় বাংলাদেশ সাঁতারের অকৃত্রিম বন্ধু। '
প্রায় তিন যুগ বাংলাদেশের সাঁতার খুব কাছ থেকে দেখছেন তাগুচি। তার চোখে বাংলাদেশ সাঁতারের একাল-সেকাল, ‘আমি যখন আসি তখন বঙ্গবাজার থেকে কাপড় কিনে সাতার কেটে সাঁতার করেছে সাতারুরা। নাস্তা ছিল একটা ডিম শুধু। এই দিকগুলোতে ক্রমান্বয়ে উন্নতি হয়েছে আবার অন্য দিকে অবনতি। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ছিল কারার মিজান। এখন কেউ নেই। কারণ দীর্ঘমেয়াদী উন্নত অনুশীলন পরিকল্পনা নেই। ভারত, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে গেছে গত দুই দশকে। বাংলাদেশ আগের অবস্থানেই আছে। নেপাল, ভুটান এখন বিদেশে রেখে অনুশীলন করায় সাঁতারুদের। সামনের গেমসে তারাও বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ।'
আরও পড়ুন
সাঁতারুদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাঁতার সংগঠক সম্পর্কেও যথেষ্ট ধারণা তাগুচির। বর্তমান ফেডারেশনের কর্মকাণ্ড ও ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে বলেন, 'এখন নিয়মিত সিনিয়র ও জুনিয়র খেলা হচ্ছে। কোচ তৈরির চেষ্টা চলছে। বর্তমান সেক্রেটারি সাঁতারের ট্যাকনিক্যাল জ্ঞান কম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি হলেও সাঁতারের জন্য অত্যন্ত আন্তরিক। সাঁতার উন্নয়নের চেষ্টা রয়েছে। '
জাপানের টোকিওর পাশের শহরে তাগুচির জন্ম। ষাটোর্ধ এই সাঁতারু কোচের কাছে বাংলাদেশ দ্বিতীয় হোম, 'বাংলাদেশের সাঁতার ও বাংলাদেশের মানুষদের সঙ্গে আমার জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছি। বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় হোম। জীবনের বাকি সময়টাও বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে চাই। বাংলাদেশের সাঁতার এগিয়ে গেলেই আমার শান্তি ' আবেগঘন কন্ঠে বলেন তাগুচি।
এজেড/