ছবি: প্রতিবেদক

গেমস মানেই উন্মাদনা, হৈ চৈ। এই ধারণা পাল্টে যাবে হাংজুর মাইন্ড স্পোর্টস সেন্টারে। চারদিকে সুনশান নিরবতা। এর মধ্যেই টেবিলগুলোর বিভিন্ন কর্ণার থেকে কার্ড ছাড়ছেন ব্রিজ খেলোয়াড়রা।

বাংলাদেশ এবার হাংজু এশিয়ান গেমসে ১৭ ডিসিপ্লিনে অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে ব্রিজ ডিসিপ্লিনটা একটু ভিন্নই। অন্য সকল ডিসিপ্লিনের ক্রীড়াবিদদের খেলাই জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস। ব্রিজে অবশ্য তা নয়। গেমসে আসা বাংলাদেশ ব্রিজ দলের খেলোয়াড়রা একেক জন একেক পেশার। পেশাগত ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকেই এশিয়াডের প্রস্তুতি নিয়েছেন। গতকাল এক রাউন্ডে স্বাগতিক চীনকে হারিয়েছেও বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্রিজ দলের অন্যতম খেলোয়াড় আশিফুর রহমান চৌধুরি দেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাপ্লাই চেইন বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। পেশাগত পরিচয় আশিফুর রহমান হলেও ক্রীড়াঙ্গনে তার পরিচয় হকির রাজীব হিসেবেই। ১৯৯৮ সালে হকিতে ক্যারিয়ার শুরু করা রাজীব পরের বছরই এশিয়া কাপ হকি খেলেন।

ঘরোয়া লিগ অনিয়মিত ও ক্যারিয়ারের স্থায়ীত্ব বিবেচনায় হকির পাশাপাশি পড়াশোনাতেও মনোযোগ ছিল রাজীবের। তাই আবাহনী, মোহামেডানে খেলার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান থেকে একাডেমিক পর্ব শেষ করেছেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া হকি খেলে পরিবর্তে কর্পোরেট চাকুরিতেই ক্যারিয়ার গড়েছেন রাজীব। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র রাজীব কর্মজীবন ইস্পাহানি গ্রুপে। হল জীবন এবং পেশাগত ক্ষেত্র দু’টোই বাংলাদেশের ব্রিজের উর্বরক্ষেত্র। এই দুইয়ের যোগসূত্রেই হকির রাজীবের ব্রিজ খেলোয়াড়ে রুপান্তর। 

২০০৪ সাল থেকে ব্রিজ খেলা শুরু রাজীবের। ২০১১ সালের পর থেকে মূলত জাতীয় পর্যায়ে ব্রিজ খেলোয়াড় হিসেবে নাম ছুটতে থাকে রাজীবের। জাতীয় পর্যায়ের পর ব্রিজ জাতীয় দলেও প্রবেশ। হকিতে জাতীয় দলে বেশি বছর না খেলা হলেও ব্রিজে পারি দিয়েছেন বেশ কয়েক বছরই। ইতোমধ্যে দু’টি ব্রিজ বিশ্বকাপ খেলেছেন।

ব্রিজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে কয়েকবারই প্রতিনিধিত্ব করলেও এই এশিয়ান গেমসে রাজীবের জন্য একটু ভিন্ন অনুভূতিরই, ‘গেমসের আমেজ ও মর্যাদা ভিন্ন ধরনের। আমার ক্যারিয়ার হকি দিয়ে শুরু। একই গেমসে বাংলাদেশ হকি দলও খেলছে আর আমিও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি ব্রিজের মাধ্যমে। এটি আমার কাছে অবশ্যই বিশেষ।’ 

সত্তর-আশির দশকে কাওসার আলী, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, বশির আহমেদ, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, রামা লুসাইরা এক সঙ্গে ফুটবল, হকি,ক্রিকেট জাতীয় দলে খেলেছেন। পরবর্তীতে পেশাদার যুগে একই খেলোয়াড় একাধিক খেলার ঘটনা কমছে। গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে রাজীবই একটু ব্যতিক্রমী উদাহরণ। এজন্য অবশ্য তিনি বেশ গর্বিত, ‘এটা আমার জন্য দারুণ ব্যাপার যে আমি বাংলাদশেকে দু’টো খেলায় প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে হকিতে এবং হকি ছাড়ার পর ব্রিজের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি।’

হকি অত্যন্ত গতি নির্ভর খেলা। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত খেলা হকির একেবারে বিপরীত অবস্থান ব্রিজের। ঠান্ডা মস্তিষ্কের লড়াই। দুই মেরুর দুই খেলার মেলবন্ধন সম্পর্কে রাজীব বলেন, ‘আমার কাছে দু’টি খেলাই মানসিক বিষয়টি বেশি শারীরিকের তুলনায়। ব্রিজ অনেক বেশি ধের্য্য, যুক্তি এবং মনস্তত্বাত্তিক আর হকি অনেকটা ট্যাকনিক-ট্যাকটিস নির্ভর।’ 

হকির মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনে রাজীবের যাত্রা। যদিও গত এক যুগের বেশি সময় হকির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই তার। এরপরও হকিকে ধারণ করেন মনেপ্রাণেই, ‘আমার জন্মস্থান ফরিদপুরে হকি খেলেই আমার বেড়ে উঠা। হকি আমার রক্তে, এটা ভোলার এবং ছাড়ার নয়। এখনও সুযোগ পেলে হকি দেখি এবং খেলে আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করি।’ হকি রক্তে থাকলেও বাকি জীবন অবশ্য ব্রিজের সঙ্গেই থাকতে চান, ‘ব্রিজ আমার অন্য রকম এক প্যাশন যা জীবনের বাকি সময় বয়ে বেড়াতে চাই।’

রাজীবের মতোই ব্রিজের প্যাশন এশিয়াড খেলতে আসা বাংলাদেশ দলের অন্য খেলোয়াড়দেরও। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্রিজ খেলোয়াড়দের একজন শাহ জিয়াউল হক। যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকতা। কামরুজ্জামান কৃষি ব্যাংকের এজিএম, মনিরুল ইসলাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, সুমন এক্সিম ব্যাংকে কর্মরত। একেকজন একেক পেশার একেক বয়সের হলেও ব্রিজই তাদের মেলবন্ধন। দিনে এক সময় অথবা সপ্তাহের ছুটিতে মেতে উঠেন ব্রিজ আনন্দে। সুন্দর বোঝাপড়ায় রাজীব-জিয়াদের ব্রিজ লাভার্স দল অন্যদের হারিয়ে ( এশিয়ান গেমসে দল নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ট্রায়াল ) চীনের হাংজুতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

এজেড/জেএ