ক্রীড়াঙ্গনে অগ্রযাত্রায় পথ দেখাচ্ছেন নারীরা
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যর্থতার ভিড়ে সাফল্য আছে হাতেগোনা। আর সেসবের গর্বিত অংশীদার এ দেশের নারী ক্রীড়াবিদরা। রক্ষণশীল সমাজের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একের পর এক সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে চলেছেন নারীরা। অদম্য মেয়েদের সাফল্যে স্বগর্বে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা, সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের হাত ধরে দেশের ফুটবলের ১৯ বছরের শিরোপার অপেক্ষা ফুরোয়। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে সাবিনা-সানজিদারা। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাস পাঁচেক পর আবারও দেশকে উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দেন সেই নারীরাই। তবে এবার সাফল্য আসে সাবিনাদের উত্তরসূরীদের হাত ধরে। গেল ফেব্রুয়ারিতে নারীদের অনূর্ধ্ব-২০ সাফ ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রযাত্রায় পুরুষের পাশাপাশি সমান ভূমিকা রাখছেন নারীরা। সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে দৃঢ় মনোবলে আত্মনির্ভরশীলতার বড় উদাহরণ দেশের নারী ফুটবল দল। নিজেদের সাফল্যে এখন অনুজদের মাঝেও ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। সাবিনা, আঁখিদের দেখানো পথ ধরে খেলাধুলায় আগ্রহী হচ্ছেন নতুনরা। নিচ্ছেন পেশা হিসেবে। শুধু কি ফুটবল? দেশের ক্রিকেটেও আলো ছড়াচ্ছেন নারীরা। সবসময় পাদপ্রদীপের আলোতে থাকা জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল এখনও কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জিততে না পারলেও দেশের ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য আসে নারী ক্রিকেট দলের হাত ধরে। ২০১৮ সালে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে সালমা-জাহানারারা এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে নেয়।
বিজ্ঞাপন
ক্রিকেট কিংবা ফুটবল নয়, অন্যান্য ডিসিপ্লিনেও আশা দেখাচ্ছেন মেয়েরা। পুরুষদের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে আপন স্বত্ত্বা নিয়ে। এই যেমন ভারোত্তলক মাবিয়া আক্তার সীমান্তর কথাই ধরুন না। এসএ গেমস ও কমনওয়েলথে স্বর্ণ জয়ের পাশাপাশি ঝুলিতে আছে তার অসংখ্য অর্জন। সীমান্তর মতই দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের আরেক অনন্যা দিয়া সিদ্দিকী। বিশ্ব আর্চারীতে দেশসেরা আর্চার রোমান সানাকে সঙ্গে নিয়ে জিতেছেন রৌপ্য।
তবে নারীদের হাত ধরে লাল-সবুজের শ্রেষ্ঠত্বের আনন্দের মধ্যেও কিছুটা বিশাদও আছে। আছে না পাওয়ার ক্ষোভ কিংবা পদে পদে বঞ্চনার গল্প। সাফ জয়ের পরই মূলত লাইমলাইটে আসে দেশের নারী ফুটবলাররা। তবে এমন সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে অনেক সীমাবদ্ধতা ও বাধার দেয়াল পেরোতে হয়েছে ফুটবলারদের। তাদের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছেন বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে কিংবা কেউ আবার পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। যেমনটা গেল বছর ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক পোস্টে বলেছিলেন ফুটবলার সানজিদা আক্তার। তিনি লেখেন, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আছে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত।’
ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার এক অজপাড়া গ্রাম মন্দিরঘোনা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামটিতে যেতে হলে নৌকাই একমাত্র বাহন। শুকনো মৌসুমেও নেতাই নামক খরস্রোতা নদীটি পানিতে থৈ থৈ করে, তাই অনেকটা কষ্ট করেই যাতায়াত করতে হয় এলাকার মানুষজনকে। তবে অজপাড়াগ্রাম হলেও এই গ্রামটিতে যেন চাঁদের আলো হয়ে এসেছে এক অদম্য মেয়ে। সে আর কেউ নন, সাফজয়ী ফুটবলার মারিয়া মান্দা। শহরের সব আলো-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন এই অদম্য কিশোরী। তার লড়াইয়ের গল্প যে কারও চোখ ভেজাবে। গারো পাহাড়ের কোলে এক গারো পরিবারে জন্ম হয় মারিয়ার। বাবা অনেক আগেই মারা যাওয়ায় সংসার চলে শুধু মায়ের রোজগারে। মায়ের রোজগারের পথ ছিল অন্যের বাড়িতে কাজ করা। টানাপোড়েনের জীবনেও ফুটবল নিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন অদম্য মারিয়া।
সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে আসার পরও অনেক বঞ্চনা সইতে হয় নারী ক্রীড়াবিদদের। বেতন বৈষম্যসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ খেলোয়াড়দের তুলনায় সামান্যই পান নারীরা। পুরুষ ক্রিকেটে ‘এ’ প্লাস ক্যাটাগরি থাকলেও নারী ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি ‘এ’ গ্রেড। ‘এ’ প্লাস ক্যাটাগরির একজন পুরুষ ক্রিকেটারের বেতন ৪ লাখ টাকা। এদিকে, ‘এ’ গ্রেডের একজন নারী ক্রিকেটারের বেতন যেখানে ৫০ হাজার টাকা, সেখানে পুরুষ ‘এ’ গ্রেড ক্রিকেটারের বেতন ৩ লাখ টাকা। নারী ‘বি’ গ্রেড ক্রিকেটারের বেতন যেখানে ৪০ হাজার টাকা, সেখানে পুরুষ ‘বি’ গ্রেড ক্রিকেটারের বেতন ৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া নারী ‘সি’ গ্রেডের একজন ক্রিকেটারের বেতন মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
বৈষম্যের আরেকটা দিক, একদিনের ম্যাচে পুরুষ ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি যেখানে ৩ লাখ টাকা, সেখানে নারী ক্রিকেটাররা পান মাত্র ৯ হাজার টাকা। এ তো গেল ক্রিকেট, ফুটবলের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও খারাপ। যদিও এটাও ঠিক যে, পুরুষ ফুটবলারদের কোনো বেতন দেয় না বোর্ড। তাদের উপার্জন মূলত ক্লাব থেকেই আসে। কিন্তু বৈষম্যটা সেখানেও। শীর্ষ ক্লাবগুলোতে একজন পুরুষ ফুটবলার বছরে যেখানে ৫০-৬০ লাখ টাকা আয় করতে পারেন, সেখানে নারী ফুটবলারদের আয়টা বড়জোর ৩-৪ লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে নামমাত্র একটা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন ফুটবলাররা। যেখানে ‘এ’ ক্লাস ফুটবলাররা পান মোটে ১০ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লাসের ফুটবলাররা যথাক্রমে পান ৮ ও ৬ হাজার টাকা করে। (২০২২ সালের সবশেষ আপডেট হিসেব অনুযায়ী)
তবে আশার কথা হচ্ছে অন্য দেশের নারী ক্রিকেটারদের তুলনায় অপ্রতুল হলেও বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন নারী ফুটবলাররা। তবে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা সাফ চ্যাম্পিয়নদের বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে বাফুফে।
এফআই