ফিদে মাস্টার তৈয়বুর রহমান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে বড় দায়িত্ব কিংবা আগারগাঁও অফিস থেকে পল্টনস্থ দাবা ফেডারেশনের দূরত্ব- কোনটাই তাকে দাবা থেকে দূরে রাখতে পারে না। জাতীয় ও প্রিমিয়ার দাবা, বছরে অন্তত এই দুটো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন নিয়মিত। জাতীয় দাবায় শ্রেষ্ঠত্ব অধরা হলেও প্রিমিয়ার দাবায় শিরোপাজয়ী দলের সদস্য ছিলেন একাধিকবার।

তৈয়বুর রহমান পেশা ও দাবা দুটোই সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন গত দুই দশক। ২০তম বিসিএস ইকোনোমিক ক্যাডার কর্মকর্তা (২০১৫ সালে প্রশাসন ক্যাডারে অর্ন্তভুক্ত) এই দাবাড়ু। বিসিএস পরীক্ষায় তার একটাই পছন্দ দেওয়ার পেছনে কারণও ছিল দাবা, ‘ইকোনমিক ক্যাডারের পোস্টিং ঢাকাতেই হয় এতে দাবা খেলা যাবে। এজন্য পছন্দ তালিকায় শুধু এটিই দিয়েছিলাম।’ যোগদানের পর কাজের চাপে দাবায়  আর তেমন সময় দিতে পারেননি। জাতীয় ও প্রিমিয়ার দাবাই খেলছেন শুধু।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করে দাবার বোর্ডে বসতে অনেক সময় বিলম্বও হয় তার, ‘অফিসের কাজ খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করি। খেলার দিনে কাজগুলো দুপুরের মধ্যে শেষ করে খেলতে রওনা হই। জ্যাম ও কাজের চাপে অনেক সময় বোর্ডে বসতে দেরি হয়। ফলে প্রতিপক্ষের চেয়ে আমাকে কম সময় নিয়ে খেলতে হয় প্রায় ক্ষেত্রে।’

ছুটি না নিয়েই খেলেন তৈয়ব। দক্ষ অফিসার হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম। অফিসে শুধু অফিসারের পরিচয়ই রাখতে চান, এজন্য খেলার সময় ছুটি নেন না। পেশাগত জীবনে সফলতার পেছনে দাবাকেই অবদানই দিচ্ছেন,‘দাবার মাধ্যমে বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা বাড়ে। যা আমাকে পেশাগত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখে।’

দাবাড়ু হয়েও সুন্দর ক্যারিয়ার গড়া যায় এর অন্যতম উদাহরণ তৈয়ব। তাই অভিভাবক ও দাবাড়ুদের প্রতি তার বার্তা, ‘পড়াশোনা করেছি, দাবাও খেলেছি। সর্বোচ্চ লেভেলে (পিএইচডি) পড়াশোনা করেছি জার্মানি ও আমেরিকায়, দাবা তাতে ক্ষতির কারণ হয়নি। দাবার কারণে ক্যারিয়ার কখনো বাধাগ্রস্ত হয়নি, উল্টো সহায়তা হয়েছে। সন্তানদের আগ্রহ থাকলে অভিভাবকরা নির্ভয়ে দাবায় দিতে পারেন।’ 

তার সন্তানরা অবশ্য দাবায় আগ্রহী নয়। তৈয়বের বিয়ে দাবার সূত্রেই। সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের বোন তৈয়বের জীবনসঙ্গীনি। স্ত্রীর নাম সুলতানা আক্তার বাবু।

পেশাগত জীবনের মতো শিক্ষাজীবনেও দাবার জন্য সংগ্রাম করেছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় পড়াবস্থায় কয়েকবার সেমিস্টার ফাইনাল ও দাবা টুর্নামেন্ট একই সময়ে পড়েছে। সেই দিনগুলো কখনোই ভুলবেন না তৈয়ব, ‘এখন ভাবলে অবাকই লাগে সেই সময় কীভাবে করেছি। ঢাকায় দাবা খেলে রাতে বাসে খুলনা রওনা হতাম। সকালে রুমমেট নোট গুছিয়ে রাখত। সেগুলো পরে পরীক্ষা দিয়ে আবার পরের পরীক্ষার নোট নিয়ে দাবা খেলতে রওনা দিতাম।’

১৯৯৪ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও জাতীয় দাবায় অভিষেক একই সঙ্গে। সেই মজার ঘটনাটি বললেন, ‘ঢাকা মহানগরী বাছাইয়ে বাদ পড়ে যাই। কিছু দিন পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আবার বাছাই খেলি। সেই বাছাইয়ে টিকে জাতীয় দাবায় শীর্ষ পাঁচের মধ্যে ছিলাম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবার শুরু আমার মাধ্যমে। তাই বিভাগের ছাত্রের চেয়ে দাবাড়ু তৈয়ব নামেই পরিচিতি পাই।’ 

জাতীয় দাবায় নিজের অভিষেকে ভালো পারফরম্যান্সের পর তৈয়বের আরো এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো ক্রমেই পিছিয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘ঢাকায় থাকলে ফেডারেশনে গিয়ে অনুশীলন করতে পারতাম, খুলনায় সেটা হয়নি। ফলে সেরা সময়টা আমি দাবায় এগিয়ে যেতে পারিনি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েও পারিবারিক সিদ্ধান্তে খুলনাতেই পড়তে হয়েছে। 

খুলনায় অনার্স শেষ করে বুয়েটে মাস্টার্স পড়েছেন। ১৯৯৯ সালে বুয়েটে পড়াবস্থায় ইংল্যান্ডে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে যান। সেই টুর্নামেন্টে অনেক নাটকীয় ঘটনায় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান প্রথম জিএম নর্ম পান। সেই স্মৃতি রোমন্থন করলেন তৈয়ব, ‘খুবই অল্প অর্থ নিয়ে আমরা ইংল্যান্ডে দু’টি টুর্নামেন্ট খেলতে যাই। প্রথম টুর্নামেন্টের কয়েক রাউন্ডের পরেই টাকা শেষের দিকে। বাকি দিন থাকা সম্ভব নয় ফলে আমরা ফেরত আসার পরিকল্পনা করি। সেই সময় দাবা সেন্টারে ফলাফল এন্ট্রির মাধ্যমে পাউন্ড আয়ের এক নোটিশ দেখি। টুর্নামেন্ট পরিচালককে অনেক অনুরোধ করে আমরা কাজটি নিয়েছিলাম। কাজ পাওয়ার পরের দিনই জিয়া ড্র করে; আমরা তিন জন জিতেছিলাম। আমাদের জিতেও মন খারাপ, কারণ আমাদের সম্ভাবনা নেই কোনো একমাত্র জিয়ারই ছিল। পরের তিন রাউন্ড জিতে জিয়ার চ্যাম্পিয়ন ও জিএম নর্ম হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। শেষ ম্যাচে হিসাব দাঁড়ায় জিয়া জিতলে নর্ম। সকল খেলা শেষ শুধু জিয়ার বোর্ডে চলছে। আমরা সবাই এন্ট্রির কাজ ফেলে জিয়ার বোর্ডে। জিয়ার প্রতিপক্ষ আরবিটারকে ড্রর দাবি জানান। আরবিটার আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ফলাফল কি সম্ভব’ আমি বলি হ্যাঁ অবশ্যই। জিয়ার প্রতিপক্ষ এতে রেগে ভুল চাল দেয় এবং জিয়া জিতে জিএম নর্ম এবং তিন হাজার পাউন্ড পুরস্কার পায়। আমরা সবাই মহাখুশি নর্মও হলো এবং পরের টুর্নামেন্টে খেলার দুশ্চিন্তা নাই।’

খুলনায় অনার্স শেষ করে বুয়েটে মাস্টার্স পড়েছেন। ১৯৯৯ সালে বুয়েটে পড়াবস্থায় ইংল্যান্ডে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে যান। সেই টুর্নামেন্টে অনেক নাটকীয় ঘটনায় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান প্রথম জিএম নর্ম পান। সেই স্মৃতি রোমন্থন করলেন তৈয়ব, ‘খুবই অল্প অর্থ নিয়ে আমরা ইংল্যান্ডে দু’টি টুর্নামেন্ট খেলতে যাই। প্রথম টুর্নামেন্টের কয়েক রাউন্ডের পরেই টাকা শেষের দিকে। বাকি দিন থাকা সম্ভব নয় ফলে আমরা ফেরত আসার পরিকল্পনা করি। সেই সময় দাবা সেন্টারে ফলাফল এন্ট্রির মাধ্যমে পাউন্ড আয়ের এক নোটিশ দেখি। টুর্নামেন্ট পরিচালককে অনেক অনুরোধ করে আমরা কাজটি নিয়েছিলাম। কাজ পাওয়ার পরের দিনই জিয়া ড্র করে; আমরা তিন জন জিতেছিলাম। আমাদের জিতেও মন খারাপ, কারণ আমাদের সম্ভাবনা নেই কোনো একমাত্র জিয়ারই ছিল। পরের তিন রাউন্ড জিতে জিয়ার চ্যাম্পিয়ন ও জিএম নর্ম হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। শেষ ম্যাচে হিসাব দাঁড়ায় জিয়া জিতলে নর্ম। সকল খেলা শেষ শুধু জিয়ার বোর্ডে চলছে। আমরা সবাই এন্ট্রির কাজ ফেলে জিয়ার বোর্ডে। জিয়ার প্রতিপক্ষ আরবিটারকে ড্রর দাবি জানান। আরবিটার আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ফলাফল কি সম্ভব’ আমি বলি হ্যাঁ অবশ্যই। জিয়ার প্রতিপক্ষ এতে রেগে ভুল চাল দেয় এবং জিয়া জিতে জিএম নর্ম এবং তিন হাজার পাউন্ড পুরস্কার পায়। আমরা সবাই মহাখুশি নর্মও হলো এবং পরের টুর্নামেন্টে খেলার দুশ্চিন্তা নাই।’

দুই বছর পর জিয়ার তৃতীয় জিএম নর্মের ঘটনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তৈয়ব। জার্মানি থেকে খেলে ফ্রান্সে আরেকটি টুর্নামেন্টে জিয়া, রাকিব, তৈয়বরা। অল্প দামের হোটেলে উচ্চ শব্দ ও গান বাজনায় রাতে ঘুমানোর জো নেই। তাই রাত কাটাতেন রাস্তায় হেঁটে। ভোরের আগে ঘুমিয়ে উঠতেন দুপুরের আগে। যাতে সকাল ও দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাওয়া যায়। এই কষ্টের কথা টুর্নামেন্ট ডিরেক্টরকে বলার পর বাংলাদেশের চার দাবাড়ুকে দুই বাসায় দুই জন করে থাকার ব্যবস্থা করেন। ফরাসিদের বাসায় থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করে জিয়া তৃতীয় জিএম নর্ম পান। সেই ফ্রান্সেই তৈয়ব বিসিএস ভাইভার সংবাদ পান। দেশে আসার কিছু দিনের মধ্যে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন।

২০০১ সালে জিয়া যখন জিএম তখন তৈয়ব ফিদে মাস্টার। ফিদে মাস্টার হওয়ার কিছু দিন পর চাকরিতে যোগদান করায় দাবায় আবার ছন্দপতন। ফলে ফিদে মাস্টার থেকে আন্তর্জাতিক মাস্টার ও গ্রান্ডমাস্টার হওয়া হয়নি। এ নিয়ে অবশ্য আক্ষেপ নেই তার, ‘পটুয়াখালি স্কুল পর্যায়ে আমি কখনো হারিনি কারো কাছে। আমি সেরা এ রকম একটা ভুল আত্নবিশ্বাস ছিল নিজের মধ্যে। ১৯৯১ সালে নটরডেম কলেজে রিফাতের (গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত তখন ফিদে মাস্টার ছিলেন) সঙ্গে মাত্র কয়েক চালেই হেরে যাই। তখনই বুঝতে পারি দাবায় আমি দেরিতে এসেছি ও বেশি দূর যাওয়া খুব কঠিন।’ বিএফ শাহীন কলেজে এইচএসসির দুই বছর ঢাকায় থেকে দাবা ফেডারেশনে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলেছেন। 

দুই বছর পর জিয়ার তৃতীয় জিএম নর্মের ঘটনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তৈয়ব। জার্মানি থেকে খেলে ফ্রান্সে আরেকটি টুর্নামেন্টে জিয়া, রাকিব, তৈয়বরা। অল্প দামের হোটেলে উচ্চ শব্দ ও গান বাজনায় রাতে ঘুমানোর জো নেই। তাই রাত কাটাতেন রাস্তায় হেঁটে। ভোরের আগে ঘুমিয়ে উঠতেন দুপুরের আগে। যাতে সকাল ও দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাওয়া যায়। এই কষ্টের কথা টুর্নামেন্ট ডিরেক্টরকে বলার পর বাংলাদেশের চার দাবাড়ুকে দুই বাসায় দুই জন করে থাকার ব্যবস্থা করেন। ফরাসিদের বাসায় থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করে জিয়া তৃতীয় জিএম নর্ম পান। সেই ফ্রান্সেই তৈয়ব বিসিএস ভাইভার সংবাদ পান। দেশে আসার কিছু দিনের মধ্যে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন।

গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তারের হাত ধরেই দাবা অঙ্গনে তার পথচলা, ‘রিফাত ওইদিনই (কলেজে হারের দিন) আমাকে ফেডারেশনে নিয়ে যায়। প্রথম দিনই উপলব্ধি হয় শুধু মেধা থাকলে হবে না দাবার জ্ঞান দরকার।’ তৈয়ব গ্র্যান্ডমাস্টার না হলেও তার দাবার জ্ঞান অনেক বলে মনে করেন, ‘পাঁচ জিএম ছাড়া বাংলাদেশের অন্য যে কোনো দাবাড়ুর চেয়ে কম জ্ঞান নেই আমার। অপেশাদার দাবাড়ুর মধ্যে আমার স্থান দ্বিতীয়; প্রথম স্থান বন্ধু রিফাতের (আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত) বলে মনে করি।’ 

দুই বন্ধুই দাবাড়ুদের অধিকার ও দাবার উন্নয়নের জন্য এসোসিয়েশন অফ চেস প্লেয়ার্স বাংলাদেশ গড়েন। তৈয়ব ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আর গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত সভাপতি/ফাইল ছবি 

ফিদে মাস্টার ও যুগ্ম সচিব উভয় পরিচয়ই তার কাছে সমান, ‘যখন দাবা অঙ্গনে তখন পুরোপুরিই দাবাড়ু। আমলার পরিচয় দেই না। আবার যখন পেশাগত অঙ্গনে তখন একজন সরকারি অফিসার। আমার ব্যাচমেটদের মধ্যে কেউ কেউ জানেন দাবি খেলি।’

পেশায় পদোন্নতি অব্যাহত থাকলেও, দাবায় ফিদে মাস্টারে স্থবির হয়ে আছেন দুই দশক। আন্তর্জাতিক মাস্টারের এক নর্ম রয়েছে। বাকি দুই নর্ম পূরণের মৃদু স্বপ্ন বুনছেন, ‘এক বছর ভালো মতো খেললে আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়া সম্ভব আমার পক্ষে। কয়েকটি টুর্নামেন্ট খেললেই সম্ভব কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততায় সময় বের করাই কষ্ট। এরপরও দেশের বাইরে গিয়ে খেলার চেষ্টা করব।’ এক যুগ পর অবসর জীবনে কোনো লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া মনের সুখে দাবা খেলবেন আজীবন।

তৈয়বের দুই দশকের পেশাগত জীবনের অনেক সময় কাটছে পরিকল্পনা কমিশনেই। একজন ক্রীড়াবিদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বড় দায়িত্বে থাকলেও কোনো ফেডারেশনই তার কাছে কখনো পরামর্শ চায়নি, ‘আমি খেলার উন্নয়নে যে কোনো প্রকল্প পরিকল্পনায় সহায়তায় প্রস্তুত। এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’

দাবা ফেডারেশনকে বেশ কয়েক বছর আগে একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। সেটিও আলোর মুখ দেখেনি।

এজেড/এটি/এনইউ