দাবায় জীবন, দাবায় সংসার
ভেতরে দাবাড়ুরা লড়ছেন। বাইরে একজন মধ্যবয়সী নারী ছেলেকে হাত ধরে পায়চারি করছেন। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে স্বামীর বোর্ডের অবস্থা পরখ করে নেন। স্বামীও নিজের চাল দিয়ে প্রতিপক্ষের টাইম আউটের সময় সামান্য দূর থেকে চোখাচোখি করেন। দাবা অঙ্গনে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের খেলার সময় গত এক যুগের বেশি সময় এটি সাধারণ চিত্র। জিয়ার প্রায় সকল গেমেই তার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য উপস্থিত থাকেন। সঙ্গে থাকেন ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়াও।
অনেক ক্রীড়াবিদ ক্যারিয়ার সহায়ক হওয়ার জন্য ক্রীড়াঙ্গনেই জীবনের জুটি গড়েন। আবার অনেকে স্বামী কিংবা স্ত্রীকে ক্রীড়াঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন একেবারে। উভয় দিক থেকে জিয়া ও তাসমিন জুটি একেবারেই ভিন্ন। তাসমিন ক্রীড়াবিদ নন, কিন্তু স্বামী জিয়ার জন্য প্রতি খেলাতেই উপস্থিত থাকেন। এ জন্য ক্রীড়াঙ্গনে তাদের অতি পতী-পত্নী ভক্তির ঠাট্টাও শুনতে হয় মাঝে মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
দাবাই তো আমার পরিবার। দাবা ফেডারেশন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আমাদের সেকেন্ড হোম। দেশে ও দেশের বাইরে দাবার পরিবেশটা আমি দারুণ উপভোগ করি। দেশি-বিদেশি অনেক দাবাড়ুদের সাথে আমার দারুণ বন্ধুত্ব। সাগর, শাকিল সহ আরো অনেকে ছোট ভাই-বোনও পেয়েছি আমি দাবার মাধ্যমে।
প্রথম প্রথম একটু অন্য রকম লাগলেও এখন একেবারেই সহজাত হয়ে গেছে তাসমিনের কাছে
তাসমিন-তাজওয়ার কাছে থাকলে জিয়া খেলায় বাড়তি উৎসাহ পান। এজন্য স্ত্রী-সন্তানকে খেলার সময় কাছেই রাখার চেষ্টা করেন জিয়া, ‘পরিবারই আমার অনুপ্রেরণা এজন্য ওদের সব সময় কাছে রাখি। শুধু দেশে নয়, বিদেশের সফরগুলোতেও ওদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।’
জিয়ার দাবার গতিতে যেন ভাটা না পড়ে এজন্য তাসমিন বিসিএস ক্যাডারে যোগদানই করেননি।
২২ তম বিসিএসে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৪ তম ও নারীদের মধ্যে ২য় হয়েছিলেন জিয়া পত্নী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সাবেক এই ছাত্রী যোগ না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘আমার প্রথম পোস্টিংইটি ছিল ঢাকার বাইরে। আমি বাইরে গেলে জিয়ার খেলায় ব্যাঘাত ঘটবে। জিয়া তখন (২০০২ সালে) মাত্র গ্র্যান্ডমাস্টার হলো। দাবা ও জিয়ার কথা ভেবে আর বিসিএসে যোগ দেইনি।’
প্রথম পোস্টিং ঢাকায় হলে তাসমিনের ক্যারিয়ারও ভিন্ন হতে পারতো। ২২তম বিসিএসের অনেকেই এখন যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ নেই তার, ‘পেশাগত জীবনে গেলে হয়তো আমিও ওই জায়গায় পৌছাতাম এতদিনে। অর্থ, ক্ষমতা আরও অনেক কিছুই হয়তো থাকতো কিন্তু এখন পরিবার নিয়ে বেশ তৃপ্ত আছি, সেটা নাও হতে পারতো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন জিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার দিনগুলো স্মরণ করলেন জিয়া, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পড়াবস্থায় ছিলাম আন্তর্জাতিক মাস্টার। বেশ কয়েকবার জিএম নর্ম মিস করেছি। আমাদের নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনার ভালোই চাপ ছিল। ফলে সেই সময় সেভাবে আর উন্নতি করতে পারিনি।’
মাস্টার্স পাশের পর একটু হাফ ছেড়ে বাঁচেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার, ‘মাস্টার্সের পর আমি স্বাধীন অনুভব করছিলাম। পড়াশোনার আর চাপ নেই। লক্ষ্য ঠিক করি তিন বছরের মধ্যে (১৯৯৯-০২) জিএম হব। আড়াই বছরের মধ্যেই সফল হই।’
২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর জীবনের লক্ষ্যপথ শুধুই দাবা বেছে নেন, ‘দেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার হলাম। সবার সম্মান-ভালোবাসা পাচ্ছি। দেশে-বিদেশে টুর্নামেন্ট খেলছি হরদম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দাবাতেই থাকব। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগইে পড়েছেন আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার। তিনি অবশ্য গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাতেই নিজের পরবর্তী ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছেন। মাঝে কম্বোডিয়ার কান্ট্রি ডিরেক্টরের মতো পদেও ছিলেন।
নৃবিজ্ঞানী জিয়াও কাজ করতে পারতেন গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে। কিন্তু তিনি শুধু দাবা নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন, ‘মাস্টার্সের পর সবার চাপ থাকে পেশাজীবনে প্রবেশের। আমার পরিবার চাপ দেয়নি। এর ফলেই কিন্তু আমি মাত্র আড়াই বছরে জিএম হতে পারি। জিএম হওয়ার পর তাসমিন (স্ত্রী) দাবা এবং আমার জন্য বিসিএসে যোগ দেয়নি। পরে এত মনোযোগী হয়ে পড়ি যে অন্য কিছু করা আর সম্ভবপর ছিল না।’
২০০২-০৯ পর্যন্ত দাবার স্বর্নযুগই বলা যায়। চার জন গ্র্যান্ডমাস্টার (জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আব্দুল্লাহ আল রাকিব, এনামুল হোসেন রাজীব) এসেছে এই সময়কালে (নিয়াজ মোর্শেদ উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন ১৯৮৯ সালে)। এরপরের এক যুগ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্নই। টুর্নামেন্টের সংখ্যা কম, (বিমান ক্রীড়া থেকে সরে দাড়ানোয় দাবাড়ুদের বাইরে খেলা হ্রাস পেয়েছে অনেক), সংগঠকদের অদক্ষতা-অর্ন্তকোন্দল, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, সহ নানা কারণে গত এক যুগে দাবার মান উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। এতে স্পষ্টত প্রভাব পড়েছে গ্র্যান্ডমাস্টারদের উপর।
দাবা এমন একটি ডিসিপ্লিন যেখানে অনুশীলন ও খেলার বিকল্প নেই। নানা সীমাবদ্ধতায় আমরা রেটিং বাড়াতে পারিনি। সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার সম্ভাবনা সীমিত হয়েছে। তবে পরবর্তী প্রজন্ম থেকেই সুপার জিএম আশা করি।
আক্ষেপ ও সান্ত্বনা খুঁজছেন জিয়া।
জিয়ার রেটিং ২৫০০-র আশেপাশে। তার ছেলে তাহসিনের এখনই ১৮০০+। ২০১৬ সালে জাতীয় দাবায় উত্তীর্ণ হন তাহসিন। আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রাণী হামিদকেও হারিয়েছেন জিয়ার পুত্র। প্রতিযোগিতামূলক খেলায় তার বাবার সাথে ড্র করার রেকর্ডও রয়েছে। কমনওয়েলথ দাবায় পিতা-পুত্র সফরসঙ্গীও হয়েছে। জাতীয় ও বিদেশি অনেক জিএমের সঙ্গেই মুখোমুখি হয়েছেন তাহসিন।
জিয়ার স্ত্রী তাই এখন ছেলেকে নিয়েই বেশি স্বপ্ন দেখেন, ‘তাহসিন মনোযোগ দিয়ে খেললে অবশ্যই ২৭০০ প্লাস রেটিং করে সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারবে।’ খেলার পাশাপাশি কোচিং পেশায় নিযুক্ত জিয়ার ছেলে সম্পর্কে মূল্যায়ন, ‘ধীরে ধীরে সে উন্নতি করছে। দাবায় থাকলে ও অনেক ভালো কিছুই করতে পারবে।’
তাহসিনেরও লক্ষ্য বাবা-মায়ের আশাপূরণ, ‘দাবা পরিবারেই আমার জন্ম। আমার দাবা খেলার হাতেখড়ি দাদার মাধ্যমে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক দাবায় প্রথম অংশগ্রহণ করি। এরপর কিছু দিন খেলিনি। ২০১৬ সাল থেকে পুনরায় দাবায় সক্রিয় হই। আমার লক্ষ্য সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। সেই লক্ষ্যে আমি অনুশীলন করে যাচ্ছি।’
জিয়ার বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমেদও দাবাড়ু ছিলেন। ১৯৮৪ সালে জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। একই পরিবারে তিন প্রজন্মের (দাদা-বাবা-ছেলে ) জাতীয় দাবায় অংশগ্রহণের রেকর্ড বাংলাদেশে অন্য কারো নেই। জিয়ার স্ত্রী লাবণ্যও ২০১০ সালে জাতীয় মহিলা দাবার বাছাইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
এজেড/এটি