১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সোয়া চার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সার্বিক অবস্থান নিয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে খোঁজার চেষ্টা করেছেন ৫০ বছরে নারী কোচ, রেফারি, আম্পায়ারের বিষয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভূমিকা।

অনেক নারী ক্রীড়াবিদের কোচের কাছে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। বেশির ভাগ নারী দলে কাজ করেন পুরুষ কোচ। নারী দলে নারী কোচ থাকলে সেই শঙ্কা আর থাকে না বলে মনে করেন জাতীয় হ্যান্ডবল দলের সাবেক অধিনায়ক ডালিয়া আক্তার, ‘অনেক সময় কোচদের হাতেও নারীরা নিরাপদ নয়। এই জায়গাটা যদি নারী কোচ থাকে তাহলে এই শঙ্কার জায়গা তৈরি হয় না। জাতীয় পর্যায়ে অনেক খেলায় নারীরা কোচিংয়ে সেই পর্যায়ে যেতে পারেননি। তবে বিশেষ করে অনূর্ধ্ব পর্যায়ের প্রশিক্ষণে নারী কোচদের কাজের সুযোগ দেওয়া দরকার।’  

বাংলাদেশে পর্যাপ্ত নারী কোচ নেই। ফলে নারী দলের দায়িত্বে থাকতে হয় পুরুষ কোচকে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রায় সকল খেলায় নারী ক্রীড়াবিদদের কম-বেশি অংশগ্রহণ থাকলেও এখনো অনেক খেলায় নারী কোচ শূন্য। টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টনের মতো খেলায় নারীদের অনেক কৃতিত্ব থাকলেও এই দুই খেলায় নেই কোনো নারী কোচ। 

বিশেষ করে ব্যাডমিন্টনে নারী কোচ না থাকায় নারী ক্রীড়াবিদদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগটা বেশি উঠে বলে ধারণা ক্রীড়াঙ্গনের। নারী কোচের শূন্যতায় উঠে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও। দুই সাবেক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় এখন কোচ। তাদের দুই জনের স্ত্রী আবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। ফলে একে অন্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান প্রায়ই। 

অনেক ফেডারেশন টুর্নামেন্ট আয়োজন করতেই গলদঘর্ম। তাদের পক্ষে নারীদের নিয়ে বিশেষভাবে কোচিং কোর্স আয়োজন করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেকেই আন্তরিকতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি দেখছেন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার। ক্রীড়াঙ্গনে নারী কোচ তৈরিতে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কে সাবেক জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা কামরুন নাহার ডানা বলেন, ‘বিকেএসপি, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ছাড়া নারীদের কোচিংয়ের সুযোগ ও নিশ্চয়তা সেভাবে নেই। ফলে নারীরা কোচিংয়ে তেমন আগ্রহী হয় না।’

‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অনেক সময় অনেক কোচিং কোর্স করিয়েছে। এমনকি বাফুফের আগে মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় নারীদের কোচিং কোর্স হয়েছে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্র সেভাবে না থাকায় আমাদের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয় না।’ 

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কোচদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারকা সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা, ‘এখন প্রায় প্রতি খেলায় জুনিয়র পর্যায়ে নারী দল রয়েছে। সেই নারী দলগুলোতে নারী কোচদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা একটা অনুরোধ রাখতে পারে। পাশাপাশি বিভিন্ন খেলায় কোচ নিয়োগের সময় যেন নারীদের অন্তত একটা পদ থাকে এ রকম দাবি মহিলা ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে আসা দরকার।’ 

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে নারী কোচের সংখ্যা ১২, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ১ জন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে ৩ জন, এছাড়া সার্ভিসেস বাহিনী ও এর বাইরে হাতে গোণা কোচ রয়েছেন। সকল খেলা মিলিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে সক্রিয় কোচের সংখ্যাটা ৩০-৩৫ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। ৭২ বছর বয়সে এখনো কোচিং করাচ্ছেন সুফিয়া খাতুন। 

তিনি নারী কোচের সংখ্যা কম হওয়ার পেছনে কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘নারীদের জীবন সংগ্রামের অনেকে খেলার পর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে ক্রীড়াঙ্গন ছেড়ে দেয়। কোচিং খেলার চেয়ে কম কষ্টকর নয়। এরপর সুযোগ সীমিত ও নানা বিষয় বিবেচনা করে নারী কোচের সংখ্যা কম। তবে এই সংকট-সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করা দরকার ছিল মহিলা ক্রীড়া সংস্থার।’

পুরুষ দলের প্রথম পেশাদার নারী কোচ মিরোনা।

 

মহিলা ক্রীড়া সংস্থা সব সময় কোচিং কোর্স নিয়ে তেমন কাজ করতে পারে না। সংস্থাটির সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা মাহফুজা আক্তার কিরণ তার মেয়াদে কোচিং নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি বলে মন্তব্য করেন, ‘আমার সময়টি ছিল অত্যন্ত অস্থিরতাপূর্ণ। সেই সময়ে খেলা আয়োজন ও প্রশিক্ষণেই সময় দিয়েছি। কোচিং কোর্স তেমন করতে পারেনি।’ 

তিনি মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ছাড়ার পর বাফুফের মহিলা উইং দেখছেন গত এক দশকের বেশি সময়। এখানে আসার পর মহিলাদের অনেক কোচিং কোর্স করিয়েছেন। কোচিং কোর্স করালেও সেই সার্টিফিকেট কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। জাতীয় দলে কোচিং করাচ্ছেন অনন্যা। সাবেক ফুটবলার সুইনিং রয়েছেন কোচিং বিভাগে। 

আর নারী ফুটবল লিগে কোচিং করান বিদেশিরা। নারী কোচদের উঠে আসার জন্য নারী কোচ বাধ্যতামূলক করা যায় কি না লিগে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের নারী কোচদের আরো মান্নোয়ন করতে হবে। পাশাপাশি ক্লাবগুলোকেও নারীদের কোচ করার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।’  

জাতীয় পর্যায়ে যখন এই অবস্থা জেলা পর্যায়ের চিত্র সহজেই অনুমেয়। প্রায় সব জেলা দল যখন ঢাকায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার খেলা খেলতে আসে তখন পুরুষ কোচ নিয়েই আসে। ম্যানেজারের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করলেও কোচের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা দিতে পারছে না। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার বিভিন্ন খেলায় বিচারক হিসেবে থাকেন পুরুষরা। 

কোচের মতো খেলার বিচারকেও রয়েছে নারীর ঘাটতি। এই প্রসঙ্গে বর্তমান কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা ফিরোজা করিম নেলী বলেন, ‘আমরা রেফারিং, জাজেস কোর্সও করাই মাঝেমধ্যে। সেই কোর্স করালেও কাজের সময় পাওয়া যায় না। যারা রেফারিং করেন তারা অধিকাংশই বিভিন্ন স্কুল বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ফলে আমাদের খেলার সময় ফেডারেশনে চিঠি দিতে হয়। ফেডারেশনেও বিচারক সংকট থাকে। তারাও বাধ্য হয়ে পুরুষ বিচারকই পাঠায়।’

গত কয়েক বছর ধরে ফুটবলের চিত্রটা একটু ভিন্ন। ফুটবলে প্রথম শ্রেণীর নারী রেফারির সংখ্যা ত্রিশের কাছাকাছি। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নারী ফুটবল প্রতিযোগিতায় এখন থেকে নারীরাই রেফারিং করছেন। তবে দেশের আরেক জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটে অবশ্য করুণ অবস্থা। ক্রিকেটে নারী আম্পায়ার সংকট প্রকট। সর্বসাকুল্যে চার জন নারী আম্পায়ার রয়েছেন। তারা আবার কোচও। 

এই চার নারী আম্পায়ার নারীদের প্রথম বিভাগ লিগে আম্পায়ারিং করলেও প্রিমিয়ারে সুযোগ পান না। সাবেক নারী ক্রিকেটার ও আম্পায়ার মাকসুদা লিসা এ নিয়ে বলেন, ‘বিসিবি এই ব্যাপারে তেমন নজর দেয় না। মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় উদ্যোগ নিতে পারে অথবা বিসিবিকে তাগিদ দিতে পারে। সেটাও করে না ফলে আম্পায়ারিংয়ের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে অনেক।’ 

ফুটবল, ক্রিকেটসহ কিছু খেলায় অনেক নারী কোচ আবার খেলার বিচারকও। কিছু খেলায় একদম নেই। সেই সমস্ত খেলায় বিশেষভাবে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নজর দেওয়ার অনুরোধ জাতীয় খেলা কাবাডির নারী কোচ শাহনাজ মালেকার, ‘কয়েকটি ফেডারেশনের (ফুটবল, ক্রিকেট, শুটিং, আরচ্যারি) নিজেদেরই কোচ তৈরি করার সকল সামর্থ্য রয়েছে। এই সকল ফেডারেশনকে ধারাবাহিকভাবে কোচ তৈরি করার তাগিদ দিতে পারে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। অনেক খেলায় নারী কোচ নেই, সেই খেলাগুলোর তালিকা করে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কোচ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার গঠনতন্ত্রের ৬ ধারায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্ক বলা হয়েছে। যেখানে দ্বিতীয় লক্ষ্য হিসেবে আছে অধিক সংখ্যক রেফারি, আম্পায়ার, কোচ, সংগঠক তৈরি করা। অথচ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছরে সক্রিয় কোচের সংখ্যা পঞ্চাশেরও কম। 

শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকটি খেলায় সক্রিয় নারী কোচের সংখ্যা:

ফুটবল : ৭ (অনন্যা, জয়া চাকমা, আছিয়া খাতুন বিথী , লীনা চাকমা,সুইনু মারমা, মিরোনা, তৃষ্ণা চাকমা) 
ক্রিকেট : ৪ (সাথিরা জাকির জেসী, ডলি রানী সরকার, ফাতেমা-তুজ-জোহরা,রেশমা আক্তার )
হকি : ১ (রিতু খানম কোচ কাম খেলোয়াড় )
হ্যান্ডবল :১ (ডালিয়া আক্তার )
অ্যাথলেটিক্স : ৬ (সুফিয়া খাতুন, রাজিয়া সুলতানা অনু,মাহবুব আরা বেলি, খুরশিদা খুশি, ফৌজিয়া হুদা জুই ও কানিজ সুলতানা)।
সাতার : ৩ (লায়লা নূর, অ্যানি, তানিয়া আফ্রিন)
কাবাডি : ১ (শাহনাজ মালেকা )। 
ভারত্তোলন : ১ (শাহরিয়া সুলতানা)  
টিটি : নেই
ব্যাডমিন্টন : নেই
বাস্কেটবল : নেই
দাবা : নেই 

এজেড/এমএইচ/এটি