১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সোয়া চার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সার্বিক অবস্থান নিয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন ক্রীড়াঙ্গনে নিপীড়নবিরোধী সেল থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।

২০১৮ সালের নভেম্বর। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে নারী ভারত্তোলকের যৌন হয়রানির অভিযোগের ঘটনায় ক্রীড়াঙ্গনে তোলপাড়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চলছিল ধিক্কার-সমালোচনা। সাবেক ক্রীড়াবিদ ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা কামরুন নাহার ডানার নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও হয়। সমগ্র দেশে এ ঘটনা যখন আলোচনায় তখন সামান্য প্রতিবাদ বা মানববন্ধনও করেনি বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। যা রীতিমতো বিস্ময়কর! যে সংস্থা এই নিপীড়নের বিপক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করার কথা সেখানে উল্টো তাদের নীরবতা দেখতে হলো সবাইকে। 

কামরুন নাহার ডানা গত চার দশকে নারী ক্রীড়াবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের নানা বিষয় নিয়ে সব সময় সচেষ্ট ডানা। তিনিই সর্বোচ্চ তিন বার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার। ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের নির্যাতন অনেকটা, ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু নারীদের জন্য নেই নির্যাতন বা নিপীড়ন নিয়ে কোনো অভিযোগ জানানোর প্লাটফর্ম। 

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নিপীড়ন বিরোধী কোনো সেল বা কমিটি নেই কেন- এই প্রশ্নে ডানার উত্তর, ‘একটি নারী নির্যাতন বিরোধী বা নিপীড়ন দমন সেল অথবা কমিটি মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় থাকতেই পারে। এই বিষয়টি আলোচিত হয় সাধারণত ঘটনা ঘটলে। আমার মেয়াদকালে সেই রকম কোনো ঘটনা হয়নি। ফলে কমিটি বা সেলও গঠন হয়নি।’

ডানার মতো সাবেক সভানেত্রী রাফিয়া আক্তার ডলি, সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা ফেরদৌস আরা ডলি ও মাহফুজা আক্তার কিরণও মনে করেন নিপীড়ন বিরোধী একটি সেল মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় থাকা প্রয়োজন। 

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারী নির্যাতনের ঘটনা নীরবে-নিভৃতে ঘটে। কয়েক বছর পরপর দু’একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। গত বিশ বছরের মধ্যেই কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। ক্রীড়াঙ্গন নিপীড়নমুক্ত হোক চান দুই বার সাফে স্বর্ণ জেতা ভারোত্তলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, ‘আমরা নিপীড়নমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন চাই। অবশ্যই ক্রীড়াঙ্গনে নিপীড়ন বিরোধী একটি সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। মাঝে মধ্যে ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সাধারণ শাস্তি বহিষ্কার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটি সুনির্দিষ্ট সেল ও আইন থাকলে অনেকে অনৈতিক কাজ করার সাহস দেখাবে না। এই বিষয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।’

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা প্রকৌশলী ফিরোজা করিম নেলীর নিপীড়ন সেল নিয়ে ভাবনাটা একটু ভিন্ন, ‘মাঝেমধ্যে যে অভিযোগ বা ঘটনা শোনা যায় সেগুলো কোনো না কোনো ফেডারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট। সেই অভিযোগ খন্ডানো এবং তদন্ত করার দায়িত্বটা স্ব স্ব ফেডারেশনেরই।’ 

যে ফেডারেশনে এই অভিযোগ ওঠে সেই ফেডারেশনের প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছায়ায় এমন ঘটনা ঘটে বলে ধারণা ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের। ফলে সেখানে ভুক্তভোগী নারীর সঠিক বিচার পাওয়ার আশা করা অনেকটা আকাশ-কুসুম কল্পনা।

ক্রীড়াঙ্গনে নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা সাঁতারে। নির্যাতনের শিকার হয়ে এক নারী সাঁতারু অল্প বয়সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। সাঁতার ফেডারেশন তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন সাবেক সাঁতারু লায়লা নূর। 

তার দৃষ্টিতে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিপীড়ন বিরোধী সেলে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার তেমন ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই, ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থা একটি নিপীড়ন বিরোধী সেল করতে পারে। সেই সেলের সুপারিশ, পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকবে না। ফেডারেশনের কোনো ঘটনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার নেই মহিলা ক্রীড়া সংস্থার। কারণ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ফেডারেশনের একটি অধিভুক্ত সংস্থা। ফলে আইনত ও গঠনতান্ত্রিকভাবে ফেডারেশনের বিষয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারে না।’

ক্রীড়াবিদ,সংগঠকের ব্যানারে নিপীড়নের প্রতিবাদ হলেও মহিলা ক্রীড়া সংস্থা নিশ্চুপ ভূমিকায়।

আইনত বা গঠনতান্ত্রিকভাবে নিষ্পত্তি করতে না পারলেও প্রতিবাদ, মানবন্ধন করে চাপ সৃষ্টি করা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেটাও কখনো হয়নি মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্বে। এই বিষয়টি চরমভাবে হতাশ করে কিংবদন্তিতুল্য শুটার সাবরিনা সুলতানাকে, ‘নারী ক্রীড়াবিদ নিপীড়ন, নির্যাতনে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কখনো প্রতিবাদ থাকে না, এর চেয়ে কষ্টের ও লজ্জার কিছু হতে পারে না।’

সাবেক তারকা সাঁতারু নিবেদিতা দাস মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। নারী নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা এই অধিদপ্তর দেখভাল করে। তার সেই দায়িত্ব থেকে উপলব্ধি, ‘একজন নারী ক্রীড়াবিদ ভুক্তভোগী হলে সে মহিলা অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারে। অনেক সময় অভিযোগ করার মতো মানসিক-শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য এমনকি ইচ্ছেও থাকে না। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকলে তখন নারী ক্রীড়াবিদটি সেই সেলকে জানালে তারা পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সহায়তার সুযোগ করে দিতে পারে।’

সাবেক টেবিল টেনিস তারকা জোবেরা রহমান লিনু নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠনের বিষয়টি দেখছেন এভাবে- ‘ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই এ রকম একটি সেল দরকার। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ,বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনও এটা করতে পারে। তবে প্রাথমিক উদ্যোগটা মহিলা ক্রীড়া সংস্থারই নেয়া দরকার। অলিম্পিক, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেল করলেও সেখানে মহিলা ক্রীড়া সংস্থারই প্রতিনিধিত্ব থাকবে।’

তারকা সাঁতারু ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের অ্যাথলেট কমিশনের সদস্য মাহফুজা খাতুন শিলা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন হয়রানি শুধু শারীরিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাইবার বুলিংয়ের বিষয়টিও বিবেচনাযোগ্য। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অন্য দেশের ক্রীড়া আইনে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি পর্যালোচনা করে একটি সুন্দর সুপারিশমালা অলিম্পিক বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে দিতে পারে।’

ক্রীড়াঙ্গনে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, রয়েছে মানসিক নিপীড়নও। নারী ক্রীড়াবিদদের পোশাক, চাল-চলন, বিয়ে, পরিবার নিয়ে কটু মন্তব্য করেন ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেকেই। নারীদের ক্ষেত্রে মাঠে ভালো পারফরম্যান্স করার পরও অনেক সময় শুনতে হয় বাজে মন্তব্য। এই মানসিক পীড়নের ফলে অনেক সময় নারী ক্রীড়াবিদরা অনুশীলন ও খেলায় স্বাভাবিক পারফরম্যান্স করতে পারেন না। এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জেন্ডার শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি। 

নিপীড়ন বিরোধী সেল অনুপস্থিতির মতো এই সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কার্যকরী ভুমিকা নেই মহিলা ক্রীড়া সংস্থার, ‘ক্রীড়া জেন্ডার নিয়ে আমার আন্তর্জাতিক কোর্স করা রয়েছে। কিন্তু এটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবার মধ্যে জানানোর সুযোগ নেই। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা কোনো সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করলে তখন একটা বলার ক্ষেত্র হতো’- বলেন সাবেক অ্যাথলেট ও বর্তমান কোচ ফৌজিয়া হুদা জুঁই। 

জেলা পর্যায়ে মানসিক নিপীড়নের সংখ্যা বহুগুণ। তিন দশক ধরে সিলেট জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে কাজ করা মারিয়াম চৌধুরী বলেন, ‘মেয়েরা খেলতে আসলে বাজে কথা শুনত। এতে অনেক মেয়ে খেলা থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে অভিভাবকদের বোঝাই। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে যদি জেলায় জেলায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সচেতনতা ও মানসিক নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকত তখন এটা আরো কার্যকরী হতো।’ 

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকার সামগ্রিক বিষয়ে মন্তব্য, ‘ভুক্তভোগী খেলোয়াড় অভিযোগ না করলে অথবা অন্তত অবহিত না করলে তো আমাদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তারপরও এ রকম সেল ক্রীড়াঙ্গনে থাকা প্রয়োজন। এই বিষয়ে আমরা সামনের নির্বাহী কমিটির সভায় আলোচনা করব।’

গত দুই দশকে আলোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনা ও অভিযোগ 

১। কোচের উপর তরুণী অ্যাথলেটের অভিযোগ 
২। ব্যাডমিন্টনে নারী ক্রীড়াবিদের অভিযোগ 
৩। সাঁতারে এক নারীর আত্মহত্যা 
৪। সাঁতারে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বহিষ্কার 
৫৷ টেনিসে সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক লাঞ্ছনার ঘটনা 
৬। ভারত্তোলনে নিপীড়নের অভিযোগ (তদন্তে সত্যতা মেলেনি) ।

এজেড/এটি