মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছর
খেলা আছে, নেই খেলোয়াড়!
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সোয়া চার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সার্বিক অবস্থান নিয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে খোঁজার চেষ্টা করেছেন ৫০ বছরে নারী ক্রীড়াবিদ তৈরি এবং উন্নয়নে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভূমিকা।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাংলাদেশের নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে বিচরণ। স্বাধীনতার আগে নারী ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল এ বিষয়ে কথা হয় ১৯৬৬ সালের দ্রুততম মানবী রওশন আখতার ছবির সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা পাকিস্তান পিরিয়ডে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলতাম। আমি খেলেছি আজাদ স্পোর্টিংয়ে, ক্যাথরিন ক্রুজ ওয়ান্ডারার্সে, খুকী (সুলতানা কামাল) মোহামেডানে। তখন নারী খেলাধুলা ছিল মূলত ক্লাব নির্ভর।’
বিজ্ঞাপন
স্বাধীনতার পর নারী ক্রীড়াবিদরা নিজেদের জন্য আলাদা অনুশীলন, আবাসিক ক্যাম্পের অধিকার নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রথম সচিব কাজী আনিসুর রহমান মহিলা ক্রীড়া সংস্থার জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে বলেন, ‘৭২ সালে অনেক ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময় মহিলারা স্বতন্ত্র সংস্থা করার দাবি জানায়। বকুল, জিনাত এরাই ছিল মূলত উদ্যোক্তা ছিল। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেটা অত্যন্ত যৌক্তিক ছিল। ধানমন্ডি এলাকায় নারীদের জন্য আলাদা একটি ক্রীড়া সংস্থার সৃষ্টি হয়।’
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে সাজেদা চৌধুরী সভানেত্রী ও লুৎফুন্নেছা হক বকুলকে সাধারণ সম্পাদিকা করে বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা নামকরণ হয়) যাত্রা শুরু হয়। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল নারীদের খেলাধুলার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহিলা ক্রীড়াবিদদের মানোন্নয়ন। যেন তারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জন্য তৈরি হতে পারেন (গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধারা অনুযায়ী)।
এই ৫০ বছরে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা বিভিন্ন খেলা নানা পর্যায়ে আয়োজন করেছে। এই পাঁচ দশকে খেলা আয়োজনের সংখ্যায় হাজার, প্রতিযোগীর সংখ্যা লাখ স্পর্শ করলেও মানোন্নয়ন করে জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন এমন নারী ক্রীড়াবিদের সংখ্যা সব খেলা মিলিয়ে হাজারের অঙ্ক ছোঁয়াই কষ্টসাধ্য। আনুমানিক এই হিসেবে যেটা প্রতিযোগি সংখ্যার অনুপাতের এক শতাংশেরও নিচে!
মহিলা ক্রীড়া সংস্থার খেলায় অংশ নেওয়া নারীদের বাছাই ও মান্নোয়ন করে ফেডারেশনের কাছে সরবরাহ হলে জাতীয় খেলোয়াড় তৈরিতে থাকত বড় ভূমিকা। নানা সীমাবদ্ধতা ও সংকটে সেটা না হওয়ায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা জাতীয়ভাবে ৫০ বছরে তেমন অবদান রাখতে পারছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে পাঁচ দশকের উত্থান-পতন ও নানা ঘটনার সাক্ষী ক্রীড়া সাংবাদিকতার প্রথিকৃৎ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান।
কোথায় তাদের ব্যর্থতা জানিয়ে গুণী ক্রীড়া সাংবাদিক বলছিলেন, ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি। জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় সরবরাহে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখার তুলনায় জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টের সময় আবাসিক স্থল হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য এই সংস্থা এককভাবে দায়ী নয়, এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সংকট রয়েছে নেতৃত্ব সংকটসহ নানা বিষয়।’
কামরুজ্জামানের মন্তব্যের সঙ্গে অনেকটা একমত এই সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা সুলতানা ফেরদৌস আরা ডলি, ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ৫০ বছরে নারী ক্রীড়াঙ্গনকে যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ছিল সেটা পুরোপুরি পূরণ না হলেও কিছু অংশে হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অধিক সংখ্যক নারীদের খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে।’
মহিলা ক্রীড়া সংস্থার পথচলার ২৬ বছর পর (১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও নারী বিভাগ শুরু হয় ৯৭ থেকে) বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী বিভাগ শুরু হয়। অ্যাথলেটিকস, জিমনাস্টিক, সাঁতার ও টেনিস দিয়ে প্রথম বছরে ২৭ জন নারী ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর প্রতি বছর নারী খেলোয়াড় ও বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে। গত দুই দশকে দেশের অনেক খেলার নারী বিভাগ এখন বিকেএসপি নির্ভর।
এরপরও বিকেএসপির প্রথম নারী ব্যাচের কৃতি অ্যাথলেট ও বর্তমান কোচ ফৌজিয়া হুদা জুই মহিলা ক্রীড়া সংস্থার এখনো অনেক কাজের জায়গা রয়েছে বলে মনে করেন, ‘সব মেয়েরা বিকেএসপিতে ভর্তি হতে পারে না। আবার বিকেএসপিতে পড়াশোনার পর সার্ভিসেস বাহিনীতে প্রবেশ করতে পারে না। এই দুই ধরনের মেয়েদের জেলায় বা নিজ এলাকায় গিয়ে খেলাধুলার সঙ্গে থাকা কষ্টকর কারণ আবাসন, নিরাপত্তা ও অনুশীলনের জায়গা থাকে না। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা একমাত্র সম্বল হতে পারে যেখানে নারী ক্রীড়াবিদদের সব চাহিদা পূরণ করতে পারে।’
মহিলা ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান সাধারণ সম্পাদিকা (ভারপ্রাপ্ত) ফিরোজা করিম নেলী নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে বললেন, ‘আমাদের গঠনতান্ত্রিক অবস্থাটা এমন- আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতা খেলতে পারি না। জাতীয় পর্যায়ে ফেডারেশনের আয়োজনে নারী খেলোয়াড়েরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে খেলে। আর আন্তর্জাতিক সকল খেলা তো ফেডারেশন নির্ভর। ফলে আমাদের নিজেদের খেলা আয়োজন ও স্বল্প বাজেটে স্বল্পমেয়াদের প্রশিক্ষণ ছাড়া বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না।’
জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র নারী ক্রীড়াবিদ দাবাড়ু রাণী হামিদ। ৭৭ বছর বয়সী এই দাবাড়ু মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যক্রম দেখলেও এর মাধ্যমে জাতীয় প্রভাব দেখছেন না, ‘দাবা ইনডোর খেলা ও মহিলাদের জন্য বেশ উপযোগী। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা দাবার টুর্নামেন্ট মাঝে মধ্যে করে কিন্ত এ থেকে তেমন জাতীয় দাবাড়ু উঠে আসে না।’
কৃতি অ্যাথলেট রওশন আরা ছবি কয়েক মেয়াদে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন মহিলা ক্রীড়া সংস্থায়। নারী অ্যাথলেট উঠে না আসার দায় নিলেন নিজের কাঁধেও, ‘আমি অনেক দিন থেকেই কোষাধ্যক্ষ। ব্যাংকার ছিলাম তাই হিসাব নিকাশের ভার আমার কাঁধে দেয় সবাই। বিভিন্ন কমিটির সভায় প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাস্তবায়ন হয় না। ফলে খেলোয়াড় তৈরি হয় না।’
স্বাধীনতার আগে সুফিয়া, ছবি স্বাধীনতার পর পর যারা ক্রীড়াঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সেই ডানা, লিনু, মিমোদের পেছনেও মহিলা ক্রীড়া সংস্থা সেইভাবে ভূমিকা ছিল না। টানা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস বুকে নাম লেখানো টিটির সাবেক তারকা জোবেরা রহমান লিনু বলেন, ‘আমার খেলোয়াড়ী জীবনে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার তেমন ভূমিকা ছিল না। আমাদের পরবর্তীতেও টেবিল টেনিসের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকরী ভূমিকা নেই।’ রংপুর থেকে উঠে আসা ডানা বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে ব্যাডমিন্টন সরাসরি রংপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে; পরবর্তীতে ক্লাবের হয়ে খেলেছি।’
টিটি, অ্যাথলেটিক্স, দাবায় সেই অর্থে ভূমিকা না রাখলেও সাঁতারে রয়েছে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার বিশাল অবদান। টানা কয়েক বছর নারী সাঁতারুদের অভিভাবক ছিল বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। সাবেক জাতীয় তারকা সাঁতারু লায়লা নুর মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অবদানের কথা স্বীকার করতে ফিরে গেলেন আশির দশকে, ‘সরকারের এক আইনে নারী সাতার এক প্রকার বন্ধই হয়ে যায়। এক পুলে ছেলে ও মেয়েদের সাঁতার করা যাবে না। তখন মহিলা ক্রীড়া সংস্থা উদ্যোগে আমরা সাঁতারে অংশ নিতাম। এভাবে কয়েক বছর আয়োজন করে সাঁতারুদের বাচিয়ে রেখেছিল মহিলা ক্রীড়া সংস্থা।’
লায়লা নূরের কয়েক বছর পর সাঁতার অঙ্গনে আসা নিবেদিতা দাসও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভূমিকা দেখছেন তার ক্যারিয়ারে, ‘আমাদের ক্যারিয়ারের একদম শুরুতে বিশাল ভূমিকা ছিল মহিলা ক্রীড়া সংস্থার। এখনো মনে আছে ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়তাম। অনুশীলন করতে গিয়ে কেঁদেছি অনেক। সেখান থেকেই সাঁতারু হওয়ার হাতেখড়ি।’
২০১৬ এসএ গেমসে রেকর্ডসহ দুই স্বর্ণজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলাও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অবদান স্বীকার করেছেন, ‘আমাদের সময়কার সব জাতীয় সাঁতারুর প্রথম প্রতিযোগিতাই ছিল মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। সেখান থেকেই আমরা ফেডারেশনে এসেছি।’ গত এক দশকে অবশ্য আর সেই যোগান পায় না ফেডারেশন মহিলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে।
সাঁতারের মতো নারী ফুটবলের দুর্দিনে পাশে ছিল এই মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। মহিলা ফুটবলের পথচলা আশির দশকে শুরু হলেও মাঝে ঝিমিয়ে পড়ে। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন মহিলা ফুটবল পেশাদারভাবে চালু করতে বাফুফেকে চাপ দেয়। সেই সময় অনেকে নারী ফুটবল শুরুতে বাঁধা দেয়। তখন নারী ফুটবল ক্যাম্প ও অনুশীলন হতো মহিলা ক্রীড়া সংস্থায়।
সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদিকা কামরুন নাহার ডানা বলেন, ‘মহিলা ফুটবল আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভূমিকা রয়েছে। শুরুর দিকে এই মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় ক্যাম্প হতো এবং সব কিছু মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স কেন্দ্রিক ছিল।’
বর্তমান সময়ের আরেক নারী ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত তার ক্যারিয়ারের পেছনে এই সংস্থার কোনো ভূমিকা দেখেন না, ‘একবার আমাদের জাতীয় ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে কিছুদিন ছিলাম। এছাড়া ওই সংগঠনের আমার পেছনে কোনো ভূমিকা নেই।’ ভারত্তোলক সীমান্তর মতোই প্রতিক্রিয়া কিংবদন্তি শ্যূটার সাবরিনা সুলতানার, ‘অন্য খেলায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অবদান কি জানি না। তবে শ্যুটিংয়ে এই সংস্থার সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না।’
দেশের তিন জনপ্রিয় দলীয় খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি। এর মধ্যে হকি নিয়ে কোনো আয়োজনই করে না মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। ক্রিকেট একটা সময় হলেও এর পর আবার দীর্ঘ সময় বন্ধ। এখন আবার সেই উদ্যোগ নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা ফিরোজা করিম নেলী, ‘আমাদের এখানে ক্রিকেট পিচ ও আনুষাঙ্গিক কাজ করে দেওয়ার কথা ক্রিকেট বোর্ডের। সেটা হলে এখানে প্রথম বিভাগ নারী ক্রিকেট ও আমরাও ক্রিকেট আয়োজন করতে পারব।’ এক সময় নারী ফুটবলের আঁতুড়ঘর হলেও বেশ কয়েক বছর আর ফুটবল আয়োজন করছে না মহিলা ক্রীড়া সংস্থা।
দলীয় খেলার মধ্যে হ্যান্ডবল ও ভলিবল প্রতি বছর আয়োজন হয়। এই দুটি খেলা আয়োজন করতে গিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুদান প্রায় শেষ হয়ে যায় বলে জানালেন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা, ‘একটি ফেডারেশন শুধু একটা খেলাই আয়োজন করে। আমাদের বেশ কয়েকটি খেলা আয়োজন করতে হয়। সীমিত বাজেটে এত খেলা আয়োজন করা আমাদের কষ্টসাধ্য। ভলিবল ও হ্যান্ডবলে ২০-৩০ টি জেলা খেলে। মেয়েদের আসা যাওয়া, খাওয়া, পুরস্কার আনুষঙ্গিক মিলিয়ে দশ লাখের উপর খরচ হয়।’
মহিলা ক্রীড়া সংস্থা প্রতি বছর তাদের অধিভুক্ত জেলাদের নিয়ে কয়েকটি ডিসিপ্লিনে আয়োজন করে। সেই আয়োজনের পর সব খেলার বাছাইকৃতদের নিয়ে প্রশিক্ষণ খুব বেশি হয় না। বছরে দুয়েকটি খেলার প্রশিক্ষণ হলেও খুব স্বল্প দিনের। এই প্রসঙ্গে সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা কামরুন নাহার ডানা বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ করানোর সামর্থ্য মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নেই।’
মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় আগে ১৫০ জনের মতো আবাসিক ব্যবস্থা ছিল। ১০ কোটি টাকার নতুন সংস্কার প্রকল্পের পর এখন আবাসন ব্যবস্থা হয়েছে ২৫০ নারী ক্রীড়াবিদের। সুন্দর মাঠ, আবাসন ব্যবস্থা, জিমনেসিয়াম রয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য শুধু প্রয়োজন কোচ ও খাবারের যোগান।
এক্ষেত্রে আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বললেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা, ‘কয়েক দিন পর আমাদের আন্তঃবিভাগ হ্যান্ডবল। এজন্য মাঠের বরাদ্দের জন্য অনুমতি নিতে হয়েছে এনএসসি থেকে। মাঠের বরাদ্দ থাকলেও এখনো আসেনি আবাসিক অনুমতি। আমাদের জন্য মাঠ, হোস্টেল থাকলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুমতি প্রয়োজন হয় সব বিষয়ে।’
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কয়েক বছর যাবৎ মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে বার্ষিক সাড়ে ১৭ লাখ টাকা অনুদান দিচ্ছে। এর পাশাপাশি মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাঁতার ও অন্যান্য কিছু প্রশিক্ষণ থেকে মাসিক নিজস্ব আয় রয়েছে লাখ টাকার উপরে।
আয়-ব্যয় সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকার বক্তব্য, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুদানে সব খেলা আয়োজন হয় না। আমাদের নিজস্ব আয় থেকে স্টাফদের বেতন, খেলা আয়োজন ও প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় হয়। সাঁতার থেকে আয় আসলেও এর পেছনে খরচও অনেক।’
আর্থিক টানাটানির মধ্যেও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার তহবিল রয়েছে এক কোটির মতো। সঞ্চিত তহবিল সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকিার বক্তব্য, ‘এই অর্থ ধীরে ধীরে এই অবস্থায় এসেছে। যে কোনো সংগঠনের জরুরি বা বিশেষ সম্বল হিসেবে একটা আলাদা ফান্ড গচ্ছিত রাখা দরকার। যেটা প্রয়োজন বা বিশেষ ক্ষেত্রে নির্বাহী কমিটির অনুমোদনে ব্যবহার করা যায়।’ বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক হামিদা বেগম ব্রেন স্ট্রোক করে অসুস্থ প্রায় দুই বছর। যুগ্ম সম্পাদক নেলী ভারপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করছেন।
৫০ বছরের এই সংস্থায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন সভানেত্রী ও ১৮ জন সাধারণ সম্পাদিকা দায়িত্ব পালন করেছেন। এক বছরের মধ্যে তিন বার সাধারণ সম্পাদিকা পরিবর্তনের ঘটনা রয়েছে আবার একটানা সাত-আট বছরের দায়িত্ব পালনের রেকর্ডও আছে। প্রায় সব ফেডারেশনের অধিভুক্ত হওয়ায় কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন ফেডারেশনের কাউন্সিলর হওয়ার জন্য থাকে জোর তদবির। অন্য ফেডারেশনের মতো মহিলা ক্রীড়া সংস্থাও রাজনীতি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের বাইরে নয়।
মাহফুজা আক্তার কিরণের নির্বাচিত কমিটি ভাঙা-গড়া নিয়ে পুরো ক্রীড়াঙ্গন তোলপাড় ছিল অনেক দিন। ডানা-কিরণ দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ের সংগঠক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা। ঘটনার এক দশক পেরিয়ে গেলেও এই বিভেদ এখনো বিদ্যমান। যা নারী ক্রীড়াঙ্গনে গত এক দশকে নানাভাবে প্রভাব পড়েছে।
কাজের স্বীকৃতি প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা মাহফুজা আক্তার কিরণ, ‘কাজের স্বীকৃতি পাওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে নারীদের জন্য তো বটেই। আমার সময়ে সম্মাননা চালু করেছিলাম। এরপর আর সেটা অনুসরণ করা হয়নি।’ কিরণ ২০১১ সালে ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে কৃতি নারী ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকদের সম্মাননা জানিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের কোনো সুভিনিয়র, প্রকাশনী অবশ্য এখন সংরক্ষিত নেই ।
সংরক্ষণের বিষয় অবশ্য উদ্যোগ নিচ্ছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা, ‘তৃতীয় তলায় আমরা একটি কর্ণার করছি। সেই কর্নারে নারী ক্রীড়াবিদদের বিভিন্ন অর্জন, প্রকাশনা সব সংরক্ষিত থাকবে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অর্থায়ন করার কথা, তারা না করলে আমরা নিজেরাই করব।’
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা
রাবেয়া তালুকদার, লুৎফুন নেছা হক বকুল, কাজী জাহেদা আলী, জিনাত আহমেদ, মরহুম সুলতানা কামাল, ফাহমিদা হোসেন লুনা, ডলি ক্যাথরিন ক্রুজ, কামরুন নাহার ডানা, রাণী হামিদ, কাজী নাসিমা হামিদ, সুফিয়া খাতুন, পারভীন লায়লা লুসি, সাবরিনা সুলতানা, কাজী শাহানা পারভীন, রাজিয়া সুলতানা, শামীমা সাত্তার মিমো, লায়লা নূর, হোসনে আরা খান, খুরশিদা আক্তার খুশী, মাহমুদা শরীফ, নয়না চৌধুরি, শারমিন আক্তার, নেলী জেসমিন, নিপা বোস, রওশন আখতার ছবি, হেলেনা ইভা, ফিরোজা খাতুন, নাজিয়া আক্তার যুথী, সালমা রফিক, সেতারা বেগম, ফৌজিয়া হুদা জুই, শর্মিলা রায়, হামিদা বেগম, শামীম আরা টলি, সৈয়দ মরিয়ম তারেক, কামরুন নাহার হীরু।
৫০ বছরে দায়িত্ব পালন করা সাধারণ সম্পাদিকাগণ
লুফুন নেছা হক বকুল, সোফিয়া জাহান আলী, জিনাত আহমেদ, হামিদা আক্তার বেগম, রাজিয়া শফিউদ্দিন (ভারপ্রাপ্ত ), মেহেরুন নেসা জামান, ফেরদৌস আরা খানম, নাজমা শামীম, শামীমা সাত্তার মিমো (ভারপ্রাপ্ত ),হোসনে আরা হাসি( ভারপ্রাপ্ত) , সুফিয়া খাতুন, ফেরদৌস আরা ডলি, কামরুন নাহার ডানা ( ৩ বার) রীনা পারভীন, মাহফুজা আক্তার কিরণ, পারীভন বানু, হামিদা বেগম,ফিরোজা করিম নেলী (ভারপ্রাপ্ত )
সভানেত্রীগণ
সৈয়দ সাজেদা চৌধুরি, রাবেয়া খাতুন তালকুদার(২ বার) , সোফিয়া হাসনা জাহান আলী, হামিদা আলী (২ বার) তাহমিনা খান ডলি, হামিদা খানম, বকুল (ভারপ্রাপ্ত),রাফিয়া আক্তার ডলি (২ বার), শামসুন নাহার খাজা আহসান উল্লাহ, হামিদা খানম, মুশফেকা ইকফাৎ, রাজিয়া বেগম, মাহবুব আরা বেগম গিনি।
এজেড/এমএইচ/এটি