জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ বল ক্রিকেট কার্নিভাল
গুরু সালাউদ্দিনকে মুশফিকের চ্যালেঞ্জ
সবাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। একেক জন একেক পেশার, বয়সের। ভিন্নতা রয়েছে বিভাগ, হলের ; ৫০ বল ক্রিকেট কার্নিভাল সবাইকে যেন এক বিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশে ৫০ বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের তেমন প্রচলন নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পদার্পণকে ধারণ করেই সাবেক ছাত্রদের এই ৫০ বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগরের কয়েকটি ইউনিক বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ক্যাম্পাস থেকে বিদায়ের আগে ব্যাচের রাজা-রাণী নির্বাচন, র্যাগ। সবুজ চত্বর ছাড়ার পরেও সাবেকদের কর্মকাণ্ড নতুন স্বাতন্ত্র্যতা আনছে। সাবেকদের নিয়ে ৫০ বলের টুর্নামেন্ট এমনই এক আয়োজন।
বিজ্ঞাপন
এই আয়োজনের ব্যাপকতা ও সম্পৃক্ততার পরিধি এখন ব্যাপক হলেও প্রথম ধারণাটা ছিল জুবায়ের আরেফিন জসি ও মাসুমের। তারা বলছিলেন, ‘আমরা এসএসসি-এইচএসসি ব্যাচের টুর্নামেন্টে এন্ট্রি দিয়েছিলাম জাবিয়ান-৩২ নাম দিয়ে। তখনই মাথায় এসেছিল আমরা জাবিয়ানরা নিজেদের মধ্যে ব্যাচভিত্তিক একটা টুর্নামেন্ট করতে পারি। সেই ধারণাটা নিয়ে আমরা সিনিয়র শিপন (২৮ ব্যাচ অর্থনীতি) ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করি।’
‘পরে তিনি দেবাশীষ দা (৩০ ব্যাচ), জয়ীত (অর্থনীতি ২০ ব্যাচ) ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা আরো সিনিয়র, জুনিয়র, ব্যাচমেটদের সঙ্গে আলাপ করে একটি পর্যায়ে আনেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে সভা করেছি। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সজীব (ভূগোল ও পরিবেশ ৩১ ব্যাচ) ভাই অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন।’
পরিকল্পনা সহজ, বাস্তবায়ন কঠিন। বাস্তবায়ন করতে শিপন, জোসি, মাসুম, মনা গত এক মাসে অনেক সময় ব্যয় করেছে। সতীর্থদের আন্তরিকতায় সেই চাপকে চাপ মনে করেননি শিপন, ‘এ রকম টুর্নামেন্টে সবার আগ্রহ দেখে আমরা আয়োজনে উদ্যোগী হই। তখনই আসে মাঠ, স্পন্সরসহ বিভিন্ন বিষয়। এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে আমাদের ব্যাচমেট, সিনিয়র-জুনিয়ররাই। টুর্নামেন্টের টাইটেল স্পন্সর প্রোলিফিক ক্লাউড (৩২ ব্যাচের রনি স্বত্বাধিকারী), কো-স্পন্সর রয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এর প্রায় সবই জাবিয়ানদের।’
শিপনের আট ব্যাচ সিনিয়র হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকতা নওশাদ মোস্তফা জয়ীত এখনো যেন তারুণ্যের প্রতীক, ‘এই টুর্নামেন্ট নিয়ে অফিসের নিচে মিটিংও করেছি অনেক। এক প্রতিষ্ঠান পুরো টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মত ছিল, জাবিয়ান না হওয়ায় মন আর সায় দেয়নি নিতে। আমরা চেয়েছি নিজেদের মধ্যে থেকেই সব কিছু করতে।’
৫০ বলের টুর্নামেন্ট জয়ীতকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল যেন ত্রিশ বছরের আগের সেই ক্যাম্পাসের স্মৃতিতে, ‘খেলাধুলা করেই কাটিয়েছি ক্যাম্পাস জীবন। বিভাগ, হলের কত খেলার কত ঘটনা। হলের খেলার আড্ডায় বন্ধু সানোয়ারের সঙ্গে অনেক সময় থাকত হাবিবুল বাশার সুমনও (জাতীয় দলের সাবেক অধিনাক খেলোয়াড়ী জীবনে জাহাঙ্গীরনগরে বেড়াতে ও খেলা দেখতে গিয়েছেন অনেক)।’
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত হলেও ক্রীড়াঙ্গনেও অবদান অনেক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র (মাহফিজুর রহমান সাগর ইতিহাস ৪০ ব্যাচ) বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছে। প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট দলের সদস্যের মধ্যেও ( মন্জু নৃবিজ্ঞান ২৫ ব্যাচ) ছিল জাবির প্রতিনিধিত্ব। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটে জাহাঙ্গীরনগরের অবস্থান ও অবদান বিশেষ পর্যায়ের।
মুশফিকুর রহিম আফগানিস্তান সিরিজে ব্যস্ত রয়েছেন। সেই ব্যস্ততার মধ্যেও কয়েক মিনিটের জন্য ভার্চুয়ালি উপস্থিত হয়ে জাহাঙ্গীরনগরের প্রতি তার ভালোবাসা ও আবেগ পুরোটাই প্রকাশ করেছেন, ‘বাংলাদেশকে আমি প্রতিনিধিত্ব করি এজন্য গর্বিত। এর চেয়েও গর্বিত আমি জাহাঙ্গীরনগরের একজন। জাহাঙ্গীরনগরের বিশালতার মধ্যে আমি খুবই ক্ষুদ্র ও নগণ্য একজন। ৫০ বছরে ৫০ বলের উদ্যোগটি দারুণ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি টানের পাশাপাশি জাবির প্রত্যেক ছাত্রের ব্যাচের প্রতি ভালোবাসা সব কিছুর উর্ধ্বে। মুশফিকও এর বাইরে নন। তার ব্যাচের প্রতি শুভকামনা জানাতে গিয়ে গুরু সালাউদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন, ‘সালাউদ্দিন স্যার বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন হলেও এখানে হতে পারবেন না। এখানে (৫০ বলে) আমরাই ( ৩৬ ব্যাচ) চ্যাম্পিয়ন হবো। আমি সুযোগ পেলে অবশ্যই আমার ব্যাচের হয়ে খেলব।’
আফগানিস্তান সিরিজ শেষ করেই দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। ১৮ মার্চ শেষ হতে যাওয়া জাবি ৫০ বলের এই টুর্নামেন্ট মুশফিকের খেলার সম্ভাবনা সেই অর্থে নেই। মুশফিক জাতীয় দলে এখন অন্যতম সিনিয়র হলেও জাবি ৫০ বল টুর্নামেন্টে তার ব্যাচই সবচেয়ে জুনিয়র। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ৫০ তম ব্যাচ চলছে। সাবেকের তালিকায় ৪৪ সর্বশেষ সংযোজন হলেও প্রথমবার এই আয়োজনের সুবিধার্থে ৩৬ ব্যাচের পর আর কোনো দলের এন্ট্রি নেওয়া হয়নি।
গতকাল রাজধানীর লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটিং স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে শুরু হয়েছে জাবিয়ানদের এই টুর্নামেন্ট। ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট হলেও ব্যাচকে প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছিলেন দুই সাবেক ফুটবলার সুজিত ব্যানার্জি চন্দন (ইতিহাস ২৫) ও জুয়েল (প্রত্মতত্ত্ব ৩০)। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা মাজনুন মিজানকে (২৪ ব্যাচ) গতকাল দেখা গেল পুরোদস্তুর পেশাদার অধিনায়কের ভূমিকায়। কখনো ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা নিয়ে ব্যস্ত আবার কখনো বোলারকে পরামর্শ দিচ্ছেন,ফিল্ডিং পজিশন পরিবর্তন করছেন।
টেপ টেনিসে খেলা হওয়ায় যে কেউ ফেভারিট দাবি ছিল এই দুই সাবেক ক্রিকেটারের, ‘এখানে সব ব্যাচের সব প্রায় সবারই খেলার বেসিক রয়েছে। টেপ টেনিসে হওয়ায় পার্থক্য খুব বেশি নয়।’ এই মন্তব্যের প্রতিফলন হয়েছে তাদের ম্যাচেই। ওয়ারিয়র্স ৩৩ এর সঙ্গে তাদের ম্যাচটি ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ। ম্যাচ চলাকালীন জেবির (ভূগোল ও পরিবেশ ৩৩ ব্যাচ) আন্তরিক টিপ্পনীতে পরিবেশ হয় আরো উপভোগ্য।
এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সিনিয়র দল ‘উনিশ-বিশ’। ১১ ব্যাচ জুনিয়র ‘অদম্য ৩০’ এর সঙ্গে হারের কয়েক মিনিটের মধ্যেই উনিশ-বিশের পঞ্চাশ উর্ধ্ব পিকলু সুর তুললেন, ‘দিন যায়, কথা থাকে।’ এই কোরাসের সুর আবার মিশে গেল টুর্নামেন্টের থিম সং ‘জাবিয়ান ছুটে আয়’ গানে। সেই গানে দুলছিলেন দুর্বার ‘২৯ কে হারানো পাঁচ ব্যাচ সিনিয়র হ্যালো ‘২৪ এর মেহেদী জামিলরা। অনেকের বাচ্চা-স্ত্রী তাদের বাবা-স্বামীর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছিলেন। খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাপিয়ে এ যেন এক জাবিয়ান আনন্দপুরি। ১১ জন মাঠে খেললেও ব্যাচকে উতসাহ যোগাতে ও সিনিয়র-জুনিয়রদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন আরো অনেক সাবেক ছাত্র-ছাত্রী।
বিভিন্ন ব্যাচের সংমিশ্রণে ১৪ টি দল এ টুর্নামেন্ট খেলছে। গতকাল প্রথম দিন পাচটি ম্যাচের জয়-পরাজয় হয়েছে। শুক্র-শনির এই টুর্নামেন্ট আনুষ্ঠানিকতার নানা ধাপ পেরিয়ে ১৮ মার্চ এক দলের হাতে ট্রফি উঠবে। সেই দল মাঠের প্রতীকি লড়াইয়ে চ্যাম্পিয়ন হলেও আসল চ্যাম্পিয়ন তো স্পিরিট অফ দ্য গেম ও জাবিয়ান বন্ধন।
এজেড/এমএইচ/এটি