বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন গতকাল খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তাদের মিলিয়ে মোট ৩১ টি’র বেশি শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। হকি তো বটেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে একসঙ্গে এত বড় সংখ্যক শাস্তির ঘটনা আগে কখনো হয়েছে কিনা এ নিয়ে রয়েছে ঘোরতর সংশয়। সতর্কতা থেকে শুরু করে একাধিক আজীবন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে হকি ফেডারেশনের শাস্তির সিদ্ধান্তে। 

গতকাল হকি ফেডারেশনের শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তের প্রায় সবই ছিল সদ্য সমাপ্ত প্রিমিয়ার হকি লিগকেন্দ্রিক। লিগ শেষ হয়েছে প্রায় এক মাসের বেশি। এত সময় পর শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নেয়ায় ফেডারেশনকে উল্টো কাঠগড়ায় রাখলেন সাবেক জাতীয় হকি তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল, 'আমাদের হকি লিগ বিশৃঙ্খলভাবে চলে, শৃঙ্খলা অবশ্যই প্রয়োজন। যখন ঘটনা বা সমস্যা তখনই শৃঙ্খলা সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। লিগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়ার যৌক্তিকতা খুজে পেলাম না।'

হকি ফেডারেশন নানা ম্যাচের নানা ঘটনায় অনেক খেলোয়াড়-কোচ,কর্মকর্তা ও ক্লাবকে জরিমানা করেছে। মোহামেডান রিফিউজ টু প্লে করায় কোনো শাস্তি না পাওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন কামাল, 'রিফিউজ টু প্লে বড় শৃঙ্খলাপন্থী কাজ। এত বড় ঘটনায় ন্যূনতম সতর্ক বা জরিমানাও নেই মোহামেডান ক্লাবের। অথচ মোহামেডানের ক্লাবের স্বার্থের জন্য যে সকল খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা ছিলেন তাদের বড় শাস্তি দেয়া হয়েছে।'

হকি লিগের শেষ ম্যাচ ছিল আবাহনী-মোহামেডান। সেই ম্যাচে দুই দলের খেলোয়াড়রা প্রচন্ড মারামারিতে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেই হট্টগোলে তেড়েফুড়ে ছুটেছিলেন কোচ-কর্মকর্তারাও। তাই শাস্তি এক প্রকার প্রাপ্যই মনে করছেন হকি ফেডারেশনের সাবেক সদস্য ফয়সাল আহসান উল্লাহ, 'ঐ দিন যে ঘটনা ঘটেছে এটা তো অবশ্যই বড় শাস্তির মতো ঘটনাই। ধাক্কাধাক্কি হতে পারেই হিট অফ দ্য মোমেন্টে। হকি স্টিক হকি খেলোয়াড়দের বড় আরোধনা। সেই স্টিক ব্যবহার করে শরীরে প্রয়োগ করা অত্যন্ত দুঃখজনক।' শাস্তি প্রদানের সঙ্গে একমত হলেও ফয়সালের দ্বিমত, 'অপরাধ শাস্তিযোগ্য কিন্তু এত বড় সংখ্যক এবং বেশ কিছু বড় মেয়াদী শাস্তি দেয়া হয়েছে। যা চাইলে এড়ানোযোগ্য ছিল।'

এই হকি খেলোয়াড়রাই ২০২২ সালে ফ্রাঞ্চাইজ হকি লিগ খেলেছেন। তখন প্রিমিয়ার লিগের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তাই খেলোয়াড়,কোচ-কর্মকর্তাদের মানসকিতার উন্নতি প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক তারকা কামাল, 'ফ্রাঞ্চাইজ লিগ সুন্দরভাবে হতে পারলে প্রিমিয়ার লিগ নয় কেন? এই লিগে ঝামেলা করা এক প্রকার মজ্জাগত এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সবাইকে। এজন্য অবশ্যই ডিসিপ্লিনারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন সেটা অবশ্যই যখন খেলার পরে নয়।'

যে কোনো খেলা চলে বাইলজ অনুযায়ী। তেমনি খেলাধূলায় বিধি-ভঙ্গ হলে শাস্তির প্রদানের জন্য রয়েছে ডিসিপ্লিনারি কোড। সেই কোড অনুসরণ করেই সাধারণত ডিসিপ্লিনারি কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হকির ইতিহাসে এত বড় সংখ্যক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ডিসিপ্লিনারি কমিটির চেয়ারম্যান ও কমিটিতে কারা আছেন। গতকাল সভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ডিসিপ্লিনারি কমিটি ফেডারেশনের আভ্যন্তরীণ বিষয় ও প্রকাশ করতে বাধ্য নয় এমনটি জানিয়েছেন। বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না ফেডারেশনের সাবেক দুই সদস্য ফয়সাল ও কামাল, 'ডিসিপ্লিনারি কমিটি যে কোনো ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ কমিটি। এটি অবশ্যই ফেডারেশন ও সংশ্লিষ্টদের জানা উচিত। এতে আরো স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রকাশ পায়।'

খেলাধূলা মানেই তর্ক-বিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা। সেই সমালোচনা করে আজীবন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন মোহামেডানের বিদেশি কোচ গোপীনাথ, ক্লাবের পরিচালক জামাল রানা। হকি ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার জামিলউদ্দিন ফেডারেশনের এমন সিদ্ধান্ত মানতেই পারছেন না একেবারে, 'সমালোচনা হতেই পারে। সেই সমালোচনা যদি ফেডারেশনের পরিপন্থি হয় তাহলে সেই অনুযায়ী শাস্তি হয়। প্রাথমিক ধাপে শোকজ তারপর মাত্রা অনুযায়ী সতর্ক, জরিমানা, ম্যাচ বরখাস্ত এ সব কিছু না করে একেবারে আজীবন নিষিদ্ধ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।'

হকি ফেডারেশনের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে মন্তব্য করার আগ্রহই হারিয়ে ফেলছেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক, 'যেভাবে চলছে হকি ও ফেডারেশন। এখানে বলার কিছু নেই। ঢালাও শাস্তির আওতায় আনলে কেউ আর হকিমুখো হবে না।’

লিগ সংক্রান্ত ৩১ জন শাস্তিপ্রাপ্তের মধ্যে খেলোয়াড়,কোচ-কর্মকর্তা মিলিয়ে মোহামেডানেরই ১০ জন। মোহামেডানের অন্যতম পরিচালক ও হকি কমিটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলেন, 'আমরা লিগ শুরুর সময় থেকেই ফেডারেশনের পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে বলছিলাম। এই সিদ্ধান্তে সেটা আরো স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আমরা ক্লাবের পক্ষ থেকে হকি নিয়ে খুব শীঘ্রই অবস্থান ব্যক্ত করব।'

এজেড/এইচজেএস