বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিক ক্রীড়া সংস্থা অথবা ক্লাবের আলোচনায় ঢাকা আবাহনীর নাম আসবে সবার আগে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঘরোয়া ফুটবলে প্রথম বিদেশি কোচ (বিলহার্ট) নিয়োগ দিয়েছিল আবাহনী। আশির দশকে বিশ্বকাপে খেলা ফুটবলার বাংলাদেশে এনে বাড়তি চমক সৃষ্টি করেছিল। ক্রিকেট, হকিতেও বিশ্বসেরারা আবাহনীর হয়ে খেলেছেন।

আবাহনী আরও আধুনিক ও গতিশীল হতে ১৯৯১ সালে ক্রীড়া চক্র থেকে আবাহনী লিমিটেডে পরিণত হয়। লিমিটেড হওয়ার পর আবাহনীর মাঠের সাফল্য রয়েছে অব্যাহত। দেশের তিন শীর্ষ খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকিতে ক্রমাগত শিরোপা এসেছে। পেশাদার ফুটবল লিগে প্রথম তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। 

এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর মার্কিংয়ে আবাহনী সর্বোচ্চবার সর্বোচ্চসংখ্যক মার্ক পেয়েছে। মাঠের সাফল্যের বাইরেও আবাহনী ক্লাবের সাংগঠনিক অবয়বে বিশেষত্ব আনার চেষ্টা করেছে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের মাধ্যমে। একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া কমপ্লেক্স বাংলাদেশের কোনো ক্লাবেরই নেই। এই দিক থেকেও আবাহনী ছিল অগ্রগণ্য। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ শেখ কামালের নামে ক্রীড়া কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ২০১১ সালে। প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও কমপ্লেক্সের অগ্রগতি সেভাবে হয়নি।

২০১১ সালের সেই ভিত্তিপ্রস্তর/ঢাকা পোস্ট

আবাহনী লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিল আহমেদ এমপি শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স নিয়ে লন্ডন থেকে বলেন, ‘আমাদের সবারই স্বপ্ন সুন্দর ও আধুনিক শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের। আমরা সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকেই রয়েছি। করোনা আমাদের লক্ষ্যপথে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে।’ 

৫ আগস্ট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন। এ দিনটিতেই ক্লাবে সবচেয়ে প্রাণচাঞ্চল্য থাকে। করোনার জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন গত বছরের মতো এই বছরেও অনলাইনে আলোচনা ও স্মরণসভা হবে। ৫ আগস্ট শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা জানালেন ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ, ‘আমাদের সম্মানিত চেয়ারম্যান (সালমান এফ রহমান) ক্লাবের সার্বিক বিষয় ও ক্রীড়া কমপ্লেক্স নিয়ে আলোকপাত করবেন।’

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রথম ফুটবল দলের অধিনায়ক আব্দুস সাদেক। সেই '৭২ থেকে আজ অবধি আবাহনীর সাথে জড়িত সাদেক। খেলোয়াড়,কোচের পর এখন ক্লাবের পরিচালকের দায়িত্বে। আবাহনী ক্লাব ও শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স নিয়ে এই পরিচালকের মন্তব্য, ‘আবাহনী ক্লাব নিয়ে শেখ কামালের অনেক স্বপ্ন ছিল। আবাহনী এশিয়ার সেরা ক্লাব হবে। আবাহনীর অবশ্যই সে সামর্থ্য রয়েছে। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ সহ সব অঙ্গনের সেরা ব্যক্তিত্বরাই এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িত। এমন ক্লাব অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ক্লাব না হওয়ার কোনো কারণ-ই নেই। কিছুটা দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা শেখ কামালের স্বপ্নকে এখনো সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ অবশ্য কামালের স্বপ্ন দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব।’

১৯৭২-৯০ পর্যন্ত আবাহনী ক্রীড়া চক্র হিসেবে ছিল। ১৯৯১ থেকে আত্মপ্রকাশ হয় আবাহনী লিমিটেড হিসেবে। সেই সময় বাংলাদেশের কোনো ক্লাব তো নয়ই দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো ক্লাবও এত দূরদর্শিতার পরিচয় রাখতে পারেনি। ১৯৯১ সালে ১১ জন ( সালমান এফ রহমান,সাবের হোসেন চৌধুরি, লে. কর্নেল (অব.) কাজী শাহেদ আহমেদ, তানভীর মাজহার ইসলাম (তান্না),ফজলুর রহমান,ফজলুর রহমান মারুফ, রনবীর রায়,হারুনুর রশিদ, মোমেনউদ্দিন আহমেদ,নাজির আহসান ও আহমেদ ফায়জুর রহমান) শেয়ারহোল্ডার নিয়ে যাত্রা শুরু আবাহনী লিমিটেডের। এই ১১ জনের মধ্যে ক্লাবের প্রথম বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস ছিলেন সালমান এফ রহমান, সাবের হোসেন চৌধুরি ও লে.কর্ণেল (অব.) কাজী শাহেদ আহমেদ, ক্লাবের আর্টিকেল অনুযায়ী চেয়ারম্যান সালমান এফ. রহমান।

১৯৯১ সাল পরবর্তীতে আবাহনীর পরিচালক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। ক্রীড়াঙ্গন সংশ্লিষ্ট ও অনেক ক্রীড়ামোদী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পরিচালক হলেও আবাহনীর সাবেক তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে পরিচালক হওয়ার সংখ্যাটা অবশ্য কম। আবাহনীর অনেক সাবেক তারকা খেলোয়াড় ও বিশিষ্ট কর্মকর্তারা ফুটবল, হকি ও ক্রিকেট বোর্ডে থাকলেও ক্লাবের পরিচালক হননি; তন্মধ্যে অন্যতম আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, ক্রিকেটার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, জালাল ইউনুস, জিএস হাসান তামিম, ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন, শেখ আসলাম, আবদুল গাফফার, সত্যজিৎ দাস রুপু সহ আরো অনেকে।

আবাহনীর হয়ে পাঁচ বার ঢাকা লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা শেখ মো. আসলাম এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আবাহনী ক্লাবকে জনপ্রিয় ও সাফল্যমন্ডিত করার পেছনে আমার কিছুটা অবদান রয়েছে। আবার আমার আসলাম হয়ে ওঠার পেছনেও আবাহনীর অবদান আছে। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার পর ইচ্ছে ছিল আবাহনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার। ক্লাবে যোগাযোগ ও যাওয়া-আসা থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া হয়নি। ক্লাবও আমাকে সেভাবে সম্পৃক্ত করেনি ফলে আর পরিচালক হয়ে ওঠা হয়নি।’

আসলামের মতোই অনেকটা আক্ষেপ আরেক সাবেক তারকা ফুটবলার আব্দুল গাফফারের কন্ঠে, ‘মোহামেডান দিয়ে আমার ঢাকা লিগের ক্যারিয়ার শুরু হলেও আবাহনীর গাফফার হিসেবে ফুটবলাঙ্গনে পরিচিতি আমার। আবাহনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরবর্তীতে আর পরিচালক হইনি।’ 

আবাহনীর সাবেক ফুটবল ম্যানেজার মনজুর কাদের শেখ জামাল ধানমন্ডি লিমিটেড ক্লাবের দায়িত্ব নেয়ার পর আবাহনীর পরিচালক ও কিংবদন্তি ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু ক্লাবটির ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান। গত ছয় বছরের বেশি সময় আবাহনীর পরিচয় ছাপিয়ে চুন্নুর আনুষ্ঠানিক পরিচয় এখন শেখ জামালের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান। যে আবাহনীর হয়ে ঢাকার মাঠে অসংখ্য কীর্তি চুন্নুর সেই চুন্নু এখন আবাহনীর বিরুদ্ধে জামালের হয়ে ডাগআউটে দাঁড়ান।

আবাহনীর সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে চুন্নু বলেন, ‘কামাল ভাই নিজ হাতে আমাকে আবাহনীতে এনেছিলেন। খেলোয়াড়ি জীবন পুরোটাই আবাহনীতে কাটিয়েছি। খেলা ছাড়ার পর ম্যানেজার, দলনেতা পেরিয়ে পরিচালক হয়েছি। সব সময় ক্লাবের পাশে ছিলাম, বিশেষ করে দুঃসময়ে। আবাহনী ও আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমি ফুটবল নিয়ে কাজ করতে চাই। আবাহনীতে এক সময় কাজের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে এসেছিল। ফলে কিছুটা দুরে সরে যাই। পরবর্তীতে কাদের ভাইয়ের আমন্ত্রণে শেখ জামালে কাজ করছি। শেখ জামাল কামাল ভাইয়ের-ই ছোট ভাই। আমি শেখ জামালে সম্পৃক্ত থেকে মনে করি কামাল ভাই ও তার পরিবারের সঙ্গেই ছিলাম, আছি ও আজীবন থাকব।’

চুন্নুর মতো আবাহনীর আরেক পরিচালক প্রয়াত গোলাম রব্বানী হেলাল শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। আবাহনীর পরিচালক হয়ে অন্য ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য গঠনতান্ত্রিক বা আইনত কোন বাধা নেই।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক ফেডারেশন, ক্লাবগুলোতে নির্বাচন নিয়মিত বিরতিতে অনুষ্ঠিত হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। আবাহনী ক্লাবের গঠন ও পরিচালনা পদ্ধতি অন্য ক্লাব থেকে ভিন্ন জানালেন ক্লাবটির ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ, ‘আমাদের ক্লাবে নির্বাচন পদ্ধতি নেই। পরিচালকরা আলোচনা ও সভার মাধ্যমে ক্লাব পরিচালনা করেন। আমার বাবা ( লে.কর্ণেল অব.কাজী শাহেদ আহমেদ) ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ ছিলেন। তার অসুস্থতার জন্য পরিচালকদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমাকে ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’

ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া,ফরাশগঞ্জের মতো ক্লাবগুলো মাঠে সাফল্য খরায় ভুগলেও অনেকটা নিয়মিতভাবে বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন করে। খেলার মাঠে ও মাঠের বাইরে আবাহনীর অনেক সাফল্য থাকলেও বার্ষিক সাধারণ সভার হিসাব সংখ্যায় কয়েকটি ক্লাব থেকে পিছিয়ে আবাহনী। আবাহনী ক্লাবের সঙ্গে চার দশকের বেশি সময় যাবত জড়িত আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভা সম্পর্কে তার বক্তব্য, ‘আবাহনী ক্লাবে একটি সাধারণ সভা হতে দেখেছি আমি।’

আবাহনীর প্রথম ফুটবল অধিনায়ক ও পরিচালক আব্দুস সাদেক সর্বশেষ পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণ করেছেন বছর ছয়-সাত আগে। পরিচালকদের সভা সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিল বলেন, ‘পরিচালক বোর্ডের সভা কিছুটা অনিয়মিত। আমাদের সর্বশেষ সভা হয়েছে বছর দুই আগে। বছর দুই আগে সভা হলেও এর মধ্যে অবশ্য ফুটবল ও ক্রিকেট দল গঠন এবং পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আলাদা সভা হয়েছে।’

আশি-নব্বই দশকে ফুটবল ও ক্রিকেট দলবদল মৌসুমে আবাহনী-মোহামেডান দুই ক্লাবে থাকত জমজমাট আবহ। খেলোয়াড় নেওয়া-বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তগুলো হতো ক্লাবে। আধুনিক ও পেশাদার যুগে অবশ্য ক্লাব সংস্কৃতির সেই চিত্র বদলেছে। ক্লাবের পরিবর্তে কর্পোরেট অফিসগুলোতে দলবদলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে এখন।

ঘরোয়া ফুটবলে আগের সেই জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। বসুন্ধরা কিংস ও সাইফ স্পোর্টিং আসার পর ফুটবলের চিত্র কিছুটা বদলাচ্ছে। এই দুই দলের জার্সি পড়া তরুণ প্রজন্মের অনেককে রাস্তায় দেখা যায় প্রায়ই। যেটা আগে ছিল আবাহনী-মোহামেডানের। আবাহনী দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব। আবাহনীর অসংখ্য সমর্থক। সেই সমর্থক ও তরুণ প্রজন্মের বিষয় বিবেচনা করে আবাহনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য বেশ সক্রিয় হয়েছে।

চলতি বছর আবাহনী ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলে এখনো শিরোপার জন্য লড়ছে । গত তিন বছর ফুটবলে আবাহনীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বসুন্ধরা কিংস। আবাহনীকে হারিয়ে লিগ,ফেডারেশন কাপ জিতেছে নতুন দলটি। ফুটবলাঙ্গনে নতুন আসলেও ইতোমধ্যে ক্রীড়া কমপ্লেক্সের কাজ শুরু করেছে বসুন্ধরা কিংস। মাঠের মতো মাঠের বাইরেও অলিখিতভাবে আবাহনীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিচ্ছে কিংস। ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্নে কারা প্রথম হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় দেশের ক্রীড়ামোদীরা।

এজেড/এটি/এনইউ