‘উত্সব, আনন্দ আর সুখের প্রতিচ্ছবি-এ নিয়েই হলুদ জার্সি! আরেকটু সরাসরি বলা যায় ব্রাজিলের জার্সি।’ -কথাটি লাতিন আমেরিকার ওই দেশটির কেউ বলেননি। বলেছেন ফরাসি কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান। আসলেই তো তাই। এটা নিছক কোনো রং নয়। ওই হলুদ জার্সি গায়ে দিয়েই তো ফুটবলকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে ব্রাজিল।

হলুদ জার্সি গায়ে দিয়ে সময়ের সেরা তারকারাই মাঠ মাতিয়েছেন, মাঠ মাতাচ্ছেন। শুধু সময়ের বলা কেন, সর্বকালের সেরাদের অন্যতম পেলে, জর্জিনহো, গারিঞ্চা, জিকো, সক্রেটিস আর রোনালদোর মতো ফুটবলাররা এ রংটাকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু সেই হলুদ বিপ্লব। এখনও মাথা উঁচু করেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এ জার্সি পরা ফুটবলাররা।

হলুদ রং সেলেকাওদের সৌভাগ্যের প্রতীকও। 

১৯৫৪ সালের ১৪ মার্চ যাত্রা শুরু। রিও ডি জেনিরোর মারাকানায় ১ লাখ ১২ হাজার ৮০৯ জন দর্শকের সামনে প্রথমবারের মতো এ জার্সিতে মাঠে নামে ব্রাজিল। তার চার বছর বাদেই সুইডেনকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সাদার মধ্যে নীল রংয়ের জার্সি পরেই এর আগে মাঠে নামত ব্রাজিল। ১৯৫০-এর বিশ্বকাপে ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’তে এ জার্সিই ছিল দেশটির ফুটবলারদের গায়ে। এরপরই সাদা-নীল থেকে সরে আসার পথ খুঁজছিলেন দেশটির ফুটবল কর্তারা। এ স্রোতে গা ভাসায় দেশটির পত্রিকা ‘কোরেয়ো ডা মানহা’। সেটা ১৯৫৩ সালের ঘটনা। ব্রাজিলের নতুন জার্সির ডিজাইন নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তারা। তবে একটা শর্ত জুড়ে দেয় তারা। সেই পোশাকে অবশ্যই থাকতে হবে ব্রাজিলের পতাকার চার রং-হলুদ, নীল, সবুজ আর সাদার সমাহার। জানানো হয়, সেরা ডিজাইনের জার্সিটি পরেই পরের বিশ্বকাপে খেলতে নামবে ব্রাজিল দল।

জমে ওঠে প্রতিযোগিতা। ডিজাইন পাঠানো হতে থাকে দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তবে উরুগুয়ে সীমান্তের কাছাকাছি থেকে ১৮ বছর বয়সী এক শিল্পীর ডিজাইন ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। অ্যালডর গার্সিয়া শ্যালে নামের সেই তরুণ ১০০ ধরনের নকশা ও রং নিয়ে পরীক্ষা করেন। অবশেষে তার স্কেচে আসে হলুদ রংয়ের জার্সি। যেখানে পায়ে নীল রংয়ের মোজা। এমনটাই যেন খুঁজছিলেন আয়োজকরা। ৪০১টি ডিজাইনের মধ্যেই এটিই হয়ে যায় সেরা।

ব্যস, পরের বিশ্বকাপেই দেখা মিলল এ জার্সি। এরপর সাফল্যও ধরা দিল একের পর এক। তবে পুরো বিশ্বের এ রংটা বুঝতে আরও কিছুদিন লেগেছে। তখনও যে রঙিন টেলিভিশনের যুগ আসেনি। ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ থেকেই রঙিন টেলিভিশনে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ দেখলেন ফুটবলপ্রেমীরা। চোখ ধাঁধিয়ে গেল হলুদ রংয়ে। ইতালিকে হারিয়ে জুলে রিমে ট্রফিটা একেবারে নিজেদের করে নেয় পেলের দেশ।

হলুদ রংয়ের জার্সিটাও তখন বিখ্যাত হয়ে যায়। সময়ের পথ বেয়ে এরপর এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত জাতীয় দলের জার্সি। এমন তথ্যটাই দিল ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাইকি। ব্রাজিলের অফিসিয়াল জার্সিটা তারাই তৈরি করে।

ব্রাজিলের জার্সির জনপ্রিয়তাটা বুঝতে হলে চোখ ফেরাতে হবে একটু পেছনে। সাল ২০০২। নিলামে উঠল পেলের একটি জার্সি। যেটি গায়ে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এ ফুটবলার। শেষ পর্যন্ত ভক্তদের কাড়াকাড়িতে তার দাম উঠল ১ লাখ ৫৮ হাজার পাউন্ড!

তাই তো প্রায় ৭০ বছর পেরিয়েও এখন পুরনো বিতর্কটা ফের চাঙ্গা। বলা হয়ে থাকে এ জার্সি গায়ে দিয়ে নাকি মাঠে নামার কথা ছিল উরুগুয়ের। প্রতিবেশী দেশটির ফুটবলবোদ্ধারা এখনো লিখেছেন, ‘আমাদের জার্সিটা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন ছিনতাই করে নিয়ে গেল। এ জার্সিটা ওদের নাগরিকত্বের পরিচয় নয়। এটি তাদের দুর্নীতির বড় নমুনা।’

কিন্তু অতীত নিয়ে দুই দেশের কাদা ছোড়াছুড়ি চলছেই। সত্য এটাই-হলুদ এখন ব্রাজিলের সংস্কৃতির অংশ। এটা শুধুই সাত রংয়ের মতো একটা রং নয়। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো পেরেরান কথাটি তো হৃদয় দিয়ে ধারণ করেন পেলে-নেইমাররা, ‘ব্রাজিলের জন্য এ হলুদ রংটা ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র।’

এটি/এনইউ