ফুটবলের দুনিয়াটা এত বিস্তৃত, রকমারি সম্মোহনের সম্ভারে এত চাকচিক্যময়, উপভোগের বিচিত্র আয়োজনে এত সমৃদ্ধ যে মাঠমুখী প্রবনতার সীমায় বাস না করলেও এই গোলকধামবাসী কারও পক্ষে ফুটবলের আঁচ বাঁচিয়ে চলার সাধ্য থাকে না। জাগতিক সর্বজনীন দুর্যোগেরও সাধ্য নেই এই চর্মগোলক কেন্দ্রিক উৎসবাদিকে অগ্রাহ্য করানোর। 

চলমান সময়ে কণ্টকাকীর্ণ পৃথিবী ঐক্যবদ্ধ করোনা প্রতিরোধে, পাশাপাশি দুনিয়াজোড়া আনন্দ প্রবাহে মত্ত মানুষ ইউরো আর কোপার রোমাঞ্চ অবগাহনে। মৃত্যুর স্বৈরাচারী তাণ্ডবে ডুবে থাকা মরণশীলদের এমনই অনুরাগ এক খেলাকে ঘিরে। বিত্তবান আর বিত্তহীন এখানে এক একাকার। মৃত্যুর নগদ সমন হাতে ঘুরতে ঘুরতে চোখ রাখছে আনন্দ উৎসে, ইউরোপের মাঠে মাঠে, মারাকানার ফুটবল তীর্থে। 

প্রশ্নের পিঠে হৃদয়ে হৃদয়ে উত্তর ভাসছে কোটি কোটি জোড়া চোখের তারায় তারায়, আছে, যাদু আছে ফুটবলে। সে যাদু মৃত্যুর ভ্রূকুটি ভুলিয়ে ডুবিয়ে রাখে খেলার মত্ততায়। আবারো প্রশ্ন, কি সে যাদু? ওই যাদুর নাম ‘গোল’। গোল করা আর গোল রক্ষা। গোল মানে তো গোলাকার, যা পৃথিবীর সমার্থক। আবার গোল মানে লক্ষ্য। সব জীবনেরই একটা লক্ষ্য, চেতনে হোক বা অবচেতনে হোক, থাকেই। সময়ে হয়তো এ লক্ষ্য পরিবর্তনশীল, তবু বহমান থাকেই। আর এ লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে থাকে লক্ষ্যভেদের প্রস্তুতি, প্রতিরোধ আর প্রতিরোধ পেরুনোর সংগ্রাম। 

ফুটবলের ছলাকলার মাঝে মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে জীবন সংগ্রামের সেই ছলাকলাকেই দেখে, দেখে আনন্দ পায় এবং মায়ায় বাঁধা পড়ে। পক্ষপাত ও বিরুদ্ধতা আসে সে মায়া থেকেই। সেটাই একসময় হয়ে যায় সেই মৃত্যুঞ্জয়ী জাদু। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে থাকে তার প্রভাব। দূর ছাই, এখন কি আর এসব নিরানন্দ তত্বকথা বলার সময়। 

আর ঘণ্টা কয়েক। তারপরই অনেক জটিল ধাঁধার সমাধান। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল, যে দিকেই খেলাশেষের উৎসব হোক, আমাদের তা নিয়ে মাথাধরা কেন? আমরা তো ভালো ফুটবল, মানে নান্দনিক বলতে যা বোঝায়, তাই দেখতে চেয়েছি।

রোমাঞ্চে, উত্তেজনায় কাঁপছে সময়। একটি মাত্র রাত পেরুলেই মারাকানার মাঠ, নেইমার, মেসি, লাতিন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই।এখন চাঁদ রাতের উত্তেজনায় চারদিকে ফুটবল মদিরা পানের উন্মাতাল গাড় আবাহন। কল্পতরুর পাতার মর্মরে বীরগাঁথা আর সাম্ভাব্য বিজয়ীর অনুমিত বয়ান। সে দিকটা বরং সামান্য চোখের কোনায় টেনে প্রলাপ শেষেরদিকে এগোই। 

আর ঘণ্টা কয়েক। তারপরই অনেক জটিল ধাঁধার সমাধান। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল, যে দিকেই খেলাশেষের উৎসব হোক, আমাদের তা নিয়ে মাথাধরা কেন? আমরা তো ভালো ফুটবল, মানে নান্দনিক বলতে যা বোঝায়, তাই দেখতে চেয়েছি। সেটারতো ব্যবস্থা হয়েই আছে। কিন্তু তা বললে কী আর হয়। সেই কবে থেকে শিল্প পক্ষপাতের বিভাজন হয়ে আসছে। সেটাকে কি আর অস্বীকার করা যায়।

আজকের ফুটবলে আমরা মানছি ইউরোর ফুটবল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালায় রাখা চিত্রকলা। কিন্তু লাতিন ফুটবল আমাদের কাছে ঢাকার রিক্সাপেইন্টিং। একান্ত আপন আর নাগালের। লাতিন অঞ্চলের সাথে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন যাপন বা সামাজিক মূল্যবোধ, কিছুতেই মিল নেই, ফুটবলেতো নয়ই। 

কতকাল হলো, জাদুকর সামাদের মোহ ভেঙে পেলে, ম্যারাডোনায় আমাদের মোহযুক্তি। সেটাকে জিইয়ে রাখতেই তো নেইমারের চুলে রং করা বাহার, মেসির গা ভরা উল্কি। শিল্প আর যান্ত্রিকতার বিভাজনে ইউরোপের ঝা চকচকে গতির ফুটবলে আমাদের ভালো লাগা ভালোবাসার মিশেলে জারিত হতে পারেনি, অন্য এক মোহমায়ার ধারাবাহিকতার কারণে। সে মোহের প্রবর্তক পেলে আর ম্যারাডোনা। বিস্ময় আর মুগ্ধতার পাল্টাপাল্টিতে আমরা তাই কেউ আর্জেন্টিনা, কেউ ব্রাজিল। 

আজকের ফুটবলে আমরা মানছি ইউরোর ফুটবল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালায় রাখা চিত্রকলা। কিন্তু লাতিন ফুটবল আমাদের কাছে ঢাকার রিক্সাপেইন্টিং। একান্ত আপন আর নাগালের। লাতিন অঞ্চলের সাথে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন যাপন বা সামাজিক মূল্যবোধ, কিছুতেই মিল নেই, ফুটবলেতো নয়ই। 

ব্যক্তিগতভাবে চাইবো মনে দাগকাটার মতো অভিনব কিছু হোক। মেসি ডানপায়ের ফ্রি কিকে গোল করুক, নেইমার অভিনয় দক্ষতায় একটি পেনাল্টি আদায় করুক। ম্যারাডোনার খোদার হাতের মতো সে পেনাল্টি অমর হোক।

তবুও এই ভালোবাসার টান দারিদ্র আর জীবনসংগ্রামের ঐক্যে। চরদখলের একাগ্রতা আর নিষ্ঠা তাই আমাদের সমর্থনের লড়াইয়ে, সে লড়াই ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার শ্রেষ্ঠত্বের। সে লড়াই মেসি ও নেইমারের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবের। সে লড়াইয়ের মহড়ায় তাই আমরা দুই দেশের কবি সাহিত্যিকদেরও তুলনানূলক বিচারে নামিয়েছি আর আমরা নামতে নামতে লাঠি ও টেটা পর্যন্ত হাতে তুলে নিয়েছি। কণ্ঠ ও কলম, সেতো অনেক ভব্যতা সম্মত। 

আক্ষেপ শুধু ফুটবলটাই যা ওদের ধারেকাছে খেলতে পারি না। তাই বিশ্লেষণে আর উন্মত্ততায় আনন্দপ্রবাহে আমাদের যোগদান। আমরা কাল সকালে আবেগের স্নায়ুচাপে জর্জরিত হতে হতে দর্শনানন্দে ভাসবো। ব্যক্তিগতভাবে চাইবো মনে দাগকাটার মতো অভিনব কিছু হোক। মেসি ডানপায়ের ফ্রি কিকে গোল করুক, নেইমার অভিনয় দক্ষতায় একটি পেনাল্টি আদায় করুক। ম্যারাডোনার খোদার হাতের মতো সে পেনাল্টি অমর হোক। আরও নাটকীয় কিছুর সূত্র ধরে আর্জেন্টিনার শেষ প্রহরী যোগ দিক লেভ ইয়াসিন, অলিভার কান, শিল্টন বা গর্ডন ব্যানক্সদের তালিকায়। ধ্রুপদী অপেক্ষায় সবাইকে স্বাগতম।