দূর দেশ নিয়ে কেন এই রক্তপাত?
ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সীমান্তে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপমা হয়ে আছে ইগুয়াসু জলপ্রপাত। দুই দেশকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রাখা এই ঝরনাধারা যেন রংধনুর রঙে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে রেখেছে। রংধনু তো আর সারাক্ষণ দৃশ্যমান হয় না। তবে জলধারা সর্বদা বহমান। কখনও কখনও স্রোতের গতিবেগের হেরফের হয়। অনেকটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা রাষ্ট্রীয় আন্তঃসম্পর্কের মতো। এটা খুবই স্বাভাবিক, কোনও সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা বরাবরই একই ধারায় বয়ে চলে না। খিটিমিটি লেগে যায়।
আর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোয়ারভাটা চলতেই থাকে। অমীমাংসিত আঞ্চলিক বিরোধ এবং নীরব ‘শত্রুতা’ সমান্তরালভাবে রয়ে যায়। অর্থনীতি, জনসংখ্যা, জিডিপির দিক দিয়ে লাতিন আমেরিকার প্রধান দুই শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে দীর্ঘ দিন যাবৎ তেমন বৈরিতা নেই বললেই চলে। বরং তারা মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। একে অপরের প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটনের ক্ষেত্রে দেশ দুটি পরস্পরের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু একটি ক্ষেত্রে দুই দেশের মিত্রতা নেই। খেলার মাঠে তারা একে অপরের মুখোমুখি হলে তখন খুলে যায় ভদ্রতার মুখোশ। একটুও ছাড় দিতে রাজি না। দ্বিগুণ শক্তিতে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে মোটেও দ্বিধা করে না। আর এই বৈরিতা বা বিদ্বেষ অতিমাত্রায় দেখা যায় ফুটবল মাঠে। যে কারণে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনলাইন বৈঠকে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজের উপস্থিতিতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো অবলীলায় বলে ফেলেন, কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৫-০ গোলে হারাবে ব্রাজিল! এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এই দুই দলের ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনার পারদ কত দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
সেই ঔপনিবেশিক কাল থেকে লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য উভয় দেশের যে প্রচ্ছন্ন অভিলাষ, তার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। এই ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একদম শুরু থেকেই। একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি এমনই বিরূপ হয়ে পড়ে, প্রায় এক দশক এক দেশ আরেক দেশে গিয়ে খেলা থেকে বিরত থাকে। এমনকি শিরোপা বা ট্রফি হারানোর ঝুঁকি নিতেও কার্পণ্য করেনি।
এই দুই দেশের খেলা নিয়ে কাণ্ডকীর্তিও কম হয়নি। দ্বন্দ্ব-সংঘাত খুবই মামুলি ব্যাপার। এ কারণে এই দুই দলের লড়াইকে ‘ব্যাটল অব আমেরিকাস’ নামে অভিহিত করা হয়। ইএসপিএন এফসি-র রেটিং অনুসারে, জাতীয় দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিক দিয়ে এই দুই দেশের ম্যাচটি আছে শীর্ষস্থানে। আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই ম্যাচটিকে নিয়ে ফিফার বোধকরি এক রকম গর্ব আছে। যেজন্য এই ম্যাচটিকে তারা মনে করে ‘ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্যাস’। এই নির্যাসের সৌরভ যুগে যুগে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিচ্ছে ফুটবল অনুরাগীদের। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, স্বার্থগত কিংবা খেলার মাঠে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মধ্যে চরম বিরোধিতা থাকতেই পারে। কিন্তু তার প্রভাব কেন বাংলাদেশে এত তীব্রভাবে পড়বে?
সবার আগে বিশ্বকাপ ফুটবলকে রাঙিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব ব্রাজিলের। প্রথম দিকে উরুগুয়ে, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হলেও কোথায় যেন একটা খামতি রয়ে যায়। তাদের খেলায় গতি ছিল, কৌশল ছিল, কিন্তু সৌন্দর্য ছিল না। ফুটবল দুনিয়ায় তা কাঁপন ধরাতে পারেনি। ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর চারপাশে ধ্বনিত হতে থাকে সুন্দর ফুটবলের জয়গান।
ফুটবল মাঠে পায়ের তুলিতে যে ছবি আঁকা যায়, তা দৃশ্যমান করে তোলেন ব্রাজেলীয় ফুটবল শিল্পীরা। হৃদয়ের কালি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা রঙধনুর মতো বিমূর্ত সেই শিল্পকর্মগুলো উদ্ভাসিত থাকার কথা নয়। তবে অমলিন হয়ে আছেন ফুটবলের কালজয়ী সেই চিত্রকররা।
যে খেলা দেখে দর্শকদের বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অনির্বচনীয় এক অনুভব। ফুটবল মাঠে পায়ের তুলিতে যে ছবি আঁকা যায়, তা দৃশ্যমান করে তোলেন ব্রাজেলীয় ফুটবল শিল্পীরা। হৃদয়ের কালি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা রঙধনুর মতো বিমূর্ত সেই শিল্পকর্মগুলো উদ্ভাসিত থাকার কথা নয়। তবে অমলিন হয়ে আছেন ফুটবলের কালজয়ী সেই চিত্রকররা।
এই শিল্পীদের কেউ জীবিত। কেউবা মৃত। বিশ্বকাপ জয়ী প্রথম দুই দলে খেলেন পেলে, গারিঞ্চা, ভাভা, দিদি, মারিও জাগালো, নিল্টন সান্তোষ, আলতাফিনি, জিটো প্রমুখ আর তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়ন দলে পেলে ছাড়াও আলোচিত ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন জেয়ারজিনহো, রিভেলিনো, তোস্টাও, কার্লোস আলবার্তো, ক্লদওয়ালদো, গারসনরা। শিল্পী চিরদিন থাকেন না, তাঁর শিল্পকর্ম হয়ে যায় চিরকালীন।
সেই সময় এই ফুটবলারদের শৈল্পিক ফুটবলের সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার সুযোগ এই দেশের মানুষের তেমন একটা ছিল না। তখন তো টেলিভিশন সুলভ নয়। তাদের নিয়ে কাগজে-কলমে যে কাব্যগাঁথা রচিত হয়, তাতেই ব্রাজিল দলটির প্রতি একটু একটু করে আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে। বাংলাদেশেও গড়ে ওঠতে থাকে ব্রাজিলের প্রতি অনুরক্তি। শুরুর দিকের ভালো লাগার সেই কুঁড়ি ভালোবাসার ফুল হয়ে ফোটে আশির দশকের গোড়ায়।
বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হওয়ায় নিমিষেই দূরত্ব ঘুচে যায়। ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় ফুটবল ফিয়েস্তার আমেজ। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। রানার্সআপ হয় পশ্চিম জার্মানি। শারীরিক শক্তি আর ট্যাকটিক্যাল ফুটবলের বিপরীতে মন ছুঁয়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ে যাওয়া ব্রাজিলের ছন্দময় খেলা।
সেই দলের সক্রেটিস, জিকো, জুনিয়র, ফালকাও, সার্জিনহো, এডেরের জীবনদর্শন ছিল সুন্দর ফুটবলের চর্চা। পায়ের কারুকাজ দিয়ে তারা প্রদর্শন করেন মায়াবী ও আনন্দদায়ী ফুটবল। ব্রাজিল দলটি অনায়াসেই জয় করে নেয় ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়। টেলিভিশনের কল্যাণে তা পৌঁছে যায় প্রত্যন্ত এলাকায়ও। মূলত তখন থেকেই ব্যাপক হারে ব্রাজেলীয় ঘরানার ফুটবলের প্রতি অনুরাগীর সংখ্যা দ্রত গতিতে বাড়তে থাকে।
ব্রাজেলীয় ফুটবলের সৌন্দর্যে আপ্লুত হলেও কোনও চ্যালেঞ্জ না থাকায় একটা পর্যায়ে কারও কারও কাছে একঘেয়েমি লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। নতুন কিছুর প্রতি তৃষ্ণা দেখা দিতেই পারে। বোধ করি প্রাকৃতিক নিয়মেই সেই তৃষ্ণা মেটাতে অনুঘটক হয়ে আসে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল। মেক্সিকোর সেই বিশ্বকাপটি রূপে, রঙে, রসে মাতিয়ে দেয় ফুটবল দুনিয়া। মূলত তখন থেকে দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মেক্সিকান ওয়েভ’। এরপর থেকে গ্যালারিকে প্রাণোচ্ছ্বল করার এই তরিকা সর্বত্রই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। বাংলাদেশেও রঙিন টেলিভিশনের ছড়াছড়ি হওয়ার কারণে ফুটবলও হয়ে ওঠে রঙদার।
সম্ভাব্য বিজয়ী দলের মধ্যে আর্জেন্টিনার নাম ছিল না। না থাকার কারণ, দলের খেলোয়াড়রা ছিলেন গড়পড়তা মানের। এই দলটিকে জাগিয়ে তোলেন ম্যারাডোনা। অধিনায়ক হিসেবে তিনি তাঁর উদ্যম ও সামর্থ্য দিয়ে দলটিকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেন।
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে সেই বিশ্বকাপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন একজন ফুটবলার। টুর্নামেন্টে ২৪টি দলে অসংখ্য ফুটবলার খেললেও এই বিশ্বকাপকে ‘ওয়ান-ম্যান শো’-এ পরিণত করেন আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেবার ফেবারিট টিমের মধ্যে ছিল ফ্রান্স, ব্রাজিল, পশ্চিম জার্মানিরা। সম্ভাব্য বিজয়ী দলের মধ্যে আর্জেন্টিনার নাম ছিল না। না থাকার কারণ, দলের খেলোয়াড়রা ছিলেন গড়পড়তা মানের। এই দলটিকে জাগিয়ে তোলেন ম্যারাডোনা। অধিনায়ক হিসেবে তিনি তাঁর উদ্যম ও সামর্থ্য দিয়ে দলটিকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেন। একইসঙ্গে খেলোয়াড় হিসেবে নিজের সক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছেন।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে তিনি নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে যান, তার কোনও তুলনা হয় না। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি প্রদর্শন করেন অতিমানবীয় ক্রীড়াশৈলী। ‘হ্যান্ড অব গড’ আর ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ খ্যাত তার করা গোল দুটি অনায়াসে ফুটবল পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এই দুই গোল নিয়ে গবেষণা বা পর্যালোচনা তো থেমে নেই। একক নৈপুণ্য দিয়ে যেভাবে একটি দলকে শিরোপা এনে দেন, তা ফুটবল ইতিহাসে নজিরবিহীন। তার অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যের কারণে আর্জেন্টিনার এই টিমকে ‘ওয়ান-ম্যান টিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এতে অতিশয়োক্তি থাকলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, ম্যারাডোনাকে ছাড়া এই টিম চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো না।
বীরদের নিয়ে মাতামাতি নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে এমনটা হয়ে এসেছে। সঙ্গত কারণেই ফুটবলের বীর ম্যারাডোনাকে নিয়েও দেশে দেশে বয়ে যায় উচ্ছ্বাসের বন্যা। বিশ্বকাপ ফুটবলের দলগুলোকে সমর্থন করা নিয়ে কোনও রেটিং করা হয় কি না জানা নেই। তবে নির্দ্বিধায় বলা হয় যায়, ম্যারাডোনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার যত সমর্থন বেড়েছে, আর কোথাও এমনটা হয়নি। ১৯৮৬ সালের পর বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনা আর শিরোপা জিততে পারেনি। তাতে করে সমর্থনের ক্ষেত্রে মোটেও ভাটা পড়েনি। এর কারণ হতে পারে, তারকা ফুটবলারদের লড়াইয়ে এগিয়ে আছেন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। ম্যারাডোনার দেওয়া ব্যাটন সগৌরবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাকে নিয়ে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উদ্দীপনা পুরোমাত্রায় অটুট রয়েছে। ২০১১ সালে মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বাংলাদেশ সফর করায় এবং ঢাকায় নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ খেলার কারণে এই দেশে জনপ্রিয়তার পালে আরও বেশি হাওয়া লাগে।
সেই হাওয়ায় আর্জেন্টিনার সমর্থকদের তোপের মুখে বলতে গেলে অনেকটা গুটিয়ে গেছেন ব্রাজিলের সমর্থকরা। অথচ ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল। সর্বাধিক পাঁচবার শিরোপা জয় করা ছাড়াও নব্বই দশক থেকে উপহার দিয়েছে কারেকা, রোমারিও, বেবেতো, রোনাল্ডো, কাফু, ডুঙ্গা, ব্রাঙ্কো, লিওনার্দো, আলদেয়ার, রিভালদো, কাকা, রবার্তো কার্লোস, রোনালদিনহো, ডেনিলসন, গিলবার্তো সিলভা, রবিনয়ো, নেইমারের মতো জাত প্রতিভা। অথচ ম্যারাডোনা এবং মেসির তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার কাছে তারা কেন যেন ম্লান হয়ে গেছেন।
অবশ্য তার মানে এই নয় যে, ব্রাজিলের প্রতি সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। আসলে যে সৌকর্যময় ফুটবল দিয়ে ব্রাজিল দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল, তা যেন এখন তেমনভাবে অনুভব করা যায় না। তাছাড়া ২০১৪ সালে নিজেদের মাটিতে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ব্রাজিল ১-৭ গোলে হারার পর সমর্থকদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে যায়। প্রতিপক্ষের ‘সেভেন আপ’ বক্রোক্তি নীরবে সইতে হয়। রানার্সআপ হয় আর্জেন্টিনা। গত বিশ্বকাপেও আশার আলো জ্বালাতে পারেনি। বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে।
অথচ আর্জেন্টিনাও আহামরি কিছু করতে পারেনি। বরং এক ধাপ আগেই তাদের চলে যেতে হয়েছে। তারপরও মেসিকে নিয়ে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উচ্চাশা কখনোই থিতিয়ে যায়নি। সেই দিক থেকে নেইমার ব্রাজিল সমর্থকদের তেমনভাবে উজ্জীবিত করতে পারেননি। তারপরও ব্রাজিলের ‘জোগো বনিতো’ এবং আর্জেন্টিনার ‘লা নোয়েস্ত্রা’ ফুটবলশৈলী আর দুই দেশের দুই মহানায়ক পেলে এবং ম্যারাডোনাকে নিয়ে বিতণ্ডা অব্যাহত আছে। এখন অবশ্য তাদের পরিবর্তে আলোচনা-সমালোচনায় স্থান করে নিয়েছেন মেসি আর নেইমার। মজার ব্যাপার, ব্রাজিলিয়ানদের কেউ কেউ চাইছেন, মেসির মনোবাসনা যেন পূরণ হয়। এমন চাওয়ায় ক্ষেপেছেন মেসির বন্ধু নেইমার।
বিষয়টা হলো, আর্জেন্টিনার না থাকলেও বাংলাদেশে ব্রাজিলের দূতাবাস আছে। কিন্তু দুই দেশের দূরত্বের কারণে খুব বেশি দহরম-মহরম নেই বললেই চলে। চাইলেই হুট করে সেখানে যাওয়া না। তাই কুটুম্বিতা করারও তেমন একটা সুযোগ নেই। তারপরও লাতিন আমেরিকার এই দুই দেশের ফুটবল নিয়ে আমাদের দেশের যে হুজুগ, তা সবার কাছে কৌতূহলের কারণ। লেখার অবকাশ রাখে না, বাংলাদেশের মানুষ যে কোনও বিষয় নিয়ে মেতে ওঠতে পছন্দ করেন। আর খেলাধুলার প্রতি তাদের রয়েছে অসম্ভব আকর্ষণ। বিশ্ব পর্যায়ের খেলাধুলায় বাংলাদেশের অবস্থান নেই, এটা তাঁদের কাছে মনঃকষ্টের কারণ হয়ে আছে।
ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনা, তার কারণ কী? আসলে কোনও কিছুতে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে তার কোনও আনন্দ থাকে না। এমনকি চিত্রকর রংতুলিতে যে ছবি আঁকেন, ভেতরে ভেতরে তারও থাকে কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মনোবাসনা।
একটা সময় ক্রিকেট খেলায় ভারত আর পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতেন সমর্থকরা। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ স্থান করে নেওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশকে নিয়ে সেই উন্মাদনা আর আগের মতো নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরের একটি এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশের উপস্থিতি থাকে না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীরা কি চুপ থাকতে পারেন? তাই পছন্দের দল বেছে নিয়ে ফুটবলের আনন্দে বিভোর হতে দ্বিধা করেন না। প্রিয় দল হিসেবে কেউ বেছে নিয়েছেন ব্রাজিলকে, কেউ আর্জেন্টিনাকে। অন্য দলের সমর্থক থাকলেও এই দুই দলের কাছে তারা একদমই অনুজ্জ্বল হয়ে আছেন।
ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনা, তার কারণ কী? আসলে কোনও কিছুতে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে তার কোনও আনন্দ থাকে না। এমনকি চিত্রকর রংতুলিতে যে ছবি আঁকেন, ভেতরে ভেতরে তারও থাকে কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মনোবাসনা। না হলে সৃষ্টির কোনও মজা থাকে না। প্রতিপক্ষ না থাকলে ফুটবল খেলায় অন্তত জোশ পাওয়া যায় না। এটা তো আর লুডু বা দাবা খেলা নয়, নীরবে গুটি চাল বা কাটাকাটি করে মজা পাওয়া যাবে। ফুটবল হলো উত্তেজনাময় ও রোমাঞ্চকর খেলা। প্রতিটা মুহূর্তই টগবগিয়ে ফুটতে থাকে। প্রিয় দলের খেলা হলে তো কথাই নেই। স্নায়ুর চাপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যায়। আর প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারলে ভেতরটা খুশিতে নেচে উঠে। এই উচ্ছ্বাস শুধু খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। নিজের দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা এবং প্রতিপক্ষের দলকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অন্তর্গত একটা তাগিদ অনুভূত হয়। যে কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের পতাকায় ছেয়ে যায় বাংলাদেশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার পর তা সহজেই মানুষের মনোজগত দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন তো যে কোনও বিষয় মার্ক জাকারবার্গের কাছে উত্থাপন না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। আর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের জন্য এমন একটা মাধ্যম তো উৎসবের উপলক্ষ্য হয়ে এসেছে। কতভাবেই না প্রতিপক্ষকে বিরক্ত, বিব্রত ও বিচলিত করা যায়। তাতে থাকে সৃজনশীল ও নান্দনিক প্রকাশভঙ্গি। দেখতে বা শুনতে নেহাত মন্দ লাগে না। বেশ মজাও পাওয়া যায়।
ফেসবুক হয়ে উঠেছে লন্ডনের হাইড পার্কের স্পিকার্স কর্নার। এই উন্মুক্ত চত্বরে মনের মাধুরী মিশিয়ে যার যা খুশি প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। স্পিকার্স কর্নার তো সীমিত পরিসরে আবদ্ধ আর ফেসবুক অন্তহীন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে অবলীলায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে শোভনীয় ও অশোভনীয় নানান সব বিষয়। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।
অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে মাত্রাজ্ঞানও থাকে না। প্রকাশভঙ্গি এতই অমার্জিত, উগ্র ও পীড়াদায়ক হয় যে তা সহনশীলতা অতিক্রম করে যায়। এখন তো সবকিছুতে এমনটা হয়। ফেসবুক হয়ে উঠেছে লন্ডনের হাইড পার্কের স্পিকার্স কর্নার। এই উন্মুক্ত চত্বরে মনের মাধুরী মিশিয়ে যার যা খুশি প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। স্পিকার্স কর্নার তো সীমিত পরিসরে আবদ্ধ আর ফেসবুক অন্তহীন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে অবলীলায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে শোভনীয় ও অশোভনীয় নানান সব বিষয়। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।
এটাকে ব্যবহার করার কোনও বিধি-বিধান নেই। যে কারণে ফুটবলের পরাশক্তি দূরের দুটি দেশ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে কেন্দ্র করেও পারস্পরিক সম্পর্ক বিষাক্ত করতে একটুও দ্বিধা হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে মানসিকভাবে রক্তাক্ত করা হয়। আর সামনা-সামনি এই দুই দলের সমর্থকরা একে অপরের রক্ত ঝরিয়েও দেশের 'সুখ্যাতি' বয়ে এনেছেন। কিন্তু কেন এই রক্তপাত? এর কোনও সদুত্তর মেলে না।
ফুটবল তো নির্মল বিনোদনের খেলা। তা থেকে আনন্দ পাওয়াটাই হচ্ছে সারকথা। তা নিয়ে কেন এই হানাহানি? তাও এমন দুই দেশের জন্য, যাদের সঙ্গে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব খুব একটা মেলে না। এর কি কোনও প্রতিকার আছে? হয়তো আছে, হয়তো নেই। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে লেখা যায়, কোনও দিন যদি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারে, তাহলে পরের দেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর থাকবে না। আদতে সেই দিন কি কখনও আসবে?