কিংসে স্মোক ফ্লেয়ার ও ১৯৮২ সালে মহসীনের ইনজুরি
দর্শকরা খেলার প্রাণ। সেই দর্শকরাই খেলার মাঠে নানা ঘটনার জন্ম দেন। সম্প্রতি কিংস অ্যারেনায় চ্যালেঞ্জ কাপের ম্যাচ চলাকালেই মাঠে স্মোক ফ্লেয়ার ছুড়ে মারেন সমর্থকরা। এতে খেলা মিনিট দশেক বন্ধ ছিল। ইউরোপিয়ান ফুটবলে এমন চিত্র দেখা গেলেও, বাংলাদেশের ফুটবলে নতুনই।
স্মোক ফ্লেয়ারে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এতে চোখ ঝাঁজায় ও শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়। কিংস অ্যারেনায় দর্শকদের এই ঘটনায় বাংলাদেশের তারকা ফুটবলার মোহাম্মদ মহসীনের ইনজুরির প্রসঙ্গ আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ১৯৮২ সালে খুলনা লিগ খেলতে গিয়ে দর্শকদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণেই তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। এক-দেড় বছর চিকিৎসার পর মাঠে ফিরলেও আর সেই মহসীনকে পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞাপন
১৯৮২ সালে খুলনার সেই আহত হওয়ার ঘটনা মহসীন স্মরণ করলেন এভাবে, ‘আমার ক্রস থেকে একটি গোল হয়েছিল। গোলপোস্টের পাশেই সেই গোল উদযাপন করছিলাম। সেই সময় দর্শকরাও উল্লাস করছিল। কেউ একজন পটকা বোমা জাতীয় কিছু ছুড়ে মারে মাঠে। সেটা আমার কাঁধের নরম অংশে এসে পড়ল। এরপর মাঠ থেকে খুলনা হাসপাতাল, তারপর হেলিকপ্টারে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায়।’
আশির দশকে ঢাকা লিগের তারকা ফুটবলাররা জেলা লিগেও খেলতেন। ব্রাদার্সের মহসীন খুলনায় খেলতে গিয়েছিলেন তারকা ফুটবলার সালাম মুর্শেদীর অনুরোধেই। চার দশক আগের স্মৃতি হাতড়ে মহসীন বলেন, ‘আমার খুলনা লিগে খেলার তেমন ইচ্ছে ছিল না। সালাম (সাবেক ফুটবলার ও বাফুফের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি) খুব অনুরোধ করেছিল ওর জেলায় গিয়ে খেলতে। কে জানত ভাগ্যে এমনটা আছে। কাঁধে না পড়ে যদি হাত বা পায়ের কোনো অংশে পড়ত, তাহলে এত মারাত্মক অবস্থা হতো না।’
আরও পড়ুন
সেই ইনজুরি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন মহসীন। ওই সময় তার জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল বলে জানান তিনি, ‘প্রথম কয়েকদিন তো জ্ঞানই ছিল না। ঢাকায় একটানা হাসপাতালে ছিলাম দুই মাস। অবস্থার উন্নতি হয়নি। সাইফুদ্দিন মানিক ভাই (ব্রাদার্সের তৎকালীন কর্মকর্তা ও বামপন্থী নেতা) কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে আমাকে জার্মানি পাঠান। সেখানে এক বছর থাকায় খানিকটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি। তবে এখনো কাঁধে সেই দাগ রয়েছে।’
১৯৮১ সালে মহসীন ছিলেন ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। জাতীয় দলেও ছিলেন নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড। ১৯৮২ সালের সেই ঘটনা তার ক্যারিয়ার থেকে দুই বছর কেড়ে নেয়। ১৯৮৪ সালে মাঠে ফিরলেও সেই মহসীনকে আর পাওয়া যায়নি, তাই বড় একটা দীর্ঘশ্বাস তার, ‘জার্মানি থেকে ফিরে ব্রাদার্সের হয়ে নেমেছিলাম। সেই গতি ও খেলা কিছুই ছিল না। মানুষের মনে যে মহসীন ছিল, সেই মহসীনই যেন থাকে তাই আর পরে খেলিনি। কোচিং করিয়েছি ব্রাদার্স, আর্মিসহ বিভিন্ন দলে।’
দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী-মোহামেডানে কখনোই খেলেননি মহসীন। সত্তর-আশির দশকে ঘরোয়া ফুটবলের তৃতীয় শক্তি ব্রাদার্সে শুরু করে শেষ করা মহসীন এরপরও ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলারদের একজন। সতীর্থ অনেকের দৃষ্টিতে মহসীন শুধু সেই সময়ের নয়, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের মধ্যেও অন্যতম। ইনজুরিতে সেই আলোচনাটা ক্ষীণ হওয়ায় আফসোস তার, ‘বাংলাদেশের ফুটবলে আমার আরও অনেক কিছু দেওয়ার সামর্থ্য ছিল। তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগ তিন স্তরেই আমি সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছি। এমন রেকর্ড বোধহয় এখনও কারও নেই। ১৯৮১ সালে তো সর্বোচ্চ গোলদাতাই হয়েছি। ব্রাদার্সের হয়ে প্রতি মৌসুমে আমার অনেক গোল ছিল। ১৯৭৯ সালে আমার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ প্রথমবার (এখন পর্যন্ত একবারই) এশিয়া কাপে খেলেছে। ইনজুরিতে না পড়লে বাংলাদেশের ফুটবলের আরও অনেক ইতিহাসেই থাকতাম।’
মহসীনের সেই ঘটনায় খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা সমর্থকের শাস্তির বিষয় সেভাবে আলাোচনা হয় না। বর্তমান সময়ে সমর্থকদের দস্যুপনার মাশুল গুনতে হয় ক্লাব-ফেডারেশনকে। বর্তমান সময়ে দর্শকদের উশৃঙ্খলায় বড় শাস্তির সিদ্ধান্ত হয়। কিংস অ্যারেনার ঘটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ম্যাচ কমিশনার ও রেফারিজ রিপোর্টে বিষয়টি রয়েছে বলে জানা গেছে। বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটি কী শাস্তি দেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এজেড/এএইচএস