৬৭ বছরের বন্ধুত্ব: পিন্টু সেরাদের সেরা
বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অন্যতম মহীরূহ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। পেশাগত গণ্ডি পেরিয়ে দুইজন ছিলেন একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিংবদন্তী জাকারিয়া পিন্টুর প্রয়াণে বন্ধু কামরুজ্জামান স্মৃতিচারণ করেছেন—অনুলিখন করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।
১৯৫৭ সালের কোনো এক পড়ন্ত বিকেল বা সকালে এক ট্রায়ালে পিন্টুকে প্রথম দেখি। সেই সময় ঢাকার ফুটবলে মারকানীদের দাপট। পিন্টুকে প্রথম দেখে মজা করে বললাম, ‘আর ইউ মারকানী’। হেসে বলছিল , ‘নো পিউর বাঙালী।’ সেই থেকে পিন্টুর সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু। আমাদের ৬৭ বছরের বন্ধুত্বের ছেদ পড়ল আজ পিন্টুর প্রয়াণে।
বিজ্ঞাপন
পিন্টুর জন্ম নওগা। পরবর্তীতে তার বাবার চাকরির সুবাদে বরিশালে স্থানান্তরিত হয়। ফুটবলের টানেই তার ঢাকায় আসা। পিন্টুর শুরুটা ইস্ট এন্ড ক্লাব দিয়ে। পরের বছর ওয়ান্ডারার্সে যায়। দুই বছর ওয়ান্ডারার্সে খেলে মোহামেডানের জার্সি গায়ে জড়ায়। ১৯৬০-৭৫ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে টানা খেলেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোহামেডানের অনেকেই আবাহনীতে খেলেছে। শেখ কামাল পিন্টুকে অনেক বার বলেছিল আবাহনীতে খেলতে। ও কখনোই মোহামেডান ছাড়েনি।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দলে খেলার রেকর্ড মাত্র কয়েকজনের। এর মধ্যে পিন্টু অন্যতম। পাকিস্তান আমলে সামাজিক-রাজনৈতিক নানা বৈষম্যের মধ্যে জাতীয় ফুটবল দলে নিয়মিতই খেলেছে পিন্টু। তুরস্ক, ইরান অনেক দেশেই বড় টুর্নামেন্টে খেলেছে পাকিস্তান আমলেই।
ঢাকা মোহামেডানের জন্ম উনিশ শতকের ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের ইতিহাসের বড় অংশজুড়ে থাকবে পিন্টু। ও আট বছর মোহামেডানের অধিনায়ক ছিল। এর মধ্যে পাঁচবারই লিগ চ্যাম্পিয়ন। পাকিস্তান আমলে আগাখান গোল্ডকাপ ছিল খুবই জনপ্রিয়। সেই আগাখান গোল্ডকাপে মোহামেডান দুই বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পিন্টুর অধিনায়কত্বেই। স্বাধীনতার পর আগাখান গোল্ডকাপ আর জিততে পারেনি মোহামেডান (১৯৮১ সালে ব্রাদার্স যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন)।
গোলের খেলা ফুটবলে পিন্টু খেলত ডিফেন্সে। রক্ষণের খেলোয়াড় মানেই রাফ এন্ড টাফ। পিন্টু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমই ছিল। সে খুব কমই ফাউল করেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দলে খেলার রেকর্ড মাত্র কয়েকজনের (সান্টু, পিন্টু, প্রতাপ)। এর মধ্যে পিন্টু অন্যতম। পাকিস্তান আমলে সামাজিক-রাজনৈতিক নানা বৈষম্যের মধ্যে পাকিস্তান ফুটবল দলে নিয়মিতই খেলেছে পিন্টু। তুরস্ক, ইরান অনেক দেশেই বড় টুর্নামেন্টে খেলেছে পাকিস্তান আমলেই।
ষাটের দশকে আমি ফায়ার সার্ভিস ও আজাদ স্পোর্টিংয়ে খেলেছি। ফায়ার সার্ভিসের হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে আমার গোলও রয়েছে। সেই ম্যাচে আবার পিন্টু খেলেনি। এ নিয়ে কিছু দিন আগেও আমার টিপ্পনী শুনতে হয়েছে,‘আমি খেলিনি বলেই তুই গোল করতে পেরেছিস।’ মজা করে বললেও বিষয়টি বাস্তবও। পিন্টু থাকলে গোল করা কঠিনই ছিল মোহামেডানের বিপক্ষে। সালাউদ্দিনকে অনেকেই সেরা ফুটবলার বলে। পিন্টুকে পরাস্ত করে সালাউদ্দিনকে গোল করতে দেখিনি। আমার কাছে পিন্টুই সেরা। আমি বাংলাদেশের ফুটবলের সেরা একাদশ গড়লে পিন্টুই হবে অধিনায়ক ও ডিফেন্সে নাম্বার ওয়ান খেলোয়াড়।
পিন্টু ও আমি দুই জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। মোহামডোনের মতো দলে খেলেও পিন্টু নিয়মিত পড়াশোনা করত। হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেত বেশির ভাগ সময়। পিন্টুর লেখার হাতও ভালো। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সদস্য ছিল পিন্টু। ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও আছে ওর। সাংবাদিকদের বড় সংগঠন জাতীয় প্রেস ক্লাবেরও সহযোগী সদস্য ছিল পিন্টু। নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বও পালন করেছে। সাংবাদিকের কাজ খেলোয়াড় দোষ-গুণ খুজে বের করা। অনেক সময় পিন্টুর অনেক প্রশংসা করে লিখেছি আবার অনেক সময় সমালোচনাও করেছি। পিন্টু আমার বন্ধু হলেও কখনো বলেনি,' দোস্ত কেন এ রকম লিখলি বা ও রকম লেখ একটু’।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। সেই দলের অধিনায়ক ছিল পিন্টু। স্বাধীনতার আগে দেশের বাইরে পতাকা উত্তোলনের বিশেষ কীর্তি হয়েছিল পিন্টুর অধিনায়কত্বেই। নদীয়ায় পিন্টু বাংলাদেশের পতাকা যেভাবে প্রদর্শন করেছিল সেটা দেশের ইতিহাসের বড় একটি অংশ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিল স্বাধীন বাংলা দল। বোম্মে (বর্তমান মুম্বাইয়ে) স্বাধীন বাংলা দলের ম্যাচ দেখতে শর্মিলা ঠাকুর, দিলীপ কুমারের মতো ব্যক্তিত্ব এসেছিল।
স্বাধীন বাংলা দলে পিন্টু ছিলেন সিনিয়র ফুটবলার। স্বাধীনতার পর জাতীয় দল ও ক্লাবে পিন্টু খুব বেশি দিন খেলেনি। ৭৩ সালে ওর অধিনায়কত্বেই বাংলাদেশ মারদেকা খেলতে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম প্রীতি ম্যাচে এক দলের অধিনায়কও ছিল পিন্টু। ৭৫ সালে মোহামেডানের জার্সিতে পিন্টু মাঠ থেকে অবসর নিলেও ফুটবলের সঙ্গেই ছিল। মোহামেডান ওর যেন জীবন। কখনো কোচ, কর্মকর্তা সব আঙ্গিকেই ক্লাবের সঙ্গে ছিল। কিছুদিন আগেও (২০২১ সাল পর্যন্ত) ক্লাবের পরিচালক ছিল।
পিন্টুর জীবনটাই ছিল ফুটবল। খেলা এতটাই ভালোবাসত যে বাসর রাতও করেনি। বিয়ে করেই খেলতে চলে এসেছিল। তাই আমি পিন্টুকে দুষ্টমি করে বলতাম,‘তোর তো বিয়ে হয়নি, বাসর রাত করিসনি।’ পিন্টুর স্ত্রীও খুব ভালো মানুষ ছিল। ছেলে-মেয়েদের দারুণভাবে মানুষ করেছে। আমার সাথে এতটাই বন্ধুত্ব ছিল যে ওর মেয়েরা অনেক বিষয় আমাকে বলত পিন্টুকে বলার জন্য।
খেলার মাঠে পিন্টু যেমন শৃঙ্খল ছিল, তেমনি ব্যক্তি জীবনেও। ও সব সময় রোজা রেখে খেলত। কখনো নামাজ মিস করত না। চিরকালীন প্রবাদ,' আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ' এর প্রকৃত উদাহরণ পিন্টু। এশার নামাজের পরই সাধারণত ঘুমিয়ে পড়ত পিন্টু।
খেলোয়াড়, সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন দেখছি সত্তর বছর। আমার দৃষ্টিতে পিন্টু বাংলাদেশের ফুটবলের সেরাদের সেরা এবং সকল খেলা মিলিয়েও পিন্টুর মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব সেভাবে দেখি না। খেলোয়াড় হিসেবে ও সেরাদের সেরা আবার মানুষ হিসেবেও উচু মানের। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই ও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছে। বেসমারিক সর্বোচ্চ পদক স্বাধীনতা পুরস্কারও আছে। এত অর্জন, স্বীকৃতি ও পরিচিতি এরপরও একবোরে সাধারণ চলাফেরা করত। কথা বার্তায় কখনোই গরিমা ছিল না। ওর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সরলতা। মঞ্জুর হাসান মিন্টু ( সাবেক গোলরক্ষক ) ও জাকারিয়া পিন্টু দুই জনই আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। মিন্টু প্রয়াত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। আজ আমাকে একা রেখে চলে গেল পিন্টু।
এজেড/এফআই